মনীষী বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ সম্পর্কে আমাদের সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খান, কবি শামসুর রাহমান, অর্থনীতিবিদ ডক্টর আবু মাহমুদ, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ছাড়াও অনেক বরেণ্য ব্যক্তি লিখেছেন, স্মৃতিচারণ করেছেন, তার বিপুল অবদানের মূল্যায়ন করেছেন এখানে যতটুকু উদ্ধৃতি দেয়া হলো, আশা করা যায় বড় মাপের এই মানুষটি সম্পর্কে অন্তত কিছুটা হলেও ধারণা করা যাবে।
১৯১১ সালের ১ জানুয়ারি তার জন্ম। তার পিতা সৈয়দ আবদুল মালেক ছিলেন সরকারী কর্মচারী। তিনি বগুড়া ও দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। মা শেরে বাংলার বোন আফজালুন্নেছা। মেধাবী এবং পরিশ্রমী ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৯২৬ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং রাজশাহী বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। ওই একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এলএলবি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী লাভ করেন। তিনি বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যান এবং সে সময় ভারতীয়দের মধ্যে পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থান লাভ করেন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল ধারার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। চল্লিশের মাঝামাঝি সময়ে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে যোগদান করেন এবং সমাজসেবামূলক কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ক্যাবিনেট মিশনের ব্যর্থতা, উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তৃতিতে তিনি খুবই মর্মাহত হন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য যারা উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে যুক্ত হন; নেহরু-লিয়াকত চুক্তি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ’৫৪-এর নির্বাচনে ও ২১ দফা কর্মসূচী প্রণয়নে তার ছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ১৯৫৪ সালেই তিনি ঢাকা হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা এ জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। তিনি প্রধান বিচারতি থাকাকালে নিম্ন আদালতের উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১৯৬১ সাল। দেশে সামরিক শাসন চলছে। সেই সময় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা ছিল একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তখন তিনি সভাপতির গুরুদায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে এসেছিলেন। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রফেসর খান সারওয়ার মুরশিদ। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এই ব্যক্তিত্ব এক পর্যায়ে নিজেই পদত্যাগ করে বেরিয়ে আসেন প্রধান বিচারপতির উচ্চপদ থেকে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের কৌঁসুলি টম উইলিয়ামের উপদেষ্টা হন। ’৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানেও তিনি রাজনীতিবিদদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন এবং গোলটেবিল বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী শাসকরা শত চাপ সৃষ্টি করেও তাকে শান্তি কমিটির সদস্য বানাতে পারেনি বা তার কাছ থেকে এমন বক্তব্য বের করতে পারেনি, যা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ব্যবহার করা যেত। কিছুটা ভগ্ন স্বাস্থ্যজনিত কারণে, কিছুটা সে সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দরুন এই তেজস্বী পুরুষ নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন। তবু গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার থেকে তিলমাত্র বিচ্যুত হননি। আন্তর্জাতিক বিচারকম-লীর সদস্য হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। জাতিসংঘের মহাসচিব তাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিচারকদের একজন বলে সমীহ করতেন। ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বিস্মৃতিপরায়ণ এই সমাজের জন্য, মূল্যবোধের এই প্রবল সঙ্কটের সময় বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের মতো ব্যক্তিত্বের বড় প্রয়োজন ছিল। তিনি রেখে গেছেন তার মূল্যবান বক্তৃতা, প্রবন্ধ, তিনি রেখে গেছেন দার্শনিকতায় সমৃদ্ধ বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলার রায়- যা মেধায়, প্রজ্ঞায়, বিচক্ষণতায়, আইনের ব্যাখ্যায় আমাদের মূল্যবান সম্পদ বলে বিবেচিত। এসব গ্রন্থভুক্ত হলে সমাজ সম্পদশালী হতো। তার মতো বিরল ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ জীবনী রচিত হওয়া উচিত সমাজের স্বার্থে। তার মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। লেখক : কবি