ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আয়বৈষম্যেই বিশ্বব্যাপী সহিংসতা বাড়ছে, যা শান্তির জন্য হুমকি

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৩ এপ্রিল ২০১৭

আয়বৈষম্যেই বিশ্বব্যাপী সহিংসতা বাড়ছে, যা শান্তির জন্য হুমকি

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ শান্তিতে নোবেলজয়ী মানবাধিকার কর্মী কৈলাস সত্যার্থী বিশ্বব্যাপী আয়বৈষম্য রীতিমত অর্থনৈতিক সহিংসতার রূপ পেয়েছে উল্লেখ করে বলেছেন, এই সহিংসতা মানব জাতির নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য হয়ে উঠেছে বড় ধরনের হুমকি। বিশ্বে প্রতিনিয়ত অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। কয়েক যুগ আগে যেখানে মালিক-শ্রমিক বেতন অনুপাত ছিল ২০ ঃ ১। এখন তা হয়েছে ২০০ ঃ ১। বর্তমানে বিশ্বের ৫০ ভাগ মানুষের সমপরিমাণ সম্পদ মাত্র ৮ ধনীর কাছে রয়েছে। এই বৈষম্যের কারণেই সহিংসতা বাড়ছে। যা বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ)-এর ১৩৬ তম সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উত্থাপনকালে তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, বিশ্ব কি এতই দরিদ্র যে শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাও নিশ্চিত করা যাবে না? প্রতিদিন গড়ে ৯ হাজার শিশু ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কারণে মারা যাচ্ছে। প্রকৃত অর্থে তারা মারা যাচ্ছে না, তাদের হত্যা করা হচ্ছে। তরুণদের সম্প্রতিক জঙ্গীবাদে ঝোঁকার প্রবণতার পেছনে তারুণ্যের শক্তি ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতাকে একটি উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, আজই সময়, এই ঢাকা থেকেই আমাদের শিশুদের জন্য কিছু করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সহানুভূতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার এখনই সময়। সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ‘সমাজের বৈষম্য নিরসনের মাধ্যমে সবার মর্যাদা ও মঙ্গল সাধন’-এর ওপর তিনি মূল প্রবন্ধ উত্থাপন করেন। সাধারণত মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় লিখিত বক্তব্য দেয়ার রেওয়াজ থাকলেও কৈলাস সত্যার্থী বিশ্বের ১৩১ দেশের আইনসভার সদস্যদের সামনে উপস্থিত বক্তব্য রাখেন। পরে বিষয়টির ওপর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন। ওই আলোচনায় বৈষম্যের কারণগুলো চিহ্নিত করে তা নিরসনে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। আইপিইউ সম্মেলনের সাধারণ অধিবেশন রবিবার সকাল নয়টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শুরু হয়। বেলা এগারোটায় মূল প্রতিপাদ্যের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হয়। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া এই আলোচনা চলাকালে আইপিইউ প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী ও সেক্রেটারি জেনারেল মার্টিন চুনগুং উপস্থিত ছিলেন। বিশ্বব্যাপী আয়বৈষম্যকে অর্থনৈতিক সহিংসতার বড় কারণ উল্লেখ করে কৈলাস সত্যার্থী বলেন, অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে সৃষ্ট এই সহিংসতা মানব জাতির নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য বড় ধরনের হুমকি। বিশ্বে ধনী- দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিশ্বের এক শ’ কোটি মানুষ এখনও দিনে দুই ডলার আয় করতে পারে না। