ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বড়হাটে অভিযানে এক নারীসহ ৩ জঙ্গী নিহত

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২ এপ্রিল ২০১৭

বড়হাটে অভিযানে এক নারীসহ ৩ জঙ্গী নিহত

গাফফার খান চৌধুরী/ সৈয়দ হুমায়েদ শাহীন/সালাম মশরুর/মীর শাহ আলম ॥ মৌলভীবাজার পৌরসভার বড়হাট এলাকার জঙ্গী আস্তানাটিতে সোয়াটের চালানো ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’ শনিবার বেলা এগারোটার দিকে শেষ হয়েছে। অভিযানে নিহত হয়েছে তিন জঙ্গী। যার মধ্যে একজন নারী। বাকি দুইজন পুরুষ। লাশগুলো মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। তাদের পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে। মৌলভীবাজারের দুটি আস্তানায় নিহত জঙ্গীদের জীবিত ধরার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু জঙ্গীরা আত্মঘাতী হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। নাসিরনগরের আস্তানায় চার শিশুকে মাঝে রেখে তিন দিক থেকে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে সাত জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সিলেটের আতিয়া মহলে সেনাবাহিনীর চালানো ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’-এ নিহত চার জঙ্গীর মধ্যে উদ্ধারকৃত দুই জঙ্গী স্বামী-স্ত্রীর লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে শনিবার দাফন করা হয়েছে। আস্তানায় পড়ে থাকা অপর দুই জঙ্গীর লাশে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অন্যদিকে কুমিল্লার জঙ্গী আস্তানায় চালানো ‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট’ শেষ হয়েছে। আস্তানায় থাকা বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গীকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। আস্তানাগুলোতে থাকা গ্রেনেড ও বোমা নিষ্ক্রিয় করার পাশাপাশি আলামত সংগ্রহের কাজ চলছে। আস্তানাগুলোর আশপাশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তবে তুলে নেয়া হয়েছে আস্তানার চারদিকে জারি করা ১৪৪ ধারা। সেইসঙ্গে ওইসব এলাকায় চালু করা হয়েছে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া বিদ্যুত ও গ্যাস সংযোগ। তবে এখনও আশপাশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি। ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’ ॥ গত ২৮ মার্চ মৌলভীবাজারের দুটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আস্তানা দুটি ঘিরে রাখে পুলিশ, র‌্যাব ও সোয়াট। নাসিরপুরের জঙ্গী আস্তানাটিতে অপারেশন হিট ব্যাক শেষ হওয়ার পর শুক্রবার বড়হাটের আস্তানায় অভিযান শুরু করে সোয়াট। চারদিকে অবস্থান নিয়ে সাঁজোয়া যান এপিসি (আর্মার পারসোন্যাল কেরিয়ার) দিয়ে মূল গেট ভেঙ্গে ডুপ্লেক্স ধরণের বাড়িটিতে প্রবেশের চেষ্টা করে। শুক্রবার দিনভর জঙ্গীদের সঙ্গে পুলিশের থেমে থেমে গোলাগুলি হয়। জঙ্গীরা গ্রেনেড হামলা করে। শুক্রবার বিকেলে এক নারী জঙ্গী বাড়িটির ছাঁদ থেকে সোয়াটকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা চালায়। একটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। অপরটি বাড়ির পাশের ধানক্ষেতে পড়ে। তা নিষ্ক্রিয় করার কাজ চলছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় বৈরী আবহাওয়া ও অন্ধকার নেমে আসায় অভিযান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর ঘণ্টা দুয়েক পর রাত আটটার দিকে আচমকা আস্তানার ভেতরে পর পর তিনটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। এ সময় সেখানে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আস্তানা লক্ষ্য করে ২৫/৩০ রাউন্ড গুলি চালায়। এরপর রাতে আর কোন গোলাগুলি বা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেনি। শনিবার সকাল দশটার দিকে অভিযান শুরু করে সোয়াট। সোয়াট