ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়

ভারতে সাম্প্রতিক ভোট ও হাসিনার আসন্ন সফর

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ৩ এপ্রিল ২০১৭

ভারতে সাম্প্রতিক ভোট ও হাসিনার আসন্ন সফর

রং দে তু মোহে গেরুয়া- বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খানের ছবি দিওয়ালের এই গান এখন পুরো উত্তর ভারতের মহল্লায় মহল্লায় বাজছে। গেরুয়া ঝড় উঠেছে যে। পাঁচ রাজ্যে সদ্য সমাপ্ত ভোটের ফল বলছে ভারতীয় জনতা পার্টির গেরুয়া পতাকা উড়ছে আরব সাগর পারের গোয়া থেকে সুদূর পূর্বের মণিপুরে। রাজনৈতিক দিক দিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য উত্তরপ্রদেশেও চলছে গেরুয়া ঝড়। আর সেই ঝড়ে সাম্প্রতিক ভোটে খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছে রাজ্যের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সমাজবাদী পার্টি বা রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বহুজন সমাজ পার্টি। অবস্থাটা এমনই যে, সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে নির্বাচনে গাঁটছড়া বেঁধেও কংগ্রেস ভোটের বৈতরণী পার হতে পারেনি। পরিস্থিতি যা তাতে বিজেপি উত্তরপ্রদেশ আর তার উত্তরের পড়শি উত্তরাখণ্ডে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিজেপি তো পেয়েছেই, স্থানীয় দলগুলোর হাত ধরে গোয়া আর মণিপুরের মসনদও দখল করেছে। কংগ্রেস একমাত্র পাঞ্জাব দখল করতে পেরেছে। মানে সোজা কথায় আসমুদ্র হিমাচলে আপাতত নরেন্দ্র দামোদারদাস মোদির হাজার মাইলের মধ্যে রাজনৈতিক ধারে ও ভারে কেউ নেই। বাংলা, উড়িষ্যা, বিহার, কেরল, তামিলনাড়ু আর কর্ণাটক বাদে গুরুত্বপূর্ণ সব রাজ্যেই গৈরিক পতাকা উড়ছে। অন্ধ্র আর তেলেঙ্গানায় তো সহযোগী দল ক্ষমতায়। যে উত্তর-পূর্ব ভারত দুইদিক থেকে বাংলাদেশকে ঘিরে রেখেছে তারও তিন তিনটে রাজ্যে এখন গেরুয়া পতাকা উড়ছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিকভাবে এত ক্ষমতাশালী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরে সাম্প্রতিককালে ভারত দেখেনি। আর এর ফলে শুধু যে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে তাই নয়, পড়শি দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্কে ছাপ পড়বে। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী হওয়ার বিষয়টা একটু খুলে বলা যাক। এমনিতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। কিন্তু সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এখনও মোদির দল সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোটে বিপুল জয়ের পর অঙ্ক কষে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, রাজ্যসভায় আরও অন্তত ১০ জন প্রার্থীকে বিজেপি জিতিয়ে আনতে পারবে। ফলে রাজ্যসভাতেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার ম্যাজিক সংখ্যাটা ছুঁয়ে ফেলবে বিজেপি। ফলে এখন যেরকম প্রতিটা বিল রাজ্যসভায় পাস করতে কালঘাম ছুঁটে যাচ্ছে বিজেপির, সেই দমবন্ধকর পরিস্থিতি থেকে বেরোতেও পারবে দল। রাজনৈতিকভাবে আপাতত আরও একটা বড় সুবিধা পেতে যাচ্ছে বিজেপি। কয়েক মাস বাদেই রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বিদায় নিচ্ছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা আর বর্ধিত বিধায়ক সংখ্যাকে মূলধন করে বিজেপি এবার নিজের পছন্দের প্রার্থীকে রাইসিনা হিলে বসাতে