ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শোকের ছায়া

চির নিদ্রায় শায়িত র‌্যাবের গোয়েন্দা প্রধান আজাদ

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১ এপ্রিল ২০১৭

চির নিদ্রায় শায়িত  র‌্যাবের গোয়েন্দা  প্রধান আজাদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) গোয়েন্দা শাখার প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদকে বনানীর সামরিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে। শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে তাকে সামরিক রীতিতে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে দাফন করা হয়। এ সময় তাকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। র‌্যাব সদর দফতর ও ঢাকা সেনানিবাসে তার দু’দফা জানাজার পর বনানীতে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। জানাজায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল,পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক, র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ র‌্যাব-পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও সশস্ত্র বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ, আত্মীয়স্বজন, শুভানুধ্যায়ী ও গণমাধ্যম কর্মী উপস্থিত ছিলেন। এর আগে সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আজাদের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। বৃহস্পতিবার রাত বারোটা ৫ মিনিটের দিকে সিএমএইচে চিকিৎসাধীন কর্নেল আজাদের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুতে র‌্যাব, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও আত্মীয়স্বজনের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। বনানীতে দাফন সম্পন্ন করার সময় তার দুই শিশুপুত্র ও এক কন্যার অঝোর কান্নায় সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। দাফন শেষে তার সন্তানদের কাছে তুলে দেয়া হয় সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের পতাকা। ১৯৭৫ সালের ৩০ অক্টোবর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জের মনকষা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে লে. কর্নেল মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৯৬ সালে ৭ জুন ৩৪তম বিএমএ দীর্ঘমেয়াদী কোর্সে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন। কমিশন পরবর্তী তিনি ৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আইও, এ্যাডজুট্যান্ট এবং কোয়ার্টারমাস্টারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি সেনাসদর, প্রশাসনিক শাখায়, ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন এবং ১৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে (সাপোর্ট ব্যাটালিয়ন) বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একজন কমান্ডো। ২০০৫ সালে তিনি সিলেটের জালালাবাদ সেনানিবাসে প্যারাট্রুপারে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্যারাকমান্ডো হিসেবে উত্তীর্ণ হন। ২০১১ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি র‌্যাব-১২ এর কোম্পানি অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একই বছর ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৩ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত র‌্যাব ফোর্সেস সদর দফতরে ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের (টিএফআই সেল) উপপরিচালক এবং ২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে এই উইংয়ের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। দীর্ঘ ৫ বছর ৪ মাস র‌্যাবে কর্মরত থেকে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠা, দক্ষতা, আন্তরিকতা, সুনামের সঙ্গে পালন করেছেন। সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকার জন্য তিনি বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম-সেবা) এবং প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (পিপিএম) পুরস্কারে ভূষিত হন। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন বিশেষ করে জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ ও হিযবুত তাহরীরের সদস্যদের গ্রেফতারের ব্যাপারে লে. কর্নেল আজাদের অবদান রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং দুই পুত্রসন্তান ও এক কন্যাসন্তানের জনক। তিনি থাকতেন মিরপুরের একটি বাসায়। কর্মজীবনে ব্যস্ত এ মানুষটি গত শনিবার সন্ধ্যায় সিলেট মহানগরের দক্ষিণ সুরমায় জঙ্গী আস্তানার পাশে বোমা বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন। ওই রাতে তাকে হেলিকপ্টারে সিএমএইচে নিয়ে আসা হয়। পরদিন সন্ধ্যায় এয়ার এ্যাম্বুলেন্সযোগে সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে বুধবার চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে ঢাকায় এনে আবারও সিএমএইচে রাখা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন বৃহস্পতিবার রাতে মারা যান তিনি। শুক্রবার সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়। সকাল পৌনে দশটার দিকে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডাঃ সোহেল মাহমুদ। ময়নাতদন্ত শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানান, লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বোমা বিস্ফোরণের কারণেই মারা গেছেন। তার দেহে বোমা বিস্ফোরণের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। মাথা থেকে বোমার স্পিøন্টারের টুকরা উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া বোমার স্পিøন্টার মাথা দিয়ে ঢুকে যাওয়ায় তার বাঁ চোখ বিনষ্ট হয়ে গেছে। র‌্যাব পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, বৃহস্পতিবার রাত অর্থাৎ শুক্রবার প্রথম প্রহর বারোটা ৫ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসকরা র‌্যাবের গোয়েন্দাপ্রধান লে. কর্নেল মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি হাসপাতালে লাইফসাপোর্টে ছিলেন। শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে নিহত আবুল কালামের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসে ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশ। সকাল নয়টার দিকে ডাঃ সোহেল মাহমুদ ময়নাতদন্ত শুরু করেন এবং শেষ হয় পৌনে দশটার দিকে। উল্লেখ্য, সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানার শিববাড়ী এলাকায় জঙ্গীবিরোধী অভিযানের সময় গত ২৫ মার্চ রাতে একটি বোমা বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন আবুল কালাম আজাদ। এর পাঁচদিন পর তার মৃত্যু হলো। এ নিয়ে বিস্ফোরণের ওই ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল সাতে। ঘটনার পরপর দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ জন নিহত হন। সে সময় আহত হন র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের গোয়েন্দা প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদসহ ৪২ জন। পরে আহত আজাদকে সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে রাতেই তার মাথায় বেশ কয়েকটি সার্জারি হয়। এরপর হেলিকপ্টারযোগে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। অবস্থার উন্নতি না হলে গত ২৬ মার্চ তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তাকে লাইফসাপোর্টে রাখা হয়। ২৯ মার্চ আবুল কালাম আজাদকে লাইফসাপোর্টে রাখা অবস্থাতেই এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। দুদিন পর বৃহস্পতিবার রাতেই ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অসুরকে দমন করবই ॥ র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদের খুনীদের বিনাশ করা হবে। তার মৃত্যু যেমন বেদনা দেয় তেমনি শোক পরিণত হয়েছে শক্তিতে- এ কথা বলেছেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ্ও্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। শুক্রবার ফেসবুক স্টেটাস পুলিশের এ কর্মকর্তা প্রয়াত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজাদের কথা স্মরণ করে আবেগময় কিছু কথা বলেছেন