ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে কে থাকে খবর রাখে না কেউ

বাঙালীর সমাজ জীবনে কুটুম্বিতা হারিয়ে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১ এপ্রিল ২০১৭

বাঙালীর সমাজ জীবনে কুটুম্বিতা হারিয়ে যাচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া ॥ কুটুম্ব এসেছে। আত্মীয় এসেছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। ঘরে সুখের পরশ। ছোটদের আনন্দের ঢেউ। বাড়ির কর্তা ও গৃহিণীর আপ্যায়নের কত আয়োজন। কুটুম্বকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো। দর্শনীয় স্থান দেখা। কখনও নৌকায় চড়ে উদ্দেশ্যহীন ভ্রমণ। প্রকৃতির সান্নিধ্য পাওয়া। দিন কয়েক থেকে কুটুম্বের বিদায়ের পালায় অশ্রুর ধারা। ফিরতি আমন্ত্রণ। বাঙালীর সমাজ জীবনের এমন কুটম্বিতা আজ দূর অতীত। ঢাকা মহানগরীতে কুটুম্বিতা পালিয়েছে সেই কবে। ফ্ল্যাট বাড়ির ফ্ল্যাটে কে থাকে তার খবর কেউ রাখে না। ধানম-ি আর আবাসিক এলাকা নয়। বাণিজ্যিক এলাকা হয়ে ঘিঞ্জি। একই অবস্থা বনানী গুলশানের। বারিধারা ডিপ্লোমেটিক জোন। লালমাটিয়া মোহাম্মদপুর শ্যামলী মগবাজার মালিবাগ মীরপুর মহাখালী খিলগাঁও বাসাবো শাজাহানপুর সূত্রাপুরসহ চারধারে কংক্রিটের বনে জনারণ্য। সহমর্মিতা দূরে থাক, কেউ কারও খবর রাখে না। মনে হবে লাখো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। দেশের অন্যান্য নগরীগুলোতে পাড়া-পড়শীদের মুখ দেখাদেখি পর্যন্তই। খুব বেশি হলে একটু হাসি বিনিময়। পরিচিতজনের সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হলে কেমন আছেন প্রশ্নের উত্তরে সর্বজনীন উত্তর ‘ভাল’। কে যে কত ভাল আছে তার হিসেব কেউ রাখে না। জীবন অস্থির। একটু সুখ খুঁজে নিতে প্রাণের কতই না আকুলতা। কোন ছন্দ নেই। ভাবের আদান প্রদান নেই। সময় কোথায়! মনে হবে জীবনের মধ্যে একটি সফটওয়্যার অটো কন্ট্রোলে চলছে। সকাল হয়। তারপর কখন যে রাত নামে। এমনি করেই দিন মাস বছর যুগ চলে যায়। মনে হবে এই তো সেদিন! এই সেদিন কতদিন তার হিসেব করলে দীর্ঘশ্বাস। টাইম এ্যান্ড টাইড ওয়েট ফর নান (সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না)। একটা সময় পারিবারিক বন্ধনে এক অপরের বাড়িতে দিন কয়েকের জন্য বেড়াতে যাওয়া ছিল সামাজিক বন্ধনের একটি বড় অংশ। আত্মীয় স্বজন দেশের যে প্রান্তেই থাক এমন বন্ধন টিকিয়ে রাখত। আজ সেই বন্ধন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। সেদিনের কিছু দৃশ্য ছিল এমন- কুটুম্ব আঙিনায় পৌঁছাতেই গৃহকত্রী, ছেলেমেয়ে পড়শীরা তড়িঘড়ি গিয়ে অতিথি বরণে ব্যস্ত। এই অতিথি স্বজন। বাঙালীর সমাজ জীবনে নিকটজনের সঙ্গে দিন কয়েকের জন্য মিলিত হয়ে একসঙ্গে থাকা চিরন্তন এক মধুময়তা। যা হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত। ভালবাসার আবেগের এক ধরনের হৃদ স্পন্দন। ঘর হয়ে ওঠে সেই স্বপ্নময় রাজ্য। যেখানে হৃদয় ছোঁয়া কতই না কথা মালার গাঁথুনি। সেই কুটুম্বিতা আজ আর নেই। বর্তমানে যে কুটুম্বিতা আছে তার মাত্রা অনেকটাই ভিন্ন। অতি বয়স্ক মানুষেরা যেমন ভুলো মনের হয়, সহজে চিনতে পারে না, কোন জিনিস কোথায় রেখেছে তা সহজে মনে করতে পারে না, অনেক সময় চেনা পথ হারিয়ে ফেলে বর্তমানে কুটুম্বিতা এমনই। কেউ আর কারও খোঁজ রাখে না। পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগে একান্নবর্তী পরিবারগুলোয় যখন খ-িত হওয়ার পালা শুরু হলো তখন কুটুম্বিতার গাঢ় প্রকাশ ঘটতে থাকে। খ-িত পরিবারের সদস্যরা তখন বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। বনেদী পরিবার ও মধ্যবর্তী পরিবারের সদস্যদের অনেকে চাকরি নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেতে থাকে। সরকারী চাকুরেদের বদলি জনিত কারণে ঘুরতে হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। সম্পর্ক ঠিক রাখতে চিঠি অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করে। মাধ্যম হয় পোস্ট অফিস। কুটুম্বিতার প্রাথমিক অধ্যায় শুরু এখানেই। তারপর বছরের কোন না সময় একে অপরের বাড়িতে পরিবার পরিজন নিয়ে যাওয়া। কে কখন কোথায় যাবে তার দিন তারিখ ঠিক করে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠি পাওয়ার পর শুরু হয় কাউন্ট ডাউন (ক্ষণ গণনা)। আত্মীয় স্বজন বেড়াতে আসার কথা শোনার পরই পরিবারের শিশু কিশোরদের সে কি আনন্দ। পরিবার কর্তা কত্রীর প্রস্তুতি নেয়ার পালা শুরু হয়। কে কোথায় কোন ঘরে থাকবে। কুটুম্ব বেশি এলে ফ্ল্যাট বিছানারও আয়োজন করা হয়। খাবার দাবেরর মেনু একেক দিন একেকটা। মাছ গোশত পোলাও কোর্মা থাকে মেনুতে। কাছে পুকুর থাকেল মাছ ধরা। শীতের সময় হলে পিঠা পুলি বানিয়ে সকলে একসঙ্গে বসে খাওয়া। কুটম্বরা যে শুধু বসে থাকবে তাও নয়। রান্না-বান্নায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। কাছে নদী থাকেল নৌকা ভ্রমণ। আশপাশে বেড়ানোর জায়গা থাকলে সকলে মিলে ঘুরে আসা। কেরাম লুডু ব্যাডমিন্টন কানা মাছি লুকোচুরি খেলা কোনটিই বাদ যায় না। পরিবারের সদস্যদের কেউ গান জানলে উঠানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। সেই অনুষ্ঠানে পড়শীদের আমন্ত্রণ জানানো। কুটুম্বিতার আনন্দগুলো ভাগাভাগি করে নেয়া হয়। দিন কয়েক মহা আনন্দের পর এক পর্যায়ে চলে আসে বিদায়ের ক্ষণ। শিশু কিশোররা লুকিয়ে কাঁদতে থাকে। বড়দেরও চোখের কোনে নেমে আসে জল। বিদায়ের ক্ষণে একে অপরকে জড়িয়ে দু’ফোটা চোখের জল ফেলে। প্রতিশ্রুতি নিয়ে যায় ফিরতি কুটুম্বিতার। দিন কয়েকের হৈ হুল্লোরের রেশ সহজে কাটে না। বাড়িটি ফাঁকা মনে হয়। তারপর নিয়মের আপন গতিতে সব ঠিক হয়ে যায়। ইংরেজীর সেই কথার মতো ‘টাইম হিলস অল সরোজ’। আজকের দিনে সেদিনের সেই কুটুম্বিতা নেই। আছে ভিন্নভাবে। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রযাত্রায় সেই কুটুম্বিতার সময় বা কোথায়। কোচে ট্রেনে নিজেদের গাড়িতে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হয় সঙ্গে অনুসঙ্গের কাজ নিয়ে। কাজও হয়। দুয়েক দিন থাকা হয়। এই থাকা যান্ত্রিক জীবনের পার্ট। সময় করে ঘুরে বেড়ানোর সময় বুঝি এখন আর নেই। আত্মীয়তার বন্ধনও এখন অনেক শিথিল। বিয়ে শাদির বেলায় নতুন কুটুম্ব তৈরিতেও সেই হৃদতা নেই। দূর থেকে কাছে টেনে নেয়ার পালায় অনুভব করা যায় কোন এক অদৃশ্য কাঁচের দেয়ালের। বর্তমানের কুটুম্বিতা এই পর্যায়েই এসেছে। হৃদয়ের আবেগের মধুময় বন্ধনের আর্টারিগুলো ব্লক হয়ে যাচ্ছে। যেখানে হৃদয়ের মধুমাখা কথাগুলো যেন কৃত্রিম। দেখা সাক্ষাত হচ্ছে, কথা হচ্ছে, আপ্যায়নও হচ্ছে। মনে হবে তার মধ্যে মেলোডি সুরের ছন্দ নেই।
×