ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

’৭১-এ কুষ্টিয়া শহর ও শহরতলি ১৭ দিন মুক্ত ছিল

প্রকাশিত: ০৬:১২, ১ এপ্রিল ২০১৭

’৭১-এ কুষ্টিয়া শহর ও শহরতলি ১৭ দিন মুক্ত ছিল

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ইতিহাস গণমানুষের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস। কতিপয় পাকিস্তানের দালাল-রাজাকার ছাড়া সকল শ্রেণীর মানুষ কোন না কোনভাবে মুক্তি সংগ্রামে যুক্ত ছিল। একাত্তরের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা ঢাকায়। কিন্তু সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান হঠাৎ ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। সমাজের সর্বস্তরের স্বাধীনতাকামী তরুণ, ছাত্র, জনতা ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্য স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দাবি প্রত্যক্ষভাবে বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শহর-বন্দর-গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গড়ে উঠল। মূলত তখন থেকেই বাংলাদেশের প্রশাসন পরিচালিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সহ-সভাপতি আ স ম আব্দুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ’৭১-এর ৭ মার্চ ঢাকা সোহ্রাওয়ার্দী (রেসকোর্স) ময়দানে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার সপক্ষে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিয়েছে। সে এক অতুলনীয় অসাধারণ ভাষণ। স্বাধীনতা স্পৃহা নিয়ে সেদিন সর্বস্তরের জনসাধারণ গগন বিদারী সেøাগান তুলেছিল ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ পদ্মা, মেঘনা, যমুনা তোমার আমার ঠিকানা, বাঁশের লাঠি তৈরি কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর ইত্যাদি। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ’৭১-এর ৩ মার্চ কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ মাঠে হাজার হাজার তরুণ ছাত্র, জনতা ও সংগ্রামী ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে পাকিস্তানের পতাকা অগ্নিসংযোগ করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সংগ্রামী নেতা আব্দুল জলিল এবং স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সামসুল হাদী। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এ্যাডভোকেট আব্দুল বারী, শেখ দলিল উদ্দিন আহমদ, মোঃ মারফত আলী, আব্দুল মোমেন, মির্জা জিয়াউল বারী নোমান, আখতারুজ্জামান মাসুম, শেখ গিয়াসউদ্দিন মিন্টু, ইহসানুল করিম হেলাল (প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব), রূপান্তরের স্টুডিও স্বত্বাধিকারী মোঃ রায়হান, মোরশেদ চৌধুরী, জুলফিকার আলী আরজু, কমরউদ্দিন আহমদ, খুররম শাহরিয়ার, মোঃ হান্নান, আঃ সালাম, জাফরী প্রমুখ। উল্লেখ্য, ’৭১-এর ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস বর্জন করে কুষ্টিয়া হাই স্কুল মাঠে সংগ্রামী ছাত্র, জনতা জয় বাংলা প্যারেড ও বিশাল সমাবেশের আয়োজন করে। ওই অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করে যথাক্রমে আব্দুল জলিল এবং সামসুল হাদী। পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কুমারখালী তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য গোলাম কিবরিয়া, আব্দুর রউফ চৌধুরী ও এ্যাডভোকেট আব্দুল বারী। ডেটলাইন ॥ ৩০ মার্চ এই দিন যুগপৎভাবে পাক হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করা হয়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে যত্রতত্রভাবে অত্যাচার-নির্যাতন এবং এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। কুষ্টিয়া শহরের সর্বস্তরের মানুষ ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কার্ফু শিথিল হলে সর্বস্তরের মানুষ শহর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে যেতে শুরু করে। আমরাও গড়াই নদী পার হয়ে গ্রামে চলে আসি। এখানে এসে সংগঠিত হতে শুরু করি এবং পাক সেনাদের প্রতিহত করার জন্য অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা সমবেত হই। সেখানে আমিসহ উপস্থিত ছিলেন এ্যাডভোকেট আব্দুল বারী, শেখ দলিল উদ্দিন, আব্দুল মোমেন, মির্জা জিয়াউল বারী নোমান, আঃ জলিল, মেজবাহ, কামালউদ্দিন, আঃ কাসেম, সামসুল হাদী (মৃত), আব্দুল্লাহেল বাকী, মোঃ খুররম শাহরিয়ার, কমরউদ্দিন আহমদ, ইহসানুল করিম হেলাল (প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব), জহুরুল, মাসুম, শেখ গিয়াসউদ্দিন মিন্টুসহ অনেকে। সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন কুমারখালীর তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য গোলাম কিবরিয়া। আলোচনায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যুগপৎভাবে একই সময়ে তিনদিক থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করা হবে। চুয়াডাঙ্গার ইপিআরের ক্যাপ্টেন এআর আজম চৌধুরী কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে ও সদর থানায় অবস্থিত পাক সেনাদের আক্রমণে নেতৃত্ব দেবেন। সুবেদার মোজাফফর পুলিশ লাইনের অবস্থিত পাক সেনাদের আক্রমণের নেতৃত্ব দেবেন এবং আড়ুয়াপাড়া ও ওয়্যারলেস স্টেশনে অবস্থানরত পাক সেনাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের নেতৃত্ব দেবেন নায়েক মনিরুজ্জামান। রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাকর্মীরা শহরের সংগ্রামী জনগণকে সংগঠিত করে চারভাগে বিভিক্ত হয়ে ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর বীর সদস্যদের সঙ্গে সহযোদ্ধা হিসেবে লড়াই করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০ মার্চ ভোর ৪টা হতে টানা ৩০ ঘণ্টা যুগপৎভাবে তিন দিক থেকে একই সময় বীরযোদ্ধা ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা পাক হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন এবং পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে কুষ্টিয়া শহর হানাদার মুক্ত করে। রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ও সংগ্রামী জনগণকে নিয়ে ৪ ভাগে বিভক্ত হয়ে বীরযোদ্ধা ইপিআর, আনসার ও পুলিশ বাহিনীর সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ করেন। গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ বন্দুক, ঢাল, সড়কি, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে শহর মুখরিত করে তোলে। ফলে পাক সেনাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। টানা ৩০ ঘণ্টা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল যার ফলে কুষ্টিয়া শহর ও শহরতলি সম্পূর্ণরূপে হানাদার মুক্ত হয়। শহরের নিরাপত্তা ও জনগণকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে কুষ্টিয়া ডাক বাংলোয় কন্ট্রোলরুম/সেলের সদর দফতর খোলা হয়েছিল। এই আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। এই অর্জনের সাফল্যে চির অম্লান হয়ে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। কুষ্টিয়ার সংগ্রামী ছাত্র, জনতা মুক্তিযুদ্ধে কোন না কোনভাবে অংশগ্রহণের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ। লেখক : যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা
×