ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এইচএসসি পরীক্ষা শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৩ এপ্রিল ২০১৭

এইচএসসি পরীক্ষা  শুরু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বড় ধরনের কোন জটিলতা ছাড়াই সারাদেশে শুরু হয়েছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। গত এসএসসি পরীক্ষায় ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একের পর এক প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার কারণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উদ্বেগ থাকলেও সঙ্কট ছাড়াই রবিবার থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তবে কেন্দ্রে অনুপস্থিত ছিল ১৩ হাজার ৬৯ পরীক্ষার্থী। এদিকে ট্রেজারি থেকে প্রশ্ন নেয়ার সময় আইন অমান্য করে সঙ্গে স্মার্ট ফোন রাখায় তিন কলেজ শিক্ষককে আটকের পর সাময়িক বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আটক করা ছাড়াও একাধিক ছাত্রকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এদিকে প্রশ্নফাঁস রোধে আগামী বছর থেকে স্থানীয়ভাবে প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার আশা করছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। প্রথম দিন ঢাকা কলেজ কেন্দ্র পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী আমরা আশা করছি, আগামী বছর স্থানীয়ভাবে প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারব। এর আগে গত দেড় মাস এসএসসি ও সমমানের বিভিন্ন পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে ফেসবুক, হোয়াটসএ্যাপসহ বিভিন্ন মোবাইল এ্যাপের মাধ্যমে। যা পরদিনের পরীক্ষায় হুবহু মিলেও গেছে। জানা গেছে, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়নের পুরো প্রক্রিয়া ‘ডিজিটাল’ করতে ২০১৪ সালের ২৯ জুন প্রস্তাব দিয়েছেন এইচএসসির প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি। শিক্ষামন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন তুলে দিয়ে তখন তদন্ত কমিটির প্রধান তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব সোহরাব হোসাইন (বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব) বলেছিলেন, প্রশ্নপত্র প্রণয়নে প্রযুক্তির ব্যবহারকে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। এটা হবে ইন্টারনেটনির্ভর। অর্থাৎ সবগুলো কেন্দ্রে ইন্টারনেট, ডিজিটাল প্রিন্টার ও বিদ্যুত থাকতে হবে। লোকালি প্রশ্ন প্রিন্ট হলে তার নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। এতে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। এজন্য অবকাঠামো ডেভেলপ করতে হবে। এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য কিছু শিক্ষকের অসততাকে দায়ী করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেছেন, প্রশ্নপত্র রাখা হয় উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত। ফলে পরীক্ষার দুই ঘণ্টা আগে তারা প্রশ্ন দিতে বাধ্য, কেননা সেই প্রশ্ন গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়। এবার যখন বিভিন্ন জেলায় প্রশ্নপত্র পাঠানো হলো, তখনও তা ফাঁস হয়নি। কিন্তু শেষরাত বা ভোররাত থেকে প্রশ্ন ফেসবুকে আসতে শুরু করে। পরীক্ষার মাঝে ও পরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রশ্নফাঁস চক্রের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে অধ্যক্ষ ছাড়া শিক্ষকও আছেন। ইতোমধ্যেই তাদের কয়েকজন আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন নানা উপায়ে প্রশ্ন এনে তারা অর্থ হাতিয়েছেন। তাদের বক্তব্যে বেরিয়ে এসেছে জেলা প্রশাসকের ট্রেজারি থেকে প্রশ্নফাঁসের তথ্যও। এসব ঘটনার পর এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস এড়াতে বিটিআরসি ছাড়াও পরীক্ষা সংক্রান্ত আইনশৃঙ্খলা কমিটির তৎপরতাও বাড়ানো হয়। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যেই রবিবার এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। প্রথম দিন অনুষ্ঠিত হয়েছে এইচএসসিতে বাংলা পরীক্ষা। পরীক্ষার আগের দিন রাতে প্রশ্নফাঁসের গুজব ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন দিয়ে কিছু লিঙ্কও দেয়া হয় বলে বলেছেন অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। তবে রবিবার মূল প্রশ্নের সঙ্গে ওই প্রশ্নের কোন মিল পাওয়া যায়নি। সকালে পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, নানা পদ্ধতি অনুসরণ করে তারা প্রশ্নফাঁস রোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কোনো বাবা তার সন্তানকে প্রশ্ন এনে দিয়েছে এ কথা শুনলে সমাজে ঘৃণিত হতো, ওই মেয়েকে আরেকজন বিয়ে করার সময় চিন্তা করত তার বাপ তাকে কুপথে দিয়েছে। আজকে সমাজের যে অবক্ষয় তা থেকে শিক্ষক-ছাত্র বাইরে না। শিক্ষা পরিবারকে অবশ্যই এর থেকে বাইরে আনতে হবে, কারণ তারাই আমাদের ভবিষ্যত। তিনি আরও বলেন, আমাদের ব্যর্থতা থাকতেই পারে। দুনিয়ায় এহেন জিনিস নাই যা শতভাগ নিñিদ্র। আমাদের দেশে খুন করলে ফাঁসি হয়, মামলা হচ্ছে, রোজই ফাঁসি হচ্ছে, আবার খুন হচ্ছে দুনিয়ার সব দেশে। তাই আমাদেরও এটা একটা সমস্যা, তাই বলে এটাকে জাস্টিফায়েড বলছি না, একে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এদিকে ট্রেজারি থেকে প্রশ্ন নেয়ার সময় আইন অমান্য করে সঙ্গে স্মার্ট ফোন রাখায় তিন কলেজ শিক্ষককে আটকের পর সাময়িক বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আটককৃতরা হলেন হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আবদুর রশীদ এবং টিএ্যান্ডটি মহিলা কলেজের প্রভাষক নাঈমা নাসরীন ও মাহবুবুর রহমান। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সরকারী ট্রেজারি থেকে সকালে এইচএসসির প্রথম দিনের প্রশ্ন আনতে গিয়েছিলেন এই তিন শিক্ষক। সকালে ঢাকা কলেজ কেন্দ্র পরিদর্শন করে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এর মানে (প্রশ্ন) বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে চলে যায়। তারা তো সেখানে (ট্রেজারিতে) স্মার্ট ফোন নিয়ে যেতে পারেন না, নিয়মই নাই। আটক তিন শিক্ষকের মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করে বেতন বন্ধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আইনী প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হতে হবে। ক্রিমিনাল আইনেও পুলিশ করবে, এ বিষয়ে আমাদের কথা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ট্রেজারি থেকে প্রশ্ন বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফেসবুকে চলে যায়। বের হয়ে প্রশ্ন খুলেই পাঠিয়ে দেবেন, এরপর প্রচার করে দেবেন। আমাদের এত সম্মানী পেশা, সকল শিক্ষকের সম্মান নষ্ট করার জন্য কিছু লোক এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, সম্মান নষ্ট করবেন না, সম্মান থাকতে থাকতে চলে যান। যারা ধরা পড়েছেন তাদের সঙ্গে কুচক্রী মহল জড়িত। সমস্ত শক্তি দিয়ে এটা প্রতিহত করার চেষ্টা করছি। কিছু শিক্ষক প্রশ্ন হাতে পাওয়ার পরে তা প্রচার করে দেন। কিছু অভিভাবক আছেন নিজের সন্তানকে বলেন তুমি অপেক্ষা কর আমি দেখে আসি, তিনি টিচারকে হাত করতে টাকা দিচ্ছেন যেন এমসিকিউর প্রশ্নের উত্তর বলে দেন। তিনি আরও বলেন, অভিভাবকরা যদি সন্তানকে পড়তে উৎসাহিত না করে এ ধরনের পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, যদি কোন শিক্ষক টাকার বিনিময়ে উত্তর বলে দেন বা প্রশ্ন পেয়েই স্মার্ট ফোন দিয়ে তা পাঠিয়ে দেন, তাহলে সরকারের যাওয়ার কোন পথ থাকে না। প্রশ্নফাঁস রোধ নানা পদ্ধতি অনুসরণের কথা জানিয়ে বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনৈতিক কাজ করছে। কোন বাবা তার সন্তানকে প্রশ্ন এনে দিয়েছে এ কথা শুনলে সমাজে ঘৃণিত