পারবে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বও ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনে জয় সম্পর্কে এক রকম নিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তাই এখনই ২০২৪ পর্যন্ত দেশের অর্থনীতি চালানোর রূপরেখা তৈরির ভাবনা-চিন্তা শুরু করার কথা বলাও হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পদে সরাসরি বিজেপির মূল চালিকাশক্তি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর দুই প্রচারককে বসানোর মধ্যেও মোদির সেই আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলনকেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ব্যক্তিগতভাবে মোদির জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ার যে কোন লক্ষণ নেই তাও এই সাম্প্রতিক ভোট চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এর আগে বিহার নির্বাচনে বিরোধীরা সমঝোতা করে মহাজোট গড়ায় বিজেপি ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। সেই সাফল্য মাথায় রেখেই উত্তরপ্রদেশেও ক্ষমতাসীন সমাজবাদী পার্টি আর সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সমঝোতা করে। একপ্রস্থ পারিবারিক বিবাদের পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবকেই নেতা হিসেবে ভোটযুদ্ধে নামানো হয়। অন্যদিকে বিজেপির মুখ্য মুখ সেই মোদিই। আর মোদিও নির্বাচনী প্রচারে সারা উত্তরপ্রদেশ চষে ফেলেছেন। দিল্লীতে গত আড়াই বছরে তাঁর সরকারের কাজ সামনে এনেছেন। নির্বাচনী প্রচারে তাঁর কিছু বক্তব্যকে নিয়ে বিরোধীরা তুমুল শোরগোল করলেও ভোটের ফল বেরোলে দেখা গেল সেই মোদি ম্যাজিকের ওপর ভর করেই ৪০৩ আসনবিশিষ্ট উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় বিজেপি অনায়াসে ৩০০ পার করে দিয়েছে। ভোটের আগে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনকে বলা হয়েছিল ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে শেষ বড় কোন জনগণের রায়দান। তাই এই ভোটকে সেমিফাইনালের তকমাই দিয়ে দেয় প্রচার মাধ্যম। ভোটের ফলে দেখা যাচ্ছে হাসতে হাসতে সেই ম্যাচ জিতে বেরিয়ে গিয়েছে ব্র্যান্ড মোদি। ফলে গেরুয়া শিবির এখন জোর গলায় দাবি করছে, সাধারণ মানুষ তো মূলত ওই মুখকে মনে রেখেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এর বোতামে হাত দিয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এই আত্মবিশ্বাস প্রতিফলিত হতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক এই পাঁচ রাজ্যে ভোটের আগেই প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ ঘোষণা করলেন সেই রাতেই ১২টার পর থেকে ৫০০ টাকা আর ১০০০ টাকার নোট বাতিল করার কথা। বললেন, দেশের বিপুল বেআইনী আয় অর্থাৎ কালো টাকা খুঁজে বের করতেই এই পদক্ষেপ। প্রায় পাঁচ মাস বাদে কালো টাকা কতটা সত্যিই উদ্ধার করা গিয়েছে তা নিয়ে নানা মহলে হাজারও প্রশ্ন থাকলেও যেটা প্রশ্ন নেই তা হলো দেশের অর্থনীতির ডিজিটালাইজেশনের মাপকাঠিতে এক লাফে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া। আর্থিক স্বচ্ছতার পক্ষে যা অত্যন্ত জরুরী। বাজারে টাকার যোগান কমে যাওয়ায় অর্থনীতিবিদদের একাংশ দেশের সমৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার আশঙ্কাও করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী আর্থিক পরিসংখ্যান দেখিয়েছে যতটা ক্ষতি হবে বলে ভাবা হয়েছিল তার ধারেকাছেও