ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আইপিইউর ১৩৬তম সম্মেলন উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

গণতন্ত্রেই উন্নয়ন

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২ এপ্রিল ২০১৭

গণতন্ত্রেই উন্নয়ন

উত্তম চক্রবর্তী ॥ সক্ষমতার জানান দিয়ে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শুরু হলো আন্তর্জাতিক শীর্ষ সংসদীয় সংস্থা ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন- আইপিইউ’র পাঁচ দিনব্যাপী ১৩৬তম সম্মেলন। সারাবিশ্বের ১৩২টি দেশের দেড় সহস্রাধিক সংসদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে বর্ণিল আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা গণতন্ত্রকে শুধু একটি ব্যবস্থা হিসেবে দেখি না বরং গণতন্ত্রকে মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বাহন হিসেবে গণ্য করি। তিনি বলেন, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর রাখতে হলে জনগণের আস্থা সংরক্ষণ ও লালন করাই হচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের অগ্রাধিকারভিত্তিক নৈতিক দায়িত্ব। আমি মনে করি একমাত্র গণতন্ত্রই মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহ পূরণ করে উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে পারে। আমি এও আশা করি, দারিদ্র্য বিমোচন, বিশ্ব শান্তি স্থাপন এবং মানবতার কল্যাণে আইপিইউ সম্মেলনে বাস্তবধর্মী সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হবে। তিনি বলেন, দেশের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। অনেক সংগ্রামের পথ ধরেই আমাদের এই গণতান্ত্রিক ধারা রক্ষা করতে পেরেছি। শনিবার সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) বৃহৎ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জঙ্গীবাদকে বৈশ্বিক সমস্যা উল্লেখ করে বলেন, বিশ্ব নতুন উপদ্রবের মুখোমুখি হয়েছে। সন্ত্রাস এবং জঙ্গীবাদ নিরীহ মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। মানুষের শান্তি বিনষ্ট করছে। জঙ্গীবাদ আজ কোন নির্দিষ্ট দেশের সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা। আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এ সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়তে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোকে আরও সহানুভূতি নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্ব আজ এগিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধিত হয়েছে বৈশ্বিক ক্ষুধার ক্ষেত্রেও। তবুও বিশ্বের প্রায় ৮শ’ মিলিয়ন মানুষ এখনও অপুষ্টিতে ভুগছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক বিরাট সংখ্যক শিশু পুষ্টির অভাবে সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। অসুখে-বিসুখে চিকিৎসার অভাবে সুবিধাবঞ্চিত তারা। সুযোগ পাচ্ছে না বিদ্যালয়ে যাওয়ার। অথচ প্রাচুর্যে ভরা এই বিশ্বে মানবজাতির বেঁচে থাকার সব ধরনের রসদ বিদ্যমান। তাই একটু সহানুভূতি, সহযোগিতা, পরস্পরের প্রতি মমতা ও ভাতৃত্ববোধ বিশ্বকে এক নিমিষেই ক্ষুধামুক্ত করতে পারে। আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনে প্রথমেই স্বাগত বক্তব্যে রাখেন আয়োজক জাতীয় সংসদের স্পীকার ও ১৩৬তম আইপিইউ এ্যাসেম্বলির সভাপতি ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। সম্মেলন উপলক্ষে প্রদত্ত জাতিসংঘ মহাসচিব এন্টোনিও গুতেরেসের বাণী পড়ে শোনান জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মেরেসøাব ইয়ানকা। আগত অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন আইপিইউ’র বর্তমান সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী ও সংস্থাটির সেক্রেটারি জেনারেল মার্টিন চুনগুং। এরপর সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্মেলনের উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী সংসদীয় এই বিশ্ব সংস্থার প্রথম ওয়েভ টেলিভিশন চ্যানেল ‘সিপিইউ ওয়েব টিভি’র উদ্বোধন এবং সম্মেলন উপলক্ষে একটি স্মারক ডাকটিকেট অবমুক্ত করেন। সব শেষে জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে সম্মেলনে আগত অতিথিদের নৈশভোজ আপ্যায়ন করেন স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্য, সামরিক-বেসরকারী উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ, দেশের বিশিষ্টজনসহ কয়েক সহস্রাধিক অতিথি উপস্থিত ছিলেন। বর্ণিল-মনোলোভা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ॥ বিশ্বের ১৩২টি দেশের সংসদের নির্বাচিত প্রায় দেড় হাজার জনপ্রতিনিধিদের মিলনমেলা বসেছিল জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়। ‘বৈষম্যের প্রতিকার ঃ সকলের জন্য মর্যাদা ও কল্যাণ নিশ্চিত’Ñ এই মূল প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ১৩২টি দেশ ও ৪২টি সহযোগী সংস্থার ৫৩ স্পীকার, ৪০ ডেপুটি স্পীকারসহ অংশগ্রহণকারী ৮৯৬ সংসদ সদস্যদের মধ্যে ২০৯ জন নারী সংসদ সদস্য সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক রয়েছে দুইশোরও বেশি। নিñিদ্র নিরাপত্তায় শুরু হওয়া পাঁচ দিনব্যাপী এই জমকালো ও বর্ণাঢ্য আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে। ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের পর পরিবেশন করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঃ আর্কিটেড অব ডেমোক্র্যাসি’ শীর্ষক একটি প্রামাণ্যচিত্র। সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রাম, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, একাত্তরের ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর বর্বর গণহত্যাযজ্ঞ, স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে জাতিসংঘ অধিবেশনে প্রথম বাংলায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলের উন্নয়ন ও সাফল্যের প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরে পরিবেশন করা হয় ৩৫ মিনিটের মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রথমে কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে বাঙালীর লড়াই-সংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাস ও আবহমান বাংলার সংস্কৃতি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সামনে তুলে ধরা হয়। এরপর থ্রিডি ম্যাপিং ও অটো প্রজেকশনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয় বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনার শাসনামল পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়ন ও বাংলার ঐতিহাসিক স্থাপনার চিত্র। সেখানে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয় একাত্তরের ২৫ মার্চে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যাযজ্ঞের বর্বরতার চিত্র। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরুতেই ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি বেদনাবিধুর সংগ্রামের কোরিওগ্রাফি দেখানো হয়। হঠাৎ রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই সেøাগানে মুখরিত হয়ে ওঠে নৌকার ওপর বসানো দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল মূল মঞ্চ। এরপর ভাষা সংগ্রামীদের ওপর নির্মম অত্যাচারের চিত্র। এরপর চলে আসে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের চিত্র। মাটিতে বসে লক্ষাধিক জনতা। মঞ্চে ভাষণ দিচ্ছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা সংবলিত বঙ্গবন্ধুর বর্জনির্ঘোষ ভাষণটি শুনে শিহরিত হয়ে ওঠেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া বিদেশী দেড় সহস্রাধিক জনপ্রতিনিধি ছাড়াও কয়েক হাজার অতিথি। কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মুহূর্ত্বগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়। পাঁচ দিনব্যাপী এই সম্মেলনে আইপিইউ’র সদস্যভুক্ত ১৭১টি দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য বিলোপের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক পরিসরে আলোচনা শেষে সুপারিশমালা প্রণয়ন করবেন। এবারের সম্মেলনে কেন বৈষম্যের ওপর জোর দেয়া হয়েছে ও উগ্রপন্থার যোগসূত্র কী সে প্রসঙ্গে আইপিইউ প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী ও মহাসচিব মার্টিন চুনগুং দুজনই জানিয়েছেন, জঙ্গীবাদের ক্ষেত্রে আইপিইউ’র কৌশল কী হবে, তা নিয়ে সংস্থার নির্বাহী কমিটিতে আলোচনা হবে। সেখানে সংসদের কী ভূমিকা থাকবে, সংসদ সদস্যদের কী ভূমিকা থাকবেÑ সেটি আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। এছাড়া সংস্থাটির ১৩৮ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম হতে যাচ্ছে ‘গ্রিস এ্যাসেম্বলি’। আর ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শীর্ষ সংসদীয় সংস্থাটির সম্মেলন প্রথমবারের মতো ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী আরও যা বলেন ॥ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিশ্বের সকল জনপ্রতিনিধিদের উঞ্চ অভিনন্দন ও স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আইপিইউ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছি। এই প্রথমবারের মতো ১৭১টি সদস্য দেশের সংসদীয় সংগঠন আইপিইউর এ ধরনের বৃহৎ আন্তর্জাতিক সম্মেলন ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য এটি সত্যিই একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। আমি বাংলাদেশের জনগণ এবং নিজের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণকারী সকলকে উষ্ণ অভিনন্দন ও স্বাগত জানাচ্ছি। আমি আশা করি বাংলাদেশে আপনাদের অবস্থান আনন্দদায়ক এবং ফলপ্রসূ হবে। দেশের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার কথা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সামনে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র