ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রজ্ঞাপন জারি

বিমানের সার্ভিস জরুরী ঘোষণা, নিষিদ্ধ ইউনিয়ন কার্যক্রম

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৩ এপ্রিল ২০১৭

বিমানের সার্ভিস জরুরী ঘোষণা, নিষিদ্ধ ইউনিয়ন কার্যক্রম

আজাদ সুলায়মান ॥ অবশেষে বিমানের সব ধরনের সেবা জরুরী ঘোষণা করা হয়েছে। বিমানের অধীন সব শ্রেণীর চাকরিকে সেবার আওতায় আনা হয়েছে। এতে আপাতত ছয় মাসের জন্য বাংলাদেশ বিমানের ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম নিষিদ্ধ। বিমানকে এসেনশিয়াল সার্ভিস (জরুরী সেবা) ঘোষণা করায় এখন থেকে বিমানের দুটি ট্রেড ইউনিয়ন ও তিনটি শ্রমিক সংগঠনের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হবে। এর ফলে আন্দোলনের নামে সিবিএ সংগঠনগুলো কথায় কথায় কোন ধরনের সভা-সমাবেশ, মিছিল, মিটিং, ধর্মঘট ও গণজমায়েত করতে পারবে না। ডিউটি পালন না করে সিবিএ কার্যক্রমও করতে পারবে না। বিমান সূত্র জানায়, সম্প্রতি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতে বলা হয়, ১৯৫৮ সালের এসেনশিয়াল সার্ভিসেস অর্ডিন্যান্সের ক্ষমতাবলে বিমানের কর্মীদের চাকরিকে জরুরী সেবার আওতায় আনা হলো। কোন কর্মী যদি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের দেয়া দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানায়, তবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে কর্তৃপক্ষ। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের সব শ্রেণীর চাকরি জনগণের জীবনযাত্রা নির্বাহে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার জন্য আবশ্যক। জানা যায়, শৃঙ্খলা ফেরাতে বিমান খাতে ট্রেড ইউনিয়ন বা সিবিএ’র কর্মকা- নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। ট্রেড ইউনিয়নের দাবি-দাওয়া আদায় ও আন্দোলন কর্মসূচী ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ করে সম্প্রতি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ জারি করা হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব মিকাইল শিপার বলেন, বিমান সেক্টরে কেউ ট্রেড ইউনিয়ন এ্যাক্টিভিটিস করতে পারবে না। কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জরুরী অবস্থা বিবেচনায় এ নিষিদ্ধাদেশের মেয়াদ ছয় মাস। ট্রেড ইউনিয়ন যেটা আছে সেটা এ্যাজ ইট ইজ থাকবে। ট্রেড ইউনিয়নের কালেকটিভ বার্গেনিং দাবি-দাওয়া আদায়, এটা করতে পারবে না। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিমান ও সিভিল এভিয়েশন) আবুল হাসনাত মোঃ জিয়াউল হক বলেন, বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কী কারণে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে- জানতে চাইলে অতিরিক্ত সচিব বলেন, আমরা এ খাতে শৃঙ্খলা আরও সুদৃঢ় করতে চাই। জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, শুনেছি এমন একটি আদেশের কথা। আমরা এখনও চিঠি পাইনি। হয়ত দু’-একদিনের মধ্যে পেয়ে যাব। তখন বলা যাবে এ আদেশে কী কী উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৫৮ সালের এসেন্সিয়াল এ্যাক্টে যা যা আছে আমরা তার সবটাই কার্যকর ও বাস্তবায়ন করব। এতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য থাকবে না। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিমানের সব ধরনের চাকরির সেবা অত্যাবশ্যক ঘোষণা করার মানেই এখানকার সব ধরনের ট্রেড ইউনিয়নের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। এ আইনের আওতায় বিমানে সব ইউনিয়নের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা আবশ্যক। এদিকে বিমানের সব সেবা অত্যাবশ্যক ঘোষণার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রবিবার বিমানে দেখা দেয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বিমানের অফিসারদের মাঝে এতে স্বস্তির নিশ্বাস নেমে এলেও ইউনিয়নভুক্ত কর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। বেশ কয়েকজন অফিসার জানালেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৪৫ বছর ট্রেড ইউনিয়নের কাছে জিম্মি রয়েছে বিমানের ব্যবস্থাপনা বিভাগ। তুচ্ছ অজুহাতে ধর্মঘটের হুমকি দেয়া, কাজ বন্ধ করে দেয়া, ফ্লাইট উড়তে না দেয়া, হাতেনাতে চোর ধরার পরও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ায় অফিসারকে লাঞ্ছিত করা, দরজা-জানালায় লাথি মারা, বেতনের দাবিতে কোম্পানি সেক্রেটারির অ-কোষ টিপে ধরা, সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাকে দিগম্বর করার মতো ন্যক্কারজনক ও ঘৃণ্য কর্মকা- সম্ভব হয়েছে শুধু শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়নের কাছে জিম্মি থাকার দরুন। জানা যায়, বর্তমানে বিমানের তিনটি ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে। তা হলোÑ বিমান শ্রমিক লীগ, বিমান জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল ও বিমান ১৯১৭ এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন। এছাড়া পাইলট, কেবিন ক্রু, ইঞ্জিনিয়ার ও অফিসারদের আরও চারটি সংগঠন রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বিমান কর্তৃপক্ষ এসব ইউনিয়নের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। সিবিএ নেতারা কথায় কথায় বিমানে ধর্মঘট ডেকে বিমানের কার্যক্রম অচল করে দিচ্ছে। কাজ না করে ইউনিয়ন অফিসে আড্ডাবাজি আর চাঁদাবাজি করার অভিযোগ শীর্ষ কর্তৃপক্ষের। ইউনিয়নের হস্তক্ষেপ ছাড়া বিমানে কোন ধরনের নিয়োগ, পদোন্নতি, পোস্টিং হয় না। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এসেনশিয়াল সার্ভিস অথাৎ জরুরী সেবার আওতাধীন থাকাবস্থায় বিমানের অফিসার থেকে কর্মী এবং সব ধরনের সিবিএ সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। সব সিবিএ অফিস তালাবদ্ধ করে দিতে হবে। এ সময় কোন ধরনের কার্যক্রম ও নির্বাচন করতে পারবে না তারা। তাদের মতে, বিমানকে শুধু এসেনশিয়াল সার্ভিস ঘোষণা করলেই হবে না, পাশাপাশি বিমানের প্রশাসনিক কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। অফিসারদের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। জবাবদিহিতা ও যে কোন ধরনের অবৈধ হস্তক্ষেপ হঠোরহস্তে দমন করতে হবে। বিমানের সব ইউনিয়ন অফিসকে সিলগালা করে দিতে হবে। বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে আরও কঠোরহস্তে এসব অপশক্তিকে দমন করতে হবে। একই সঙ্গে দক্ষ সিনিয়র অফিসার নিয়োগ দিতে হবে। বর্তমান প্রশাসনের অধিকাংশ শীর্ষ কর্মকর্তা সিবিএ নেতাদের কাছে জিম্মি। তারা এ আদেশে আর কাউকে তোয়াক্কা না করে বা ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্বান্ত নিতে পারবেন, যা বিমানের মতো একটি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সের জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করবে। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিমানের সব ধরনের চাকরির সেবা অত্যাবশ্যক ঘোষণা করার মানেই এখানকার সব ধরনের ট্রেড ইউনিয়নের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। এ আইনের আওতায় বিমানে ইউনিয়নের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা আবশ্যক। জানতে চাইলে বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এয়ার কমোডর এম জাকিউল ইসলাম বলেন, বিমানের সব ধরনের সেবাকে অত্যাবশ্যক ঘোষণা করার মানে এখন থেকে ইউনিয়নের কিছু বৈধ অধিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা। দুনিয়াব্যাপী ট্রেড ইউনিয়ন একটি স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এ অধিকার বাংলাদেশে বা বিমানে যেভাবে প্রয়োগ করা হয় তা খুবই দুঃখজনক, অবাস্তব ও অনৈতিক। তিনি একটি উদাহরণ টেনে বলেন, শ্রম অধিদফতর থেকে সুনির্দিষ্টভাবে শর্তারোপ করে দেয়া হয় শ্রমিকদের দাবি আদায়ে সিবিএ বা ট্রেড ইউনিয়ন কী করতে পারবে। সেজন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লিখিত চুক্তিও থাকে। তাতে উল্লেখ থাকে