যায়নি। ফলে গৈরিক বাহিনী যখন পাঁচ রাজ্যের ভোটের দামামায় নোট বাতিলকেই অন্যতম প্রধান ইস্যু করল আর বিপুল জয় নিয়ে বেরোল, তখন এটা অস্বীকার করা কঠিন যে, মোদির এই পদক্ষেপের পেছনে জনমানুষের একটা বড় অংশের সায় নেই। অথচ উত্তরপ্রদেশে নোট বাতিলের ইস্যুটাই বিজেপির বুমেরাং হওয়ার আশায় বুক বেঁধেছিলেন অখিলেশ যাদব-রাহুল গান্ধী জোট। আর ডিজিটাল ভারত গড়ার যে ডাক মোদি দিয়েছেন তাতেও কিন্তু ভালই সাড়া মিলেছে। মাঝারি আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে। পাড়ার চায়ের দোকানের সামনে পর্যন্ত ডিজিটাল পদ্ধতিতে দাম মেটানোর বোর্ড ঝুলছে। মাছ, মাংস, ডিম, তরিতরকারি, ফল, ফুলের মতো ক্ষুদ্র খুচরো বিক্রেতা থেকে শুরু করে বড় বড় চকচকে বিপণি- সবাই ডিজিটাল লেনদেনের রাস্তায় হাঁটা শুরু করেছেন। এই প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও অন্যথা হয়নি। তবে সমস্যা কি নেই? একশ’বার আছে। শহরতলী এলাকা থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগের অভাব রয়েছে ভালমতোই। ফলে ইচ্ছা থাকলেও জনগণের একটা বড় অংশ ডিজিটাল জমানায় পা রাখতে পারছে না। তবে দেশজুড়ে মোবাইল সংযোগ যেরকম দ্রুতগতিতে বাড়ছে তাতে এই খামতিও কিন্তু বেশিদিন থাকার কথা নয়। দেশের টেলিযোগাযোগ ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অব ইন্ডিয়া বা ট্রাইয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে দেশে প্রায় ১১৩ কোটি মোবাইল সংযোগ রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ২২ কোটি মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হয়। শহর এবং গ্রামের মোবাইল সংযোগের মধ্যেও আসমান-জমিন ফারাক আর নেই। মোট মোবাইল টেলিসংযোগের ৫৮.৭৭% যেখানে রয়েছে শহরাঞ্চলে, সেখানে গ্রামাঞ্চলে রয়েছে ৪১.২৩%। অবশ্য প্রতি ১০০ জন পিছু টেলিসংযোগের মাপকাঠিতে (পরিভাষায় যাকে টেলি ডেনসিটি বা টেলি ঘনত্ব বলে) গ্রাম এখনও শহরের কাছে বেশ কয়েক গোল খেয়ে বসে আছে। টেলি ঘনত্বের মাপকাঠিতে শহর যেখানে ১৬৫.০৪, গ্রাম পড়ে রয়েছে ৫২.৮৪-এ। অন্যভাবে বললে প্রতি ১০০ জন পিছু শহরে রয়েছে ১৬৫.০৪ সংযোগ, গ্রামে রয়েছে ৫২.৮৪ সংযোগ। কিন্তু এটাও সম্পূর্ণ ছবি নয়। যে অবিশ্বাস্য গতিতে ভারতের গাঁয়ে-গঞ্জে টেলিসংযোগ বাড়ছে তা এক কথায় অভূতপূর্ব। ২০১৩ সালের নবেম্বরের শেষে ট্রাই পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, দেশে তখন ৮৮ কোটি মোবাইল সংযোগ ছিল। অর্থাৎ গত ৩ বছরে ভারতে ২৫ কোটি মোবাইল সংযোগ বেড়েছে বা বছর পিছু ৮ কোটিরও বেশি। অন্যভাবে বললে ডিজিটাল ভারত গড়ার উপযুক্ত পরিকাঠামো মোদি সরকারের তো হাতে এসেই গিয়েছে। অন্য আর্থিক সংস্কার যেটা দিল্লীর বর্তমান ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক এ্যালায়েন্স (এনডিএ যার বড় শরিক বিজেপি) সরকার রূপায়ণ করতে চলেছে তা হলো পণ্য ও পরিষেবা কর (গুডস এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স বা জিএসটি)। আগামী ১ জুলাই থেকে সারা ভারতে এই পরোক্ষ কর চালু করার কথা। বিগত কংগ্রেসি সরকারের এই মানসপুত্র নিয়ে অবশ্য বর্তমান অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি তো একেবারে উচ্ছ্বসিত। কেউ যখন কোন জিনিস বা পরিষেবা কেনেন তাকে এক গাদা পরোক্ষ কর দিতে হয়। জিএসটি চালু হলে অনেক পরোক্ষ করই জিএসটির সঙ্গে মিশে যাবে। বহুকাল আগে অর্থনীতিবিদ নিকোলাস ক্যালডর আয়কর তুলে দিয়ে