অর্জনের পথ কখনই মসৃণ ছিল না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানুষের অধিকার আদায় এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। এজন্য তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। কিন্ত জনগণের রায় অনুযায়ী জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের নামে শুরু করে মানব ইতিহাসের নির্মমতম হত্যাযজ্ঞ। বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। জাতির পিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের আপামর জনগণ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ শেষে ৩০ লাখ শহিদ আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে নিয়োজিত, ঠিক তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার-বিরোধী শক্তি তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে। আমি এবং আমার ছোটবোন বিদেশে অবস্থান করায় আমরা বেঁচে যাই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর গণতন্ত্রকে নির্বাসনের পাঠিয়ে শুরু হয় সামরিক ও স্বৈরশাসন। প্রবাসে থাকা অবস্থাতেই ১৯৭৯ সালে আমি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সোচ্চার হই। ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে সংগ্রাম শুরু করি। ১৯৮৬ সালে আমি প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হই। সে সময় বিরোধীদলের নেতা হিসেবে প্রথম আইপিইউ সম্মেলনে যোগ দেই। তিনি বলেন, জনগণের শাসন ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে আমাকেও কম নির্যাতন সহ্য করতে হয়নি। গৃহবন্দী, জেলখানায় আটক থেকে শুরু করে আমার জীবননাশের প্রচেষ্টা হয়েছে বার বার। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তাঁর ওপর বার বার হামলা এবং তাঁর দলের বিশাল আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাকে হত্যার জন্য ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ কমপক্ষে ১৯ বার হামলা করা হয়। ২১ আগস্টের হামলায় আমার দলের মহিলা শাখার সভাপতিসহ ২২ নেতাকর্মী নিহত হন এবং ৫০০ জনের বেশি আহত হন। ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আমার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী জীবন দিয়েছেন। কিন্তু আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে বিচ্যুত হইনি। আমি মনে করি একমাত্র গণতন্ত্রই মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহ পূরণ করে উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে পারে। বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রভাবের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা চলছে। তবুও আমি এই মহৎ সমাবেশের সামনে বিষয়টি আরেকবার উত্থাপন করছি এ কারণে যে এই পরিবর্তনের ফলে আমরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে পরিত্রাণের জন্য যে সহায়তার প্রতিশ্রুতি বিভিন্ন ফোরামে দেয়া হয়েছে, সেগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমরা একটি দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত, ন্যায়-ভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। জাতীয় সংসদ, বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় সরকারসহ আমরা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করেছি। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে উপজেলা, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন ও জেলা পরিষদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অতন্দ্র প্রহরী স্বাধীন এবং সপ্রতিভ গণমাধ্যম। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের গণমাধ্যম একদিকে যেমন বিকশিত হয়েছে, তেমনি নিশ্চিত করা হয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন এবং তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের দ্রুত উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। দারিদ্র্যের হার ২০১০ সালের ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১৬ সালে ২২ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭২ বছর। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই নি¤œ-মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি লাভ করেছে। এখন আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম-আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা লাভ করা। তিনি বলেন, আমরা এমডিজি বাস্তবায়নে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছি। এমডিজি সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আমরা এসডিজি বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের চলমান সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এসডিজির বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছি। আইপিইউ প্রেসিডেন্ট পদে সাবের