করণীয়-অকরণীয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বিমানের এমডি হিসেবে বলাকায় নিজ অফিসে বসে বোয়িং কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে বৈঠক করার সময় হঠাৎ চিৎকার, হৈচৈ চেঁচামেচি। এসব শুনে ওই বিদেশী অতিথিরা আঁতকে উঠে জানতে চাইতেন, এসব কী হচ্ছে। তখন লজ্জায় কথা বলার কোন ভাষা থাকত না। অথচ বিদেশে ট্রেড ইউনিয়নকর্মীরা প্রতিষ্ঠানেই ঢুকতে পারে না। প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনায় ঢোকা দূরের কথা, দূরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সুসভ্যতার সঙ্গে কর্মসূচী পালন করা হয়। আর বলাকায় ঢুকে তারা একতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত মিছিল, সেøাগান, বিক্ষোভ, দরজায় লাথি মারা ও গালিগালাজের ঘটনা খুবই স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করেছিল। জাকিউল ইসলাম বলেন, বিমানের সার্ভিস অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণার দরুন এখন আর এসব করা যাবে না। কাজের সময় যার যে কাজ সেটা তাকে করতেই হবে। সঠিক সময়ে অফিসে আসতে হবে এবং আড্ডাবাজি, ফাঁকিবাজির সুযোগ থাকবে না। এতে বিমানের শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা ফিরে আসবে। শীর্ষ মহল সঠিক সময়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। নিঃশঙ্কচিত্তে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে যে কোন ধরনের আদেশ জারি করতে পারবে। যত প্রভাবশালীই হোক না কেন কেউ ছাড় পাবে না, যা বর্তমানে অসম্ভব। উল্লেখ্য, বছর পাঁচেক আগে এই জাকিউল ইসলাম ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালীন বিমানে তুচ্ছ ঘটনায় বড় দুটি আন্দোলন করে অচলাবস্থার সৃষ্টি করে পাইলটদের সংগঠন বাপা ও বর্তমান সিবিএ। পাইলটদের বয়সসংক্রান্ত একটি অফিস আদেশকে কেন্দ্র করে বাপা হঠাৎ আন্দোলনের ডাক দেয়। এতে গণহারে পাইলটরা অসুস্থ ঘোষণা করে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকে। এমনকি তারা হজ ফ্লাইটকেও জিম্মি করে ফেলেছিল। এ ঘটনার বছর দুয়েক পর সিবিএ নেতৃবৃন্দ আহার ভাতার মতো তুচ্ছ দাবি নিয়ে তুঘলকী কা- ঘটিয়ে ফেলে। হঠাৎ তারাও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সব অপারেশন বন্ধ করে দেয়। এতে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এ বিমানবন্দরে কোন ফ্লাইট ওঠানামা করতে পারেনি। রবিবার দুপুরে বলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার কর্মকর্তাদের মধ্যে দিনভর এটাই ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুুু। যদিও তখনও পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোন আদেশ বিমান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। সবার মুখেই ছিল একটি প্রশ্ন- কেন হঠাৎ সরকার এমন কঠোর হলো। গত চার দশক ধরে বহুবার এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা অত্যাবশ্যক ঘোষণার দাবি জানালেও সেটা কোন সরকার সাহস করেনি। বর্তমান সরকার কেনইবা হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে- জানতে চাইলে বিমানের এক পরিচালক বলেন, এটা বছর তিনেক আগে সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন আহমেদ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে বিমানকে অত্যাবশ্যক ঘোষণার দাবিসংবলিত একটি প্রস্তাবনা দেন। তখন প্রধানমন্ত্রী তাতে সায় দিলেও ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে সেটা বাস্তবায়নে ধীরনীতি কৌশল গ্রহণের পরামর্শ দেন। এ অবস্থায় গত বছর প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটের নাট ঢিলা হওয়ার ঘটনায় দেশ-বিদেশে তোলপাড় দেখা দেয়। তখন সিভিল এভিয়েশন, মন্ত্রণালয় ও বিমান থেকে তিনটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সিভিল এভিয়েশনের তদন্ত কমিটি তাদের বেশ কয়েকটি সুপারিশের মধ্যে শীর্ষে রেখেছিল বিমানকে অবিলম্বে অত্যাবশ্যকীয় সেবার আওতায় আনা। তারপরই হঠাৎ এ ঘোষণা আসে।
×