ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পদ্মা সেতু ॥ অপ্রতিরোধ্য শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১ এপ্রিল ২০১৭

পদ্মা সেতু ॥ অপ্রতিরোধ্য শেখ হাসিনা

৬ জানুয়ারি ২০১৭-এ বাংলাদেশের পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক ও কানাডীয় পুলিশ কর্তৃক কানাডার এসএনসি লাভালীন কোম্পানির বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ সেদেশের আদালত মিথ্যা ও গালগপ্পসম বলে খারিজ করে দিয়েছে। কানাডার আদালতের এই রায় সকল সন্দেহের উর্ধে প্রমাণ করেছে যে, পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ বা অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ সরকার ও এসএনসি লাভালীন কোম্পানি এবং সম্ভাব্য ঠিকাদারদের তরফ থেকে কোন দুর্নীতিমূলক কাজ হাতে নেয়া বা সম্পন্ন করা হয়নি। পদ্মা সেতু একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপনা হিসেবে পরিকল্পিত হয়েছে। এই সেতু মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার সংযোগ স্থাপন করে দেশের পূর্ব-উত্তর অঞ্চলকে দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে পদ্মা সেতু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জযুক্ত নির্মাণ প্রকল্প। সেতুর উপরের অংশে চার লেন বিশিষ্ট সড়ক এবং নিন্মাশে এক রেল লেনের পথ তৈরি করা হবে। এই সেতুর মোট দৈর্ঘ্য হবে ৬১৫০ মিটার এবং প্রস্থ ১৮.১০ মিটার। এই সেতুর সংযোগ সড়ক হবে প্রায় ১৩ কিমি দীর্ঘ এবং এর জন্য প্রয়োজন হবে ১৪ কিমি দীর্ঘ নদী শাসনমূলক স্থাপনা। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকায় এটি হবে সবচাইতে বড় সেতু। এর জন্য ইতোমধ্যে প্রয়োজন হয়েছে সর্বমোট ১০৬২ হেক্টর পরিমাণ জমি অধিগ্রহণের। পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় প্রাক্কলিত হয়েছে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশে ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার বা দেশের শতকরা ২৯ ভাগ উপকৃত হবে বলে হিসাবকৃত হয়। বলা হয় যে, পদ্মা সেতু হলে বাংলাদেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন শতকরা ৩ ভাগ বাড়বে এবং সর্বমোট ৩ কোটি লোক উপকৃত হবে। এর আগে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু নির্মাণের ফলে বাংলাদেশে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন শতকরা ১.৫ ভাগ বেড়েছে বলে হিসাব করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে আলোচনাক্রমে এর জন্যে অর্থায়ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক (১.২ বিলিয়ন ডলার), জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এজেন্সি বা জাইকা (৫০০ মিলিয়ন ডলার), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (৫৫০ মিলিয়ন ডলার), ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক (১২০ মিলিয়ন ডলার) এবং আবুধাবী উন্নয়ন জোট (৩০ মিলিয়ন ডলার)। বাকি অংশ বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থায়ন করবে বলে স্থিরীকৃত হয়। বিদেশী অর্থায়নী প্রতিষ্ঠানসমূহ বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে তাদের সমঝোতা অনুযায়ী অর্থায়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সাধারণত বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্ব মেনে নেয়। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনাক্রমে এই প্রকল্প সম্পর্কিত সকল কাজ বাংলাদেশ সরকার শেখ হাসিনার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে ১৯৯৮-এ হাতে নেয় ও সম্পূর্ণ করতে থাকে। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের তরফ হতে করা অনুরোধ অনুযায়ী ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত জাপানী সাহায্য সংস্থা জাইকা এই সেতুর সম্ভাবনা সমীক্ষণ সম্পূর্ণ করে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকার এই সেতু নির্মাণে তেমন কোন আগ্রহ দেখায়নি। ২০০৯-২০১১ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে এই সেতুর বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন ও সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণাদি স্থিরীকৃত হয়। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নির্মাণ কাজ তত্ত্বাবধান সম্পর্কিত ৫টি প্রকৌশলী সংস্থার প্রস্তাব ও দরপত্র নিরিখ করা হয়। কাজের এই অংশের প্রকৃত মূল্য ৫০ মিলিয়ন ডলারে প্রাক্কলিত ছিল এবং এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য ৫টি আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠান থেকে দরপ্রস্তাব পাওয়া যায়। এই ৫টি প্রতিষ্ঠান হলো যথাক্রমে ১. এইচপিআর ২. এসএনসি লাভালীন ৩. এইকন ৪. হালক্রো ও ৫. ওরিয়েন্টাল। দরপত্রের প্রকৌশলীয় দিক থেকে দেশী ও বিদেশী বিশ্লেষকদের নিয়ে গঠিত মূল্যায়ন কমিটি এইচপিআরকে ১ম এবং এসএনসি লাভালীনকে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী বলে মত দেয়। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত এই কমিটিতে দেশের ৩ জন খ্যাতনামা প্রকৌশলী, বিশ্বব্যাংকের ১ জন এবং সরকারের ১ জন প্রতিনিধি ছিলেন। প্রকৌশলীয় বীক্ষণের পরে আর্থিক প্রস্তাবাদি বীক্ষণ করে হালক্রোকে প্রথম স্থান এবং এসএনসি লাভালীনকে দ্বিতীয় ও প্রকৌশলীয় বীক্ষণে প্রথম বলে বিবেচিত এইচপিআরকে তৃতীয় স্থান দেয়া হয়। এই দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে নিরিখ করে ২০১১-এর মার্চে প্রাপ্ত দরপত্রের ক্রম নতুনভাবে প্রকাশ করা হয়। কমিটির এরূপ বীক্ষণের প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংকের কাছে পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয়। বিশ্বব্যাংকের প্রাযুক্তিক কমিটি তুলনামূলক দরপত্রে প্রথমে প্রথম স্থান অধিকারীর ব্যয় উদ্ধৃতিতে কতিপয় অসম্পূর্ণতা শনাক্ত করে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী যথা লাভালীন প্রদত্ত দরের সঙ্গে তা তুলনীয় করে সংশোধন এবং উভয়ের নিযুক্তীয় নির্বাহীদের যোগ্যতা আবার যাচাই করার অনুরোধ জানায়। বিশ্বব্যাংকের অনুরোধ অনুযায়ী পর্যালোচনার পর মূল্যায়ন কমিটি লাভালীনকে প্রথম এবং এইচপিআরকে দ্বিতীয় যোগ্য দরপত্রদাতা বলে স্থির করে। ঘটনাক্রমে এটা সুস্পষ্ট যে, বিশ্বব্যাংকের সংশ্লিষ্ট নির্বাহীদের অনুরোধ অনুযায়ী দরপত্রদাতাদের চূড়ান্ত ক্রম নির্ধারিত হয়। বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু সম্পর্কিত বাস্তবায়ন বিভাগ দরপত্রদাতাদের এই চূড়ান্ত ক্রম অনুমোদন করে। এই পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের ন্যায়পরায়ণতা বিভাগ এসএনসি লাভালীনকে কাজ দেয়ার অনুকূলে কতিপয় অপচেষ্টার উড়ো খবর পেয়ে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় তাদের ভাষায় দুর্নীতির প্রমাণ পায় বলে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে জানায়। এসব উড়ো খবরের মধ্যে মূল্যায়ন কামটির জনৈক সদস্যের ডাইরীতে উল্লেখিত গৃহীত দরের শতকরা ৪ ভাগ পরিমাণ উৎকোচ হিসেবে বিতরণের সাঙ্কেতিকভুক্তি ছিল বলে বলা হয়। বিশ্বব্যাংকের বাস্তবায়ন বিভাগ অবশ্য এ সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের ন্যায়পরায়ণতা বিভাগের সঙ্গে একমত হয়ে কোন প্রতিবেদন উপস্থাপিত করেনি। তারা সুপারিশকৃত দরদাতাকে অনুমোদন করে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যথা প্রয়োজন পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করে। তথাপিও এর পরে ২০১১ সালের অক্টোবরে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন দুর্নীতির অভিযোগ তুলে স্থগিত করে। অন্যান্য