ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইউজেনি ইয়েভতুশেঙ্কো ॥ বিদায় রাশিয়ার শব্দ সিংহ

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ৩ এপ্রিল ২০১৭

ইউজেনি ইয়েভতুশেঙ্কো ॥ বিদায় রাশিয়ার শব্দ সিংহ

ইউজেনি ইয়েভতুশেঙ্কো (Yevgeny Yevtushenko) কেবল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবিই নন, ছিলেন অভিনেতার ক্যারিশমা আর সহজাত রাজনৈতিক চেতনা থেকে কবিতার প্রথাবিরোধী। তার উচ্চারণ রাশিয়ার তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ঠা-া যুদ্ধের সময় স্ট্যালিনবিরোধী যুদ্ধে। তিনি আর নেই। ৮৩ বছর বয়সে থেমে গেছে এই প্রতিবাদী কলমযোদ্ধার কলম। যিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘মুক্ত রাশিয়ার’ স্বপ্নদ্রষ্টাদের প্রতীক। শনিবার ওকলার তুলসায় কবি গ্রহণ করেছেন তার শেষ শ্বাসটি। যেখানে দীর্ঘদিন ধরে তিনি শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিখাইল মরগুলিম তাস সংবাদ সংস্থাকে জানান, শুক্রবার গুরুতর অসুস্থতার জন্য কবিকে হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর সময় পাশে ছিলেন কবিপতœী মারিয়া নোভিকোভা আর তাদের দুই পুত্র ডিমিদ্রি ও ইয়েভগেনি। ইয়েভতুশেঙ্কোর নিজস্ব ভঙ্গিতে আবৃত্তি করা প্রতিবাদী কবিতা পাবলিক স্কয়ার, স্টেডিয়াম কিংবা লেকচার হলে ঝড় তুলেছে হাজারো অনুরাগীর মন। তিনি তার কবিতায় ধারণ করেছেন সেই বিভ্রান্ত সময়ে রাশিয়ার তারুণ্যের আশা, হতাশা, ভয় ও ক্ষোভ। ধারণ করেছেন ১৯৫৩ সালে যোসেফ স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর সারাদেশ যখন ধুঁকছিল দমন-পীড়ন থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষায় সেই সময়কে। ১৯৬১ সালে ইয়েভতুশেঙ্কো একাই করেছেন ২৫০টি প্রতিবাদী কবিতা পাঠের আসর। ধূসর চুলের এই রাশিয়ান শব্দ সিংহ শেষ জীবনে অধ্যাপনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইউনিভার্সিটি অফ তুলসায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ার আগে ও পরে উপভোগ করেছেন প্রবাদপ্রতিম জনপ্রিয়তা। সুঠামদেহী লম্বা এই সার্বিয়ান তরুণ শৈল্পিক রাজনৈতিক কবিতা নিয়ে বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যে নিজের ঠাঁই করে নেন দাপটের সঙ্গে। তিনি সেই ক্ষুদ্র দলের সবচেয়ে পরিচিত মুখ যিনি তরুণ প্রজন্মের মনে তার কবিতায় আশা যুগিয়েছেন সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক নেতৃত্ব একদল আদর্শিক উন্মাদ আর ভীরু ব্যুরোক্রেটসের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামে। পাশে পেয়েছেন এন্ড্রেই ভোজনেসেনঙ্কি, রবার্ট রোহডেস্টভেনসকি এবং তার প্রথম স্ত্রী বেলা আখমাডুলিনা। ইয়েভতুশেঙ্কো তার বেশিরভাগ কাজ করেছেন সিস্টেমের মাঝে। সাহিত্যে সরাসরি সংঘাত তিনি এড়িয়ে গেছেন, আয়তনে