ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখের আগমনী বার্তা সর্বত্র

মাটি সংলগ্ন জীবনের ছবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৩ এপ্রিল ২০১৭

মাটি সংলগ্ন জীবনের ছবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎসব

মোরসালিন মিজান ॥ পুরনো এবং নতুন বছরের মাঝখানে কয়েকদিনের দূরত্ব। কিন্তু এই দূরত্ব যেন স্বীকার করতে নারাজ বাঙালী। পহেলা বৈশাখের আগে তাই শুরু হয়ে গেছে উৎসব। তাকদুম তাকদুম বাজছে বাংলাদেশের ঢোল। বাউল মনের একতারাটা বুকের ভেতর সুর তুলছে। মাটির সরাটি রঙিন ক্যানভাস এখন। গ্রামীণ জীবনের কথা বলছে। এভাবে প্রস্তুতি পর্বেই দৃশ্যমান হচ্ছে বৈশাখ। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই উৎসবের আমেজ। ভাললাগার মুহূর্ত উপভোগ করছেন সব ধর্ম বর্ণের মানুষ। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ তার মৌল চেতনা দিয়েই পরাজিত করতে চায় সকল অশুভকে। ১৪২৩ বঙ্গাব্দের শেষ মাসটিও শেষ হতে চলেছে। ক’দিন পর ১৪২৪ বঙ্গাব্দের শুরু। প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ সারা দেশের প্রতিপ্রান্তে থাকবে উৎসব অনুষ্ঠান। বিপুল আয়োজনে বরণ করে নেয়া হবে নতুন বছরকে। এখন চলছে জোর প্রস্তুতি। অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন বেশ দৃশ্যমান। শহর ঢাকার যেদিকে চোখ যায়, বৈশাখ। বৈশাখের আগমনী বার্তা। বাঙালীর বর্ষবরণ মানেই ছায়ানট। অন্তত শুরুটা ছায়ানটের সঙ্গে না করলেই নয়। এবারও পহেলা বৈশাখ ভোর বেলায় মানুষের স্রোত নামবে রমনা বটমূলে। এবার ৫০তম আয়োজন। অনেক বড় ঘটনা। সেভাবেই প্রস্তুতি গ্রহণ করছে ছায়ানট। অনেক আগে থেকেই চলছে রিহার্সাল। প্রতিষ্ঠানের খুদে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন আসছেন ছায়ানট ভবনে। আসছেন শিক্ষকরা। সবাই মিলে সুর ঠিক করছেন। বাণী শুদ্ধ করছেন। রিহার্সাল উপলক্ষে দারুণ উৎসবমুখর এখন ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন। আয়োজকরা জানান, পঞ্চাশতম আয়োজন হওয়ায় সবার মনেই বিশেষ আবেগ কাজ করছে। পহেলা বৈশাখ সকালে আবেগ ভালবাসার সবটুকু প্রকাশ করতে চান তারা। আয়োজকদের পক্ষে ছায়ানটের শিক্ষক ও শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল বলেন, ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠানটি একইসঙ্গে বাঙালীর। এবার পঞ্চাশতম আয়োজন। দীর্ঘ পথচলায় আমরা মনুষ্যত্বের জয়গান করেছি। সব ভেদাভেদ ভুলে বাঙালী হয়ে ওঠার আহ্বান জানিয়েছি। এবার পঞ্চাশতম আয়োজন। এ তো কম কথা নয়। তবে আরও যেতে হবে আমাদের। বিভিন্ন পরিবেশনার মাধ্যমে আমরা সব ভয়কে জয় করে এগিয়ে চলার কথা বলব। বর্ষবরণ উৎসবের আরেকটি প্রধানতম আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রা। বহু বছর ধরে বর্ণাঢ্য এই উৎসবের আয়োজন করে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ সকালে অনুষদের সামনে থেকে বিশেষ এই র‌্যালি বের করা হয়। সব ধর্ম বর্ণের মানুষ এতে অংশ গ্রহণ করেন। লোকায়ত জীবন ও শেকড়ের সংস্কৃতিকে উর্ধে তুলে ধরে। আশ্চর্য সুন্দর এই আয়োজনের ভেতর বাহির নিরীক্ষা করে মুগ্ধ ইউনেস্কোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাও। জাতিসংঘের এই সংস্থা সম্প্রতি মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজের স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই আনন্দও যোগ হচ্ছে এবারের আয়োজনে। প্রথমবারের মতো একই ধরনের আয়োজন করছে সারাদেশের সবক’টি স্কুল কলেজ। আগেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এ ধরনের বহুবিধ আয়োজন করা হয়েছে। এবার চারুকলা অনুষদের আদলে হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর চমৎকার এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অধিদফতরের আওতাধীন সব প্রতিষ্ঠান প্রধানকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এর ফলে ঢাকায় নয় শুধু, সারাদেশেই মঙ্গলের বার্তা ছড়িয়ে পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। উল্লেখ করা জরুরী যে, এ বছর থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করবে ভারতের পশ্চিম বঙ্গও। সব মিলিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো ব্যাপার। এ প্রসঙ্গে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজক চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেন বলেন, আমাদের লোকায়ত সংস্কৃতির প্রধান কথাটি অসাম্প্রদায়িকতা। তাই লোক কৃষ্টিকে প্রাধান্য দিয়েই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এবারের শোভাযাত্রার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে জানিয়ে তিনি বলেন, খুবই আনন্দঘন পরিবেশে ছাত্রছাত্রীরা কাজ করছে। স্বেচ্ছাশ্রম। কিন্তু আনন্দের সীমা নেই। এই হাসিরাশি আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চান বলে জানান তিনি। মূল দুটি আয়োজনের বাইরেও চলছে হরেক প্রস্তুতি। হাইকোর্ট সংলগ্ন দোয়েল চত্বরে বসেছে মৃৎশিল্পের পসরা। সব সময়ই দেখা যায়। তবে এখন অনেক বেশি। মাটির ছোট ছোট সরাগুলোকে উজ্জ্বল রঙে এঁকে নেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন রকমের পাত্রের গায়ে প্রাকৃতিক রঙ। ফোক মোটিফ। শখের হাঁড়ির কথা তো না বললেই নয়। গ্রামীণ ঐতিহ্যের হাঁড়ি পাটের সিঁকেয় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দূর থেকে দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যায়। চেনা দোকানগুলোতে জায়গা করে নিয়েছে বাঁশের তৈরি কুলা। আলপনা আঁকা কুলা বিছিয়ে রাখা হয়েছে পথের ধারে। আছে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির ঝুরি। দোকানিদের কর্মব্যস্ততাও চোখ এড়ায় না। বর্ষবরণ উৎসবে নতুন পোশাক চাই। চাই-ই। দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো যোগান দিচ্ছে বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক। সব দোকানে এখন দেশীয় পোশাকের প্রাধান্য। চলছে বিভিন্ন প্রদর্শনী ও ফ্যাশন শো। শিল্পকলা একাডেমিতে আজ সোমবার থেকে শুরু হচ্ছে বৈশাখী মেলা। খ্যাতনামা দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো এ আয়োজনে অংশ নেবে। থাকছে ফ্যাশন হাউস নিপুণ ক্রাফট, টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির, কে ক্র্যাফট, অঞ্জন’স, মিয়া বিবি, রঙ বাংলাদেশ, শৈল্পিক ক্র্যাফট, এবি ফ্যাশন মেকার, এম ক্র্যাফট, সাদাকালো ও সিম্ফনি। এসব প্রতিষ্ঠানের নতুন ও আকর্ষণীয় ডিজাইনগুলো ফ্যাশন শোর মাধ্যমে তুলে ধরা হবে। সব মিলিয়ে জমজমাট সময়। বৈশাখের আগে আরেক বৈশাখ। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই উৎসবের জয় হোক।
×