সহযোগী অর্থায়নী প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে তাদের পূর্ব নির্ধারিত সমঝোতা অনুযায়ী এই সেতুর অর্থায়ন বিষয়ে বিশ্বব্যাংককে অনুসরণ করে। এর আগে সেপ্টেম্বর ২০১১-এ কথিত দুর্নীতি সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীকে অবহিত করে। তারা তাদের কথিত দুর্নীতির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সেতু বিভাগের সচিব, পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক, যোগাযোগমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসানকে লাভালীন কোম্পানির তিন কর্মকর্তার সঙ্গে দুর্নীতিতে জড়িত বলে জানান। এই অবহিতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক রফিকুল ইসলামকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত এবং সেতু বিভাগের সচিব মোশারফ হোসেনকে সেতু বিভাগ থেকে বদলি করে। তার পরে ৫ ডিসেম্বর যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের দায়িত্বে প্রযুক্ত যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই পদ থেকে ২০১২-এর ২৩ জুলাই তিনি পদত্যাগ করেন। ২০১২ সালের এপ্রিলে বিশ্বব্যাংক এক্ষেত্রে তাদের অবস্থান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকেও অবগত করে। বিশ্বব্যাংক এক বিবৃতিতে বলে যে, দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিলে তারা প্রকল্পটির জন্য ইতোমধ্যে স্থিরীকৃত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পরিবর্তন করে এটিকে এককভাবে চাবি ঘোরানো প্রকল্প হিসেবে তাদের নির্বাচিত (সম্ভবত) বিদেশী ঠিকাদারের মাধ্যমে বাস্তবায়নীয় স্থির করে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে। অন্য কথায়, বিশ্বব্যাংক কার্যকরণ সূত্র অনুযায়ী এককভাবে এই সেতু নির্মাণ সম্পর্কিত ঠিকাদার নিযুক্তকরণের সার্বিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের কর্তৃত্ব ও সিদ্ধান্ত ন্যায়পরায়ণতার প্রতিফলক হিসেবে বাংলাদেশ ও অন্য সংশ্লিষ্ট সহযোগী অর্থায়ন সংস্থাসমূহকে গ্রহণের জন্য চাপ দেয়। এই প্রেক্ষিতে তারা বাংলাদেশ সরকারকে দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি বিশেষ টিম দিয়ে কথিত দুর্নীতির তদন্ত করতে অনুরোধ করে এবং নিজেরা একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে উপরোক্ত তদন্তের যথার্থতা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেয়ার প্রস্তাব দেয়। অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক এজাহার দাখিল করে বাংলাদেশের ৭ ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমনমূলক অনুসন্ধান শুরু করে। এর বাইরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসানের ভূমিকাও তারা বীক্ষণ করবে বলে প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংক এক্ষেত্রে তাদের নেয়া অবস্থান ব্যাখ্যা করার জন্যে ঢাকাতে একটি টিম পাঠায় এবং এই টিমের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনা বা ব্যাংকের অবস্থান অনুযায়ী সিদ্ধান্ত না নেয়ার কারণে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রমকে অসন্তোষজনক বলে আখ্যায়িত করে। ফলত বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট জুয়েলিক জুন ২৯, ২০১২-এ বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের জন্যে প্রতিশ্রুত ১.২ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ অর্থায়ন চুক্তি বাতিল করে। এই প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক ঘোষণা করে যে, বিশ্বব্যাংক তাদের প্রাপ্ত দুর্নীতি বিষয়ক সাক্ষ্য ও তথ্যাদি বিবেচনা না করে তাদের দৃষ্টিতে আসা দুর্নীতির অভিযোগ অবজ্ঞা করতে পারে না। তারা এই ঘোষণায় বলে যে, এক্ষেত্রে তাদের নৈতিক বাধ্যবাধকতা বিদ্যমান এবং বিশ্বব্যাংকের শেয়ার মালিক ও বিশ্বব্যাংকের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্রদত্ত আর্থিক দায়িত্ব থেকে তারা দূরে সড়ে যেতে পারবে না। তারা আরও বলে যে, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহারকরণ এবং প্রকল্প অর্থায়নে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পথ অনুসরণ করা তাদের দায়িত্ব বলে বিবেচিত হওয়ার কারণে তারা পদ্মা সেতুর অনুকূলে অর্থায়ন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। এই পটভূমিকায় সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টিতে এসেছে যে, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন চুক্তি বাতিল করেন তৎকালীন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জুয়েলিক তার কার্যকাল শেষ হওয়ার মাত্র একদিন আগে। এই ঘটনার পরপরই জুয়েলিক ওবামার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রোমনীর প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতার প্রচার অভিযানে যোগ দেন এবং নিজেকে একজন দৃঢ় দুর্নীতিবিরোধী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছে তুলে ধরতে প্রয়াস পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তিদের মধ্যে সম্পাদিত ব্রেটেন উডস্ চুক্তি অনুযায়ী বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং অনুন্নত দেশসমূহের পুনর্বাসন ও উন্নয়নে অর্থায়ন করার জন্য মিত্রশক্তির উন্নত দেশসমূহ ঐকমত্যে পৌঁছে। পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাংক অনুন্নত দেশসমূহের উন্নয়নের জন্যে নি¤œতম সুদ এবং ব্যাপ্ত পরিশোধনকাল সংবলিত ঋণ ও অনুদান দেয়ার লক্ষ্যে আর্ন্তজাতিক উন্নয়ন সমিতি বা আইডিএ গঠন করে। তারও পরে উন্নয়নশীল দেশসমূহে ব্যক্তি-মালিকানাবিশিষ্ট শিল্প ও বাণিজ্য সংস্থাসমূহের অনুকূলে অর্থায়নের জন্যে উন্নত দেশসমূহ থেকে চাঁদা নিয়ে আন্তর্জাতিক অর্থায়ন প্রতিষ্ঠান (আইএফসি) গঠন করা হয়। বিশ্বব্যাংকের প্রথিতযশা প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা ১৯৬০-এর দশকে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক দরিদ্র দেশসমূহের অবকাঠামো উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্যে অধিকতর বিস্তৃত ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, অনুন্নত দেশসমূহের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের অবস্থান ও নীতি অনুযায়ী সহায়তা প্রদান এবং অর্থায়ন বিশ্বব্যাংকের মূলনীতি হওয়া সঙ্গত। এই প্রতিশ্রুতি ও বক্তব্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাংক আগের তুলনায় অধিকতর বিস্তৃতভাবে আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার দরিদ্র দেশসমূহে উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ, বিশেষত অবকাঠামো উন্নয়নমূলক স্থাপনাতে অর্থায়ন করতে থাকে। পরে ম্যাকনামারা প্রদর্শিত উন্নয়নের পথ থেকে তথাকথিত রিগানোমিকসের সূত্র ধরে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনায় ওয়াশিংটন মতৈক্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাংক ক্রমান্বয়ে অনুন্নত দেশে ব্যক্তি খাতের ভূমিকা বাড়ানো এবং ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে আইডিএ ও আইএফসির মাধ্যমে অধিকতর বিনিয়োগ প্রযুক্ত করার নীতি গ্রহণ করে। পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাথমিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকের কথিত দুর্নীতির অভিযোগ বাংলাদেশের দৃঢ়চেতা প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। একই সঙ্গে তিনি বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ অনুযায়ী দেশের দুর্নীতি দমন কমিশনকে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক এক্ষেত্রে সরবরাহকৃত তথ্যসমূহ তদন্ত