হতো, ওই মেয়েকে আরেকজন বিয়ে করার সময় চিন্তা করত তার বাবা তাকে কুপথে দিয়েছে। আজকে সমাজের যে অবক্ষয় তা থেকে শিক্ষক-ছাত্র বাইরে না। শিক্ষা পরিবারকে অবশ্যই বাইরে আনতে হবে, কারণ তারাই আমাদের ভবিষ্যত। সমস্ত সমাজের মধ্যে জাগরণের চিন্তা আসতে হবে। সবার সহযোগিতায় এটা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করব। শিক্ষকরা আপনারা যার যার পেশাকে ঠিক রাখবেন, নাহলে সবাইকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে। অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন, গতকাল দুইজন প্রিন্সিপালসহ কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছেন, মামলা দেয়া হয়েছে, বেতন বন্ধ হয়েছে, সাসপেন্ড করে দেয়া হয়েছে, আইনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে চাকরি যাবে, জেলে যাবেন, আমরা কোন ছাড় দেব না। এদিকে ঢাকার বাইরে টাঙ্গাইলের নাগরপুরে ‘প্রক্সি’ দিতে গিয়ে ফরিদ হোসেন ওরফে সুজন নামে এক যুবককে এক বছরের বিনশ্রম কারাদ-াদেশ দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। একই সঙ্গে ৫শ’ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও সাতদিনের কারাদ- দেয়া হয়। নাগরপুর মহিলা ডিগ্রী কলেজ কেন্দ্রে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) পুলক কান্তি চক্রবর্তী এ আদেশ দেন। জনকণ্ঠের চট্টগ্রাম অফিস জানিয়েছে, নির্বিঘœ পরিবেশে রবিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে এইচএসসির প্রথম পরীক্ষা। কোন কেন্দ্র থেকেই অপ্রীতিকর কিছু ঘটার তথ্য পাওয়া যায়নি। শিক্ষা বোর্ড এবং প্রশাসনের কর্মকর্তারা পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। সুশৃঙ্খল পরিবেশে পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশের পাশাপাশি তাঁরা বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব ছড়ালেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নির্দেশনা রয়েছে। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক সামসুল আরেফিন নগরীর এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ ও নকলমুক্ত পরিবেশে পরীক্ষা চলছে। কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে সে জন্য প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায়িত্ব পালন করছে। চট্টগ্রামে অর্ধদিবস হরতালের আহ্বান সত্ত্বেও পরীক্ষায় এর কোন প্রভাব পড়েনি। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহেদা ইসলাম সুন্দর পরিবেশে এইচএসসি প্রথম পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানিয়ে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে নানা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের দেয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব ছড়ালেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি হয়েছে। বাগেরহাট থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানিয়েছেন, মোরেলগঞ্জে দুই শিক্ষকসহ এক পরীক্ষার্থী বহিষ্কার ও বহিরাগত ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে আটক করা হয়েছে। এরা হচ্ছেন, তেলিগাতী আলিম মাদ্রাসার প্রভাষক কক্ষ পরিদর্শক সিদ্দিকুর রহমান, পঞ্চগ্রাম ইউসুবিয়া আলিম মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক কক্ষ পরিদর্শক লোকমান শেখ ও পিকি মোহসিনীয়া আলিম মাদ্রাসার পরীক্ষার্থী মোঃ সাইফুল ইসলাম। পরীক্ষা শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দিনের পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেও কেন্দ্রে অনুপস্থিত ছিল ১৩ হাজার ৬৯ জন। এর মধ্যে আটটি সাধারণ বোর্ডে ৮ হাজার ৯৬০, মাদ্রাসায় ২ হাজার ৫৯৫ এবং কারিগরি বোর্ডে এক হাজার ৫১৮ জন। কেন্দ্রে অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কার করা হয়েছে এক শিক্ষক ও ৬৬ পরীক্ষার্থীকে।
×