হোসেন চৌধুরী এবং সিপিএ নির্বাহী কমিটির চেয়ারপার্সন পদে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে নির্বাচিত করায় সারাবিশ্বের সংসদ সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, এমপি সিপিএর নির্বাহী কমিটির চেয়ারপার্সন এবং সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী আইপিইউর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সারাবিশে^র পার্লামেন্টেসমূহের সদস্যগণের কাছ থেকে পাওয়া এ স্বীকৃতি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চায় বাংলাদেশের নিবেদিত থাকার একটি মূল্যবান সনদ। আইপিইউ সম্মেলনের সাফল্যে কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের এই ১৩৬তম এসেম্বলিতে আপনারা বিভিন্ন বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন। আমি আশা করি দারিদ্র্য বিমোচন, বিশ্ব শান্তি স্থাপন এবং সর্বোপরি মানবতার কল্যাণে আপনারা বাস্তবধর্মী সুপারিশমালা প্রণয়ন করবেন। নিজ নিজ দেশে সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। তবেই আমাদের-আপনাদের পরিশ্রম সার্থক হবে। মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত হবে। সক্ষমতার জানান দিল বাংলাদেশ ॥ দেশের ইতিহাসে সব থেকে বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে সারাবিশ্বের সামনে নিজেদের সক্ষমতার জানান দিল বাংলাদেশ। এবারের সম্মেলনটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিপ্রায়ের জন্য একটি মাইলফলক, যা বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনবে বিরাট সম্মান। আইপিইউর ১৩৮ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এই সম্মেলন হচ্ছে, এটা দেশের জনগণের জন্য একটি বিরাট গর্বের বিষয়ও। আয়োজকরা বলছেন, ঢাকায় আইপিইউ সম্মেলনের আয়োজন বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরার সুযোগ করে দিয়েছে। এই সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়ন, গণতন্ত্রের সফল অভিযাত্রা, সুদূরপ্রসারী উন্নত-সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নির্মাণে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাগুলো আন্তর্জাতিক পরিম-লের সামনে তুলে ধরার এক অনন্য সুযোগ এসেছে বাংলাদেশের। বিশেষ করে যেসব দেশে বাংলাদেশের কূটনীতিক মিশন নেই, সংসদীয় কূটনীতির মাধ্যমে সে দেশগুলোর কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্র তৈরি করে দেবে। এছাড়া একাত্তরে পাক হানাদারদের গণহত্যার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের সংসদ সদস্যরা তাঁদের অন্য দেশের সতীর্থদের কাছে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে এই সম্মেলন। বাংলাদেশ আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, বর্তমানের বাংলাদেশ যে কোন চ্যালেঞ্জ নিয়ে তা মোকাবেলা করতে পারে এমন চ্যালেঞ্জ নিয়েই সারাবিশ্বে সংসদীয় গণতন্ত্রের সর্ববৃহৎ সংস্থা আইপিইউ সম্মেলয়ের আয়োজন করে তা ইতোমধ্যেই জানা দিয়েছে। শত ষড়যন্ত্রের পরও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণযজ্ঞ চলার মধ্যেই এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ সারাবিশ্বকে জানিয়ে দিল- বর্তমানের বাংলাদেশ সব পারে। সম্মেলনকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা ॥ সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে নিয়ে ১৮৮৯ সালে গঠিত আইপিইউর বাংলাদেশ সদস্যপদ পেয়েছে ১৯৭২ সালে। আর জাতীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর প্রথমবারের মতো আইপিইউর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর আইপিইউ সম্মেলনের উদ্যোগ নেয়া হয়। নিরাপত্তা শংকা ও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা শেষে শনিবার সন্ধ্যায় আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে। এদিকে সম্মেলনকে ঘিরে নেয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা। এর আগে নিরাপত্তার শঙ্কায় সিপিএ সম্মেলন বাতিল হওয়ায় বাংলাদেশ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। তাই সম্মেলনকে সামনে রেখে পুরো রাজধানীতে নিñিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ১০ হাজারেরও বেশি সদস্য এই নিরাপত্তা ব্যবস্থায় দায়িত্ব পালন করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শনিবার সকালে অনুষ্ঠানস্থল ঘুরে দেখেছেন এবং নিরাপত্তার খোঁজ-খবর নিয়েছেন। এ সময় পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এদিকে সংসদ ভবন এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের পাশাপাশি সম্মেলন চলাকালে সংসদ ভবনে দর্শনার্থী প্রবেশ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিমানবন্দরেও দর্শনাথীদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এছাড়া সম্মেলন চলাকালে রাজধানীর কয়েকটি সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
×