করে দুর্নীতি যদি হয়ে থাকে তাহলে তা এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ অনুযায়ী এদেশের দুদক সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য বিশ্লেষণ করে ২০১২-এর ২ জানুয়ারি এক্ষেত্রে কোন দুর্নীতি হয়নি বলে বিদিত করে। সংশ্লিষ্ট দরপত্রে অংশগ্রহণকারী সকল ঠিকাদারী ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এই প্রক্রিয়ায় প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয় যে, বাংলাদেশের কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে ঘুষ বা অবৈধ প্রাপ্তির কোন দাবি উঠেনি বা অনুরোধ করা হয়নি। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি লাভালীন এবং তার দুই শীর্ষ কর্মকর্তা ও একজন কানাডীয় বাঙালীকে কানাডাস্থ আদালতে সে দেশের শীর্ষ পুলিশ বিভাগের মাধ্যমে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে। সংশ্লিষ্ট কানাডীয় আদালত ২০১৭-এর ১০ জানুয়ারি এক্ষেত্রে বা বিষয়ে কোন দুর্নীতি হয়নি বলে রায় প্রদান করে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ তথা লাভালীনের মোহাম্মদ ইসমাইল, রমেশ শাহ ও কেভিন ওয়ালেসকে বেকসুর খালাস দেয়। একই আদালতে এর আগে এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির দায় হতে বাংলাদেশের আবুল হাসান চৌধুরীকে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল। ফলত দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের কোন নাগরিককে এ মামলায় আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত করা যায়নি। যেহেতু কথিত দুর্নীতিতে যে কোম্পানির (এক্ষেত্রে লাভালীন) লাভবান হওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল তা আদালত কর্তৃক গৃহীত হয়নি, সেহেতু এদের সাথে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে উল্লেখিত বাংলাদেশের নাগরিকগণ প্রকৃতই দুর্নীতিতে জড়িয়েছিলেন বলে প্রমাণিত হয়নি। এই দুর্নীতির কথিত ঘটনাক্রমে বাংলাদেশ থেকে যারা এ বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করেছিল বলে বিশ্বব্যাংকের ন্যায়পরায়ণতা বিভাগ জানিয়েছিল, তাদের আদালতে শনাক্ত করতে বিশ্বব্যাংক ব্যর্থ হয়। বিশ্বব্যাংকের ন্যায়পরায়ণতা বিভাগ থেকে তাদের তদন্ত কর্মকর্তা হাইজ এসব তথ্য বাংলাদেশ থেকে কে বা কারা সংগ্রহ করেছিলেন সে সম্পর্কে কোন কিছু নির্দিষ্ট করে বা তাদের শনাক্তকারীদের তাদের নাম ও কর্মবৃত্তের আলোকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়। কানাডীয় পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনেও সুনির্দিষ্টভাবে তথাকথিত তথ্য সরবরাহকারীদিগকে শনাক্ত করা যায়নি বা হয়নি। সেতু প্রকল্পটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন বাঙালী নির্বাহীর ডাইরীর ভুক্তিÑ সাঙ্কেতিকভাবে দুর্নীতি উৎসারিতব্য সংখ্যাÑ তারা প্রমাণ তো দূরের কথা তুলেও ধরতে পারেনি। কেবল লাভালীন কোম্পানির একজন হিসাবরক্ষক সেই কোম্পানির আফ্রিকায় কোন এক প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০ বছর আগে সম্পাদিত হিসাবের চুক্তি উল্লেখ করে সেই কোম্পানির দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আইনের চোখ অগ্রহণযোগ্য অবয়বে উপস্থাপিত করে। এর আগে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনের পর লাভালীন কোম্পানি তাদের মুখ্য নির্বাহীকে অপসারণ করেছিল এবং দুর্নীতি প্রমাণে বিশ্বব্যাংককে সবরকম সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এ সকল বিবেচনা করে কানাডীয় আদালতের বিচারক আয়ান নর্ডহেইমার কানাডীয় পুলিশকে দিয়ে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পেশকৃত অভিযোগটি প্রত্যাখ্যান করেন। বিচারক নর্ডহেইমার আদালতে উত্থাপিত অভিযোগটিকে গালগপ্প ও গুজব হিসেবে আখ্যায়িত করেন। চলবে....
×