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবস্থা দিনে দিনে আরও খারাপ হচ্ছে। ভারতের শিশু অধিকার কর্মী কৈলাস বলেন, আমরা যখন এই সম্মেলন করছি তখন ২৭০ মিলিয়ন শিশু স্কুলে যেতে পারছে না। ২১ মিলিয়ন মানুষ বিক্রি হয়ে শ্রমদাসে পরিণত হয়েছে। এটা মেনে নেয়া যায় না, সহ্য করা যায় না। তিনি বলেন, একদিকে এক শ’ মিলিয়ন শিশু দাসত্ব, পাচার ও শিক্ষাবঞ্চনাসহ বিভিন্ন সহিসংতার শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে এক শ’ মিলিয়ন তরুণ রয়েছে, যারা চাচ্ছে পৃথিবীকে বদলে দিতে। তাদের পৃথিবী বদলে দেয়ার শক্তি, ক্ষমতা ও আদর্শ আছে। এই তরুণদের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাদের। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীকে সুন্দর করতে তরুণদের শক্তি আছে, আদর্শ আছে, সম্ভাবনা আছে। আমরা যদি এই শক্তিকে কাজে লাগাতে না পারি, তবে তারা হতাশাগ্রস্ত, অসহিষ্ণু ও সহিংস হয়ে পড়বে। তরুণদের ক্ষমতা কাজে লাগানো গেলে এই পৃথিবী আরও আনন্দময় ও শক্তিশালী হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের দিকে ইঙ্গিত করে শান্তিতে নোবেল জয়ী কৈলাস সত্যার্থী বলেন, দক্ষিণ এশিয়াসহ পৃথিবীর কিছু অংশে তরুণরা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে। উগ্রবাদের পথ বেছে নিচ্ছে। বিশ্বের ২৩০ মিলিয়ন শিশু সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বসবাস করছে। তাদের জীবন ও শিক্ষা বিপদগ্রস্ত। তিনি বলেন, প্রতিদিন গড়ে ৯ হাজার শিশু ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কারণে মারা যাচ্ছে। প্রকৃত অর্থে তারা মারা যাচ্ছে না, তাদের হত্যা করা হচ্ছে। আড়াই লাখ শিশু পাচারের শিকার হচ্ছে। যৌথভাবে এর সমাধান আমাদের দায়িত্ব। বিপদগ্রস্ত শিশুদের বাঁচানোর জন্য বিশ্বের সকল দেশের সংসদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। সারাবিশ্বের জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সারা বিশ্বে শিশুরাই বাল্যবিবাহ ও শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। আপনাদেরও (এমপি) দাঁড়ানো উচিত। বিশ্বের সকল শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার জন্য মাত্র ২২ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। যা বিশ্বের সাড়ে তিনদিনের প্রতিরক্ষা বাজেটের সমান। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, আমাদের এই বিশ্ব কি এতই গরিব যে এই পরিমাণ অর্থ প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ব্যয় করতে পারব না? তিনি আরও বলেন, বাজেটে এই অর্থ বরাদ্দ করার দায়িত্ব আপনাদের (এমপিদের)। আমি আপনাদের সবার প্রতি আহ্বান জানাই, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় শিশুর জন্য যা বলা হয়েছে তা অর্জনের জন্য যার যার দেশে ফিরে কাজ করবেন। প্রয়োজনে আইন পাস করবেন। বাজেট বরাদ্দের উদ্যোগ নেবেন। এ সময় একটি উদ্যোগের কথা তুলে ধরে কৈলাস সত্যার্থী বলেন, বিশ্ব নাগরিকদের জন্য একটি নতুন সভ্যতা গড়তে হবে। তাই আমি আপনাদের সবাইকে আহ্বান জানাব, আমরা সকল নোবেল জয়ী একটা ক্যাম্পেন শুরু করেছি। ২০ সেপ্টেম্বর এমপিরা নিজ নিজ স্কুলে যান। আপনাদের স্কুলে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটান। আমরাও এই কাজটি করব। তিনি বলেন, আজই সময়, এই ঢাকাই স্থান, এখান থেকেই আমাদের শিশুদের জন্য কিছু করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সহানুভূতি নিয়ে সারাবিশ্বের শিশুর পাশে দাঁড়াতে হবে। প্রবন্ধে নারীর ক্ষমতায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এই নোবেল বিজয়ী। তিনি বলেন, যদি নারীকে আমরা সমভাবে ক্ষমতায়িত করতে পারতাম, তাহলে গত ৫ হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাসে অনেক সমস্যা আমাদের মোকাবেলা করতে হতো না। যা আমাদের এখনও করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কর্পোরেট নেতৃত্বের ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে এই ক্ষমতা মেলালে চলবে না। আপনারা কেবল জনগণ, ভোটার ও এলাকার জনপ্রতিনিধি নন, আপনারা লাখো প্রত্যাশা ও স্বপ্নের প্রতিনিধিত্ব করেন। আপনারা তাদের বিবেক এবং বিশ্বাসের রক্ষক। এটা বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ব শান্তির জন্য আপনাদের ভূমিকা রাখতে হবে। এই আলোচনায় অংশ নিয়ে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, সমাজে বৈষম্য নতুন বিষয় নয়। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে এই বৈষম্য চলে আসছে। এই বৈষম্য নিরসনে সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরী। তার আগে বৈষম্যের কারণগুলো চিহ্নিত করা দরকার। তিনি বলেন, সমাজে যেমন অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে নারী-পুরুষের বৈষম্য। এই বৈষম্যের কারণে বিপুল জনগোষ্ঠী পিছিয়ে পড়ছে। যা আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। সম্মেলনের সভাপতি আরও বলেন, আমাদের বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। আমাদের সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোও সেই পদক্ষেপ নিতে পারে। তবে কি পদক্ষেপ নেয়া হবে, সেটা সকলের আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে। আইপিইউ সম্মেলন আমাদের আলোচনার পথ তৈরি করে দিয়েছে। বৈষম্য নিরসনে আইপিইউ সম্মেলনের সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি। এই আলোচনায় নামিবিয়ার স্পীকার মার্গারেট মেনসা উইলিয়াম বলেন, বিশ্বে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। আমাদের সংসদ এসব বৈষম্য নিরসনে কাজ করছে। এছাড়া বর্তমান বিশ্বের ১৭ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও স্পীকার রয়েছে। পাশাপাশি ১৮ দশমিক ৩ ভাগ মন্ত্রী-এমপি নারী। অথচ বিশ্বায়নের এই যুগে নারীদের প্রতিনিধিত্ব যে জায়গায় থাকার কথা ছিল, তার থেকে এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছি। তিনি আরও বলেন, যেসব দেশে সংসদের স্পীকার নারী তাদের এই ক্ষেত্রে কাজ করার অবারিত সুযোগ রয়েছে। তারা সংসদে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া শিশু ও নারীদের উৎসাহিত করতে পারেন। তিনি আরও বলেন, নারীরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হয়ে উঠলেও এখনও আর্থিকভাবে তত বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেনি। কারণ এখনও সাধারণ নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেক কম আয় করে থাকেন। তবে, গৃহস্থলীর কাজে অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছেন নারীরা। এতো কিছুর পরও নারীদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসতে হলে অবশ্যই শক্তভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। এসকল পদক্ষেপ জেন্ডারবৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। অষ্ট্রেলিয়ার তরুণ পার্লামেন্টারিয়ান আর ব মিথি বলেন, সমাজের সকল ধরনের অসমতা কমাতে হলে শিক্ষার মাধ্যমে আমরা এই কাজে যুব-সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। যেখানে তারা বিশ্বের মানবাধিকার উন্নয়নে কাজ করতে পারে। পাশাপাশি নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য কমাতে চাকরির ক্ষেত্রে সমান সুযোগ রাখতে হবে। এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার জন্য সম্মেলনে অংশ নেয়া প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানান। উল্লেখ্য, ১৬৪ দেশের আইনসভার সংগঠন আইপিইউ’র পাঁচ দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন গত শনিবার থেকে রাজধানী ঢাকায় শুরু হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম বৃহৎ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ১৩১ দেশের ৫৩ স্পীকার, ৪০ ডেপুটি স্পীকার, পার্লামেন্ট সদস্যসহ ১৫ শতাধিক প্রতিনিধি অংশ নিচ্ছেন।
×