সংক্ষিপ্ত বাক্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রতিরোধের বাণী। আর সে কারণেই একজন ভিন্নমতাবলম্বীর চেয়ে তাকে এক স্পর্ধিত ক্রুব্ধ ব্যক্তি বলে বিবেচনা করেছে সরকার। আর একটা মাত্রা পর্যন্ত তিনি উপভোগ করেছেন সরকারী অনুমোদন। যখন অন্যদের জুটেছে নির্বাসন কিংবা শ্রম শিবিরের শাস্তি, ইয়েভতুশেঙ্কো পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। নিয়ন্ত্রণের মাঝেও নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে তার বই। অনুমোদন ছিল বিদেশ ভ্রমণের। আর এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক সাহিত্য তারকা। অনেক সমালোচকই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তার লড়াইয়ের আন্তরিকতা নিয়ে। কারও ধারণা তাকে বিশ্বাস করা যায় না। প্রতিপক্ষ এমনকি এও বলতেন তার সবটাই ছিল অভিনয়। আসলে তিনি কাজ করেছেন সিকিউরিটি পুলিশ বা কমিউনিস্ট কর্তৃপক্ষের হয়ে। নির্বাসিত কবি যোসেফ ব্রডস্কি তার সম্পর্কে বলেন, ‘ইয়েভতুশেঙ্কো কেবল সে দিকেই পাথর ছোড়েন কর্তৃপক্ষ তাকে যতটুকু অনুমোদন দেয়। আর ইয়েভতুশেঙ্কোর অনুরাগীরা এ ধরনের সমালোচনার জবাবে মনে করিয়ে দেন স্ট্যালিন জামানায় তার প্রতিবাদী ভূমিকার কথা। আর ১৯৩০-এ তার পূর্ব পুরুষের ওপর স্ট্যালিনের অত্যাচার। ১৯৫৬ সালে ইয়েভতুশেঙ্কো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন ভøাদিমির ডুডিন্টসেসের ‘নট বাই ব্রেড এলোন’ নামক নিষিদ্ধ উপন্যাসের সমর্থনে বিক্ষোভ করায়। ১৯৫৮ সালে নোবেলজয়ী বরিস পাস্টেরনাকের ‘ডক্টর জিভাগো’ বিরোধী অফিসিয়াল প্রচারণায় অংশ নিতে তিনি অসম্মতি প্রকাশ করেন। ১৯৬৮ সালে চেকোসেøাভাকিয়ায় আগ্রাসনের প্রকাশ্য নিন্দা জানান। কেজিবি প্রধান ইউরিভি অ্যানড্রোপভের সঙ্গে মধ্যস্থতা করেন আরেক নোবেল বিজয়ী আলেক্সান্ডার সোলঝেনেৎস্কির পক্ষ হয়ে। ১৯৭৯ সালে তীব্র প্রতিবাদ জানান আফগানিস্তানে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের। তিনি একবার নিজেই স্বীকার করেছেন তার হাজারো কবিতার মাঝ থেকে সম্ভব হলে তিনি কিছু বাদ দিতেন। অনেক সমালোচকই তার কাজের সাহিত্যমান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অনেকেই উপহাস করেন তার জাঁকজমকপূর্ণ জীবন নিয়ে আর ক্রুদ্ধতার সাফল্যে। কিন্তু তার বন্ধু আর শত্রু সবাই স্বীকার করতে বাধ্য তার কিছু কবিতা রাশিয়ান সাহিত্যের সেরা নিদর্শন হয়ে টিকে থাকবে অনন্তকাল। জটিল সময়ে ইয়েভতুশেঙ্কোর স্বরচিত কবিতা পাঠ যেমন, ‘স্ট্যালিন হেরিজ’ তুলে ধরেছে পরিবর্তনকামী এক জাতির আত্মার বাণী। রাশিয়া এমন এক দেশ যেখানে একজন লেখক সময়ে রাজনৈতিক শীর্ষ নেতার চাইতে অনেক প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেন। আবার হতে পারেন হুমকির মুখোমুখি যেমনটা হয়েছে পাস্টেরনাকের। ‘ডক্টর জিভাগো’ আর ‘সোলঝেনেৎস্কির দ্য গুলাগ আর্চিপেলাগো’র বেলায়। আলেকজান্ডার রুডলফডিক গাংগাস আর জিনাইডা ইয়েভতুশেঙ্কো দম্পতির পুত্র পিতামাতার বিচ্ছেদের পর গ্রহণ করেন মায়ের পদবি। জন্ম ১৮ জুলাই ১৯৩৩ ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের জিমা জংশনে। শৈশব কেটেছে মায়ের সঙ্গে মস্কোতে। কিন্তু ১৯৪১ এর শেষে জার্মান বাহিনী মস্কো আগ্রাসন শুরু করলে তার পরিবার ফিরে যায় জিমায়। ১৯৪৪ পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান। খেলাধুলার প্রতি ছিল প্রবল আসক্তি কিন্তু সেপথে বেশি দূর যাওয়া হয়নি। হঠাৎ জোটা সাহিত্য খ্যাতির কারণে এগিয়ে চলে সাহিত্যে পথচলা। স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর একবার মরতে বসে ছিলেন শোক মিছিলে পদদলিত হয়ে। তার পূর্ব থেকেই তার কাজে ফুটে উঠছিল সোভিয়েত বাস্তবতার বিরূপ চিত্র। তিনি ভেঙ্গে দেন নিয়ন্ত্রিত শৈল্পিক ধারণা। ব্যক্তি এবং রাষ্ট্র নিয়ে নতুন চিন্তার প্রতিফলন ঘটে তার লেখায়। বছরের পর বছর তার লেখায় এসেছে রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী চরিত্র আর ভীতির শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু প্রতিবাদ প্রতিরোধ নয় ব্যক্তি আবেগও উঠে এসেছে তার দীর্ঘ কবিতা ‘জিমা জংশনের’ মতো রচনায়। ১৯৫০ এর শেষের দিকে প্রকাশিত হয় তার সাত খ-ের কবিতার বই এবং তিনি অনুমতি পান বিদেশ ভ্রমণের। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন পূর্ব-পশ্চিম ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কিউবা, পূর্ব আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ায়। তাকে ঘিরে প্রবাদের শুরুটা যখন টাইম ম্যাগাজিন ১৯৬২ সালের এপ্রিলে কভার স্টোরি করে ‘এ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ শিরোনামে যেখানে তাকে উপস্থাপন করা হয় পরিবর্তনকামী রাশিয়ার প্রতীকরূপে। আর ইয়েভতুশেঙ্কো নিজেও স্বীকার করেন মার্কিন সাহিত্য তাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরও যখন ক্রেমেলিনে প্রবল ইহুদিবিদ্বেষ তখনও তিনি মানবিক বিবেচনায় দাঁড়িয়েছেন তাদের পাশে। কিয়েভ ইউক্রেনে এক ইহুদি বধ্যভূমি পরিদর্শন শেষে তিনি লিখেন বিখ্যাত কবিতা ‘বাবি ইয়ার’ যা কেবল মানবিক আবেদন নিয়ে রাশিয়ানদেরই চমকে দেয়নি সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেখানে তিনি বলেন, ‘বাবি ইয়ারে আজ নেই কোন সমাধি।’ যার মাঝে তিনি উচ্চারণ করেন ‘আজ আমার মনে হয়/আমি নিজেও একজন ইহুদি’। তার বাবি ইয়ার আঘাত করে ক্ষমতার কেন্দ্রে, মুখোমুখি হয় নিষেধাজ্ঞার। কিন্তু যখনই ইয়েভতুশেঙ্কো জনসম্মুখে কবিতাটি আবৃত্তি করেছেন জনতা গভীর নীরবতায় একাত্ম হয়েছে সে বেদনার সঙ্গে। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, ১৯৮০ পর্যন্ত ইউক্রেনে তিনি এ কবিতা পাঠের অনুমতি পাননি। তার ‘স্ট্যালিন হেরিজ’ ১৯৬২-তে এমন এক সময় প্রকাশিত হয় যখন সমগ্র রাশিয়া সর্বগ্রাসী স্ট্যালিনীয় শাসন ফিরে আসার আতঙ্কে ভুগছে। যার শেষে তিনি সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেনÑ ‘আমরা তাকে অপসারণ করতে পারি সমাধিস্তম্ভ থেকে/কিন্তু স্ট্যালিনবাদের ধারকদের মাঝ থেকে তাকে অপসারণ করব কি করে?’ ইয়েভতুশেঙ্কোর রচনা যে কেবল রাজনীতি আর সামাজিক প্রতিরোধের অস্ত্র ছিল তা নয়। পাশাপাশি তিনি লিখেছেন প্রেম, প্রকৃতি, শিল্প, ভ্রমণ আর ছুঁয়ে গেছেন জীবনের আনন্দ-বেদনা। ১৯৫৬-তে বেলা আখমাডুলিনার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সময় তার ব্যক্তিগত অনুভূতির রচনা ‘মাই বিলাভড উইল কাম’ যাতে তিনি লিখেন, ‘আমার প্রিয় আসবে/জড়িয়ে নেবে আমায় তার বাহুতে/সে বুঝবে আমার বদলে যাওয়া/আমার ভয়’। জীবনের বিচিত্র পথে হেঁটেছেন তিনি। কবিতা তাকে জগতে জোড়া খ্যাতি দিলেও নিজেকে তিনি দাবি করতেন কবি, লেখক, চিত্র নির্মাতা। তার লেখা অনূদিত হয়েছে নানান ভাষায়। দুটি ছবি পরিচালনার পাশাপাশি অভিনয় করেছেন অসংখ্য ছবিতে। রচনা করেছেন দুটি উপন্যাস। বরিস ইয়েলৎসিন তাকে লিখেন ‘আপনার বাণী আমাদের দিয়েছে আত্মিক মুক্তি, আর জাগিয়ে তুলেছে রাশিয়ার জনতাকে মুক্তির দাবিতে’। শিল্প নিয়ে তর্কে জড়িয়েছেন ক্রুশচেভের সঙ্গে। বিশ্বজুড়ে ঘটে চলা প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় তার মতামত ছিল স্পষ্ট। সম্মান জানিয়েছেন আততায়ীর হাতে নিহত রবার্ট এফ কেনেডি আর ড. মার্টিন লুথার কিংয়ের প্রতি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে নিহত এলিসন ক্রাউসের কথা বলেছেন। জন স্টেইনবেকের মতো লেখককে তীব্র তিরস্কার করেছেন যুদ্ধবিরোধী অবস্থান না নেয়ায়। ছিলেন গ্লাসনস্তের একনিষ্ঠ সমর্থক। ছিলেন সুপ্রীম সোভিয়েতের নির্বাচিত প্রতিনিধি। ১৯৯১ সালের চক্রান্তকারীদের ক্যুর বিরুদ্ধে মুখ খোলেন প্রকাশ্যে। রাষ্ট্র তাকে সম্মানিত করেছেন ‘মুক্ত রাশিয়ার রক্ষক’ পদকে। তার আলোচিত উপন্যাস ‘মৃত্যুর আগে মরো না’র জন্য। তার সম্পর্কে এটাই বোধকরি শেষ কথা তিনি প্রকৃত মৃত্যুর আগে মরায় বিশ্বাস করতেন না সে প্রমাণ তিনি দিয়ে গেছেন নিজ জীবনে। সবকিছুর পরও তিনি নিজেকে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক বলেই বিবেচনা করতেন। তার ‘ডোন্ট ডাই বিফোর ডেড’ -এ তিনি তুলে এনেছেন বিলুপ্ত সোভিয়েত ব্যবস্থায় তার পরস্পরবিরোধী মানসিক অবস্থা। যার শেষে তিনি লেখেন- বিদায় লাল পতাকা তোমায়- আমি জারের উইন্টার প্যালেস দখল করিনি, আমি হিটলারের রাইখস্ট্যাগ জয় করতেও যাইনি, আর তোমরা যাকে বল ‘কমি’ তাও নই আমি। কিন্তু আমি ভালবাসি প্রিয় লাল পতাকা Ñএবং কাঁদি এর জন্য। Ñনিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত সংবাদ নিবন্ধের ভিত্তিতে রচিত
×