এক্সপেন্ডিচার ট্যাক্স বা ব্যয় কর চালু করার সুপারিশ করেছিলেন। ৫০-এর দশকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রথিতযশা অর্থনীতির অধ্যাপককে ভারতীয় কর ব্যবস্থা সংস্কারের সুপারিশ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জমানার সবচেয়ে নামজাদা অর্থনীতিবিদদের অন্যতম ক্যালডর যে ব্যয় কর সুপারিশ করেন তার মোদ্দাকথা হলো সাধারণ মানুষ আসলে তার উপার্জনের ওপর দু’বার কর দেয়। উপার্জিত আয়ের ওপর একবার আয়কর দিয়েই সে রেহাই পায় না, আয়কর দেয়ার পর বাকি টাকার অংশ দিয়ে পণ্য বা পরিষেবা কেনার সময়ও একাধিক পরোক্ষ করের আওতায় পড়ে। অত্যধিক কর চাপালে তা কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতার জন্ম দেয় এই যুক্তি দেখিয়ে ক্যালডর বলেন, অন্য সব বেশিরভাগ কর তুলে দিয়ে ব্যয় কর চালু করলে সাধারণ করদাতা যেমন অত্যধিক করের বোঝার হাত থেকে বাঁচে, তেমনি দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে সরকারের কোষাগারেও কর বাবদ অনেক বেশি অর্থ জমা হয়। কারণ, কোন মানুষের ক্রয়ক্ষমতাই তার সঠিক আর্থিক ক্ষমতার ধারণা দিতে সক্ষম। তাই অনেক সময়ই আয়কর যথাযথভাবে কর আদায় করতে পারে না। বস্তুত, জিএসটিকে ষাট বছর আগেকার সুপারিশের দিকে যাওয়ার প্রথম ধাপ বলা যেতেই পারে। এখানে একটা ছোট্ট অথচ আকর্ষণীয় তথ্য রয়েছে। ক্যালডরের কাজে বিশ্বের যেসব তাবড়-তাবড় অর্থনীতিবিদ প্রভাবিত হয়েছিলেন তার মধ্যে মোদির পূর্বসূরি মনমোহন সিংও রয়েছেন। বস্তুত মনমোহনের আমলেই জিএসটির সলতে পাকানোর কাজটা শুরু হয়। ফলে মোদ্দাকথা, রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাসের অক্সিজেন পাওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা আনার প্রয়াসও যে জোরকদমে শুরু হয়েছে। আর এই আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন এবার দেখা যেতে পারে পড়শিদের সঙ্গে সম্পর্কেও। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে অর্থনৈতিক মডেল বলে কোন দেশ আর্থিক দিক থেকে সমৃদ্ধ হলে তার আশপাশের দেশগুলোও সেই সমৃদ্ধির সুফলের ভাগ পায়। অন্যদিক দিয়েও ভারত-বাংলাদেশের আসন্ন শীর্ষ বৈঠকের সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে দেশে রাজনৈতিকভাবে মোদি এতটা শক্তিশালী কখনই ছিলেন না। পাশাপাশি যোগ হয়েছে ডিজিটাল ভারত আর জিএসটির মতো প্রযুক্তিগত ও আর্থিক পদক্ষেপ। ফলে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে মোদি জমানা যে পূর্ববর্তী কংগ্রেসি জমানার মতো অত দ্বিধাগ্রস্ত হবে না সেটা বলাইবাহুল্য। মনমোহন জমানার মতো সব সময় শরিকদের মন যুগিয়ে চলার বাধ্যবাধকতা মোদি সরকারেও নেই। কারণ এনডিএ জোটে বিজেপির এ কারণেই লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। ফলে শুধু পরিকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, আসন্ন ডিজিটাল দুনিয়ায় পা রাখার ক্ষেত্রে নয়াদিল্লী-ঢাকা সহযোগিতা করতেই পারে। এতে শুধু যে আর্থিক দিক থেকে দু’দেশ লাভবান হবে তাই নয়, ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসবাদ দমনেও এটা উল্লেখযোগ্য হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। চতুর্থ প্রজন্মের (৪জি) টেলিকম প্রযুক্তির ভূগর্ভস্থ কেবলের নেটওয়ার্ক ইতোমধ্যেই দেশের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত মোবাইল নেটওয়ার্কের ওপর ভিত্তি করে ডিজিটাল ভারত গড়ার শুরু হচ্ছে এটা বলা যেতেই পারে। বাংলাদেশকেও আগামী দিনের উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তি উন্নয়নের হাতিয়ার হতেই পারে। ভারতের দেশজোড়া ৪জি নেটওয়ার্কের সুফল পড়শি দেশগুলো নিতেই পারে। ভারত আর বাংলাদেশ উভয়ের জন্যই সেটা লাভদায়ক। