কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ ভারতীয় সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত চমৎকার। দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সফর বিনিময়ের মাধ্যমে এ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হচ্ছে। শনিবার রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে এক সৌজন্য বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। এছাড়া তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকের পর ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান গোবিন্দগঞ্জে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একটি যুদ্ধক্ষেত্র ও বগুড়া সেনানিবাস পরিদর্শন করেন।
ঢাকা সফররত ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত শনিবার বিকেলে বঙ্গভবনে যান। সেখানে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে এক সৌজন্য বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মোঃ জয়নাল আবেদীন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বৈঠকে রাষ্ট্রপতি বলেন, ভারত বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত চমৎকার। তিনি এ সময় মুক্তিযুদ্ধে ভারতের জনগণ ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আবদুল হামিদ আরও বলেন, দুই দেশের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা পর্যায়ে সফর বিনিময় উভয় দেশের সেনাবাহিনীর পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি এ সময় দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিনিময়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন বলে জানান প্রেস সচিব।
প্রেস সচিব বলেন, বৈঠকের সময় ভারতীয় সেনাপ্রধান বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত চমৎকার। দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সফর বিনিময়ের মাধ্যমে এ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হচ্ছে। ভারতীয় সেনাপ্রধান আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রশিক্ষণ বিনিময় আরও বৃদ্ধি পাবে এবং এর মাধ্যমে সহযোগিতা আরও সম্প্রসারিত, আরও বৃদ্ধি পাবে।
এ সময় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা, ভারতীয় সেনাপ্রধানের স্ত্রী মাধুলিকা রাওয়াত, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনের ডিফেন্স এ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার জেএস নন্দা, ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের ডিফেন্স এ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল হামিদ উপস্থিত ছিলেন।
আইএসপিআর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, শনিবার ঢাকা সেনানিবাসে সেনা সদর দফতরে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ভারতের সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত। বৈঠককালে তারা পারস্পরিক কুশলাদি বিনিময় ছাড়াও দু’দেশের সেনাবাহিনীর বিদ্যমান প্রশিক্ষণ ও পেশাগত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন।
ভারতীয় সেনাপ্রধান তার আগে সেনানিবাসের শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে শাহাদত বরণকারী সশস্ত্র বাহিনীর বীর সদস্যদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর সেনাকুঞ্জে তাকে সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। পরবর্তীতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে সফররত বিশেষ প্রতিনিধিদলটি গোবিন্দগঞ্জে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে একটি যুদ্ধক্ষেত্র ও বগুড়া সেনানিবাস পরিদর্শন করেন।
গাইবান্ধা থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত। শনিবার বেলা সোয়া এগারোটায় গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটাখালী ব্রিজসংলগ্ন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধে ভারতীয় সেনা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় সেনাপ্রধানের সঙ্গে তার স্ত্রীসহ চারজন সফরসঙ্গী ছিলেন। ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত ৩৫ মিনিট ধরে স্মৃতিসৌধ এলাকা ঘুরে দেখেন।
তিনি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় ১১ পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল মোশফেকুর রহমান, জেলা প্রশাসক আবদুস সামাদ, পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদ, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল ইসলাম আজাদসহ ৫ মুক্তিযোদ্ধা এবং উর্ধতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে জেনারেল বিপিন রাওয়াতের সফর উপলক্ষে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রংপুর-বগুড়া মহাসড়কের স্মৃতিসৌধসংলগ্ন কয়েক কিলোমিটার এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে। এর আগে জেনারেল বিপিন রাওয়াতকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বেলা এগারোটায় কাটাখালী হেলিপ্যাডে অবতরণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে জেনারেল বিপিন রাওয়াত বগুড়া ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশে রওনা হন।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটাখালী ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় ভারতীয় সেনা ও মুক্তিযোদ্ধারা সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন। তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভারতীয় সেনাপ্রধান গোবিন্দগঞ্জ সফর করেন।
ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত শুক্রবার তিনদিনের সফরে ঢাকায় আসেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী রাওয়াত সেনাবাহিনীপ্রধান আবু বেলাল মোহাম্মাদ শফিউল হকের আমন্ত্রণে ঢাকায় আসেন। সফর শেষে আজ রবিবার জেনারেল বিপিন রাওয়াতের ঢাকা ত্যাগ করার কথা রয়েছে।
২০১৭ সালের পহেলা জানুয়ারি ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়ার পর রাওয়াতের এটিই প্রথম বিদেশ সফর। তার এ সফর দুদেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সফর বিনিময়ের একটি অংশ। এর আগে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান বেলাল মোহাম্মাদ শফিউল হক ভারত সফর করেন। বাংলাদেশের বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী প্রধানরাও ২০১৬ সালে ভারত সফর করেন। ওই বছরেই ভারতের বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী প্রধানরা বাংলাদেশ সফর করেন। ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বিপিন রাওয়াতের ব্যাটালিয়ান ৫/১১ জিআর উত্তরবঙ্গের পীরগঞ্জ, গোরাঘাট, গোবিন্দগঞ্জ, শেওলাকান্দী, মহাস্থান ব্রিজ ও বগুড়ায় মুক্তিযুদ্ধে করেছেন।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফর সামনে রেখে প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনার লক্ষ্যে ঢাকায় এসেছেন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত। তিনি নেপালের কাঠমা-ুতে এক অনুষ্ঠান শেষে সেখান থেকে ঢাকা আসেন। ঢাকা সফরকালে তিনি বাংলাদেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। তার এই সফরের মধ্যে দিয়েই দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত হতে পারে।