গুলি চালাতে থাকে। এরপর থেমে থেমে গুলি চলছিল। বেলা এগারোটার দিকে সবকিছু নীরব হয়ে যায়। ভেতর থেকে আর কোন সাড়াশব্দ আসছিল না। এরপর সোয়াট ভেতরে ঢুকে। তারা বাড়ির ভেতরে তিনটি লাশ পড়ে থাকতে দেখে। ভেতরে আর কোন জঙ্গী নেই বলে সোয়াট ছাড়াও মনুষ্যবিহীন ড্রোন দিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। এরপর অভিযান শেষ ঘোষণা করা হয়। অভিযান শেষে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, আস্তানায় তিন জঙ্গীর লাশ রয়েছে। তার মধ্যে একজন নারী। বাকি দুইজন পুরুষ। আস্তানার ভেতরে প্রচুর বিস্ফোরক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অপারেশনটি অপেক্ষাকৃত একটু জটিল ছিল। কারণ নির্মাণাধীন ডুপ্লেক্স ধরনের বাড়িটিতে অনেক কক্ষ রয়েছে। অভিযানে মনুষ্যবিহীন ড্রোন বিমান ব্যবহার করা হয়েছে। ড্রোন দিয়ে বাড়িটির ভেতরে প্রচুর বিস্ফোরক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বলে দেখা গেছে। বাড়ির ভেতর একাধিক কামরায় ৪/৫ জন জঙ্গী বলে ধারণা করা হয়েছিল। বাড়িটির জানালাগুলো শক্তিশালী কাঁচের তৈরি। বাড়িটিতে একজন আফগান ফেরত বোমা বিশেষজ্ঞ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হামলার ধরন দেখে বুঝা যায়, নিহতরা কোন সাধারণ মানের জঙ্গী ছিল না। তারা বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ছিল। মৌলভীবাজারের বড়হাটের ওই আস্তানা থেকে গিয়েই সিলেটের আতিয়া মহলের বাইরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আবার বড়হাটের আস্তানায় আত্মগোপন করেছিল এক জঙ্গী। এরপরই বড়হাটে অভিযান চালানোর দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যদি সাধারণ মানুষ ও বাড়িওয়ালারা সতর্ক থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করেন, তাহলে সন্ত্রাসী ও জঙ্গীদের দমন করা কঠিন হবে না। এমন ঘটনাও আর ঘটবে না। অভিযানের সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে গিয়ে মানুষের ভোগান্তিও হবে না। নাসিরনগরের আস্তানায় শিশুদের মাঝে রেখে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গীরা ॥ গত ২৮ মার্চ মৌলভীবাজারের নাসিরনগরে আরেকটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। সেখানে সোয়াট অপারেশন হিট ব্যাক পরিচালনা করে। অভিযানে সাত জঙ্গীর মৃত্যু হয়। যার মধ্যে দুইজন পুরুষ। একজন নারী ও বাকি চার জন শিশু। শনিবার পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম ওই আস্তানায় নিহতদের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে জানান, আস্তানায় অভিযানকালে শিশুরা নিহত হয়নি। অভিযানের সময় আত্মঘাতী জঙ্গীরা শিশুদের মাঝখানে রাখে। এরপর তিন দিকে তিনজন সুইসাইডাল ভেস্টের বিস্ফোরণ ঘটায়। আর তাতেই চার শিশুর মৃত্যু হয়। যারা আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, তাদের তাদের পেট ও কোমরের অংশ নেই। তাদের মাংসে তার জড়িয়ে আছে। এসব আত্মঘাতী জঙ্গীরা ইসলামবিরোধী, দেশবিরোধী, মানবতাবিরোধী। কারণ তারা নিজেদের শিশুদেরও রেহাই দেয়নি। এরা এতটা জঘন্য। এরা আসলে দৈত্য, দানবশ্রেণীর-মানুষ নয়। আস্তানা থেকে উদ্ধারকৃতদের মধ্যে কয়েক মাস বয়সী শিশু রয়েছে। বুধবার বিকেলেই আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তারা নিহত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। এলাকায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরে আসছে। তবে এখনও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। আতিয়া মহলে থাকা দুই জঙ্গীর গলিত লাশ থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ॥ আতিয়া মহল থেকে উদ্ধারকৃত দুই জঙ্গীর লাশ দাফন করা হয়েছে। শনিবার বেলা ৩টার দিকে বেওয়ারিশ হিসেবে নগরীর হযরত মানিকপীর (রহ.) এর কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়। এদের মধ্যে একজন মর্জিনা আক্তার ও অপরজন মাইনুল ইসলাম ওরফে মুসা বলে পুলিশের ধারণা। বিষয়টি নিশ্চিত হতে মর্জিনা ও মুসার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। অভিযানে নিহত আরও দুই পুরুষ জঙ্গীর লাশ শনিবার সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত আতিয়া মহলেই পড়ে ছিল। লাশে পচন ধরে সেখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাড়িটি ঘিরে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, লাশ দুটো আতিয়া মহলের ভেতরে কি অবস্থায় আছে তা জানা যাচ্ছে না। কারণ বাড়িটির ভেতরে প্রচুর বিস্ফোরক রয়েছে। তা নিষ্ক্রিয় না করা পর্যন্ত লাশ উদ্ধার করা যাচ্ছে না। বাড়িটিও খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। তবে বাড়ির আশপাশে জারি করা ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এলাকায় বিদ্যুত ও গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে। তবে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি। গত ২৩ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী এলাকার আতিয়া মহল নামের বাড়িটি জঙ্গী আস্তানা বলে নিশ্চিত হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেখানে পুলিশ, র‌্যাব, সোয়াটের পর সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডোদের নেতৃত্বে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট‘ পরিচালিত হয়। টানা প্রায় তিন দিন চলে সেই অভিযানে। অভিযানে বাড়ি থেকে সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে সক্ষম হন প্যারাকমান্ডোরা। ‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট’ শেষ ॥ জেলার দক্ষিণ বাগমারা এলাকার নির্মাণাধীন তিনতলা বাড়িতে থাকা জঙ্গী আস্তানাটিতে সকাল থেকেই তল্লাশি চালানো শুরু করে বম্ব ডিসপোজাল টিম। তারা আস্তানা থেকে আটটি বোমা ও দুটি সুইসাইডাল ভেস্ট পায়। বিস্ফোরকগুলো বাইরে বের করা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতেই বোমাগুলো ও সুইসাইডাল ভেস্ট দুটি বাড়িতে নিষ্ক্রিয় করা হয়। এ সময় বিকট শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। আর বাড়িতে আগুন ধরে যায়। পরে ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে নেভায়। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির ক্রাইম সিন আলামত সংগ্রহ করে। বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গীকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। জঙ্গীদের হাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নয় সদস্য নিহত হলো ॥ সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, জঙ্গীবিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে আমরা ইতোমধ্যেই র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ ও ৮ পুলিশ সহকর্মীকে হারিয়েছি। সেই স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে খুব সতর্কতার সঙ্গে জঙ্গীবিরোধী তৎপরতা চালাতে হচ্ছে। জঙ্গী নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কখনোই পিছপা হবে না। নয় সহকর্মীকে হত্যাকারী জঙ্গীদের গ্রেফতার করে আইনের কাছে সোপর্দ করার ইচ্ছা ছিল। তাদের কাছ থেকে অনেক অজানা তথ্য জানারও প্রয়োজন ছিল। নিশ্চয় এমন অপরাধে দোষী জঙ্গীদের ফাঁসিও হতো। কিন্তু প্রকৃতিগতভাবেই জঙ্গীদের বিচার হয়ে গেল। হামলাকারী ওইসব জঙ্গী অভিযানে নিহত হয়েছে। এজন্য তাদের গ্রেফতারের সে ইচ্ছে আর পূরণ হলো না। প্রসঙ্গত, গুলশানের হলি আর্টিজানে দুই পুলিশ কর্মকর্তা, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দুই পুলিশ সদস্য, ঢাকার গাবতলীতে এক পুলিশ কর্মকর্তা, ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় এক পুলিশ সদস্য এবং সর্বশেষ সিলেটে দুই পুলিশ সদস্য ও একজন সেনা সদস্য জঙ্গীদের হাতে নিহত হন।
×