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, দু’দেশের মধ্যে শীর্ষ বৈঠকের গুরুত্ব কিন্তু দিল্লী আর ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বিশ্ব রাজনীতির ভরকেন্দ্র এখন সরে আসছে এশিয়ায়। টেমস আর পটোম্যাকের চেয়েও বেশি ঢেউ উঠছে গঙ্গা-পদ্মা-হোয়াং হো-মেকং এ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে একের পর এক আন্তর্জাতিক চুক্তি বাতিল করে দিচ্ছেন, যেভাবে বলে চলেছেন যে অনেক হয়েছে, আর নয়, আমেরিকা এখন থেকে নিজের স্বার্থ আগে দেখবে। তাতে একদিকে যেমন পরোক্ষভাবে বিশ্বব্যাপী আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য, তেমনি দুনিয়াদারিতে আমেরিকার কর্তৃত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা। আর্থিক মন্দার কারণে এমনিতেই ইউরোপ যথেষ্ট ম্রিয়মাণ, তারপরে আবার মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ওই মহাদেশের অন্যতম প্রধান আর্থিক শক্তি ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করে দেয়ায় সঙ্কট আরও বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে এশিয়ার গুরুত্ব ধারে ও ভারে বেড়েই চলেছে। তাই নয়াদিল্লী-ঢাকার দীর্ঘকালীন বন্ধুত্ব অনেক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিতে পারে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের আসন্ন ভারত সফরের গুরুত্ব অপরিসীম। নিছক কিছু দ্বিপাক্ষিক পরিকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা ও নদ-নদী সংক্রান্ত চুক্তির সম্ভাবনার মধ্যেই এর গুরুত্ব শেষ হচ্ছে না। কারণ, এই ধরনের দ্বিপাক্ষিক আর্থিক ও পরিকাঠামোগত বিষয় দুটি পড়শি দেশের মধ্যে থাকতেই পারে। আলোচনার টেবিলে বসে তা মিটিয়েও নেয়া যায়। তাই এই ধরনের দ্বিপাক্ষিক সফর শুধু যে দুটি দেশকে কাছে টানে তা নয়, সামনা-সামনি বসে আলোচনায় দু’দেশের শীর্ষ নেতৃত্বও একে অপরের অবস্থানটা পরিষ্কার বুঝতে পারেন। তাই প্রত্যাশার পারদের উঠানামা থাকবেই। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে দু’দেশের এই নিবিড় বন্ধুত্ব আন্তর্জাতিক স্তরেও ছাপ ফেলতে বাধ্য। ঐতিহাসিকভাবেও বঙ্গবন্ধু তনয়ার সঙ্গে ভারতের নিবিড় টান রয়েছে। তাই ভারতও আসন্ন সফরের দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে আছে। আর দুই শক্তিশালী রাষ্ট্রনেতা-নেত্রীর আসন্ন বৈঠককে ঘিরে তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক ঔৎসুক্যও। ভারত মহাসাগর অঞ্চলে বাংলাদেশ দ্রুত তার অবস্থান শক্ত করছে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দিনে পারস্য উপসাগর আর দক্ষিণ চীন সাগরের মতোই ভারত মহাসাগর আর বঙ্গোপসাগর রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। আর ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে ও আর্থিক শক্তিতে তেজিয়ান ঢাকা অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। বস্তুত দক্ষিণ এশিয়াকে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল করতে দু’দেশের ভূমিকা অনস্বীকার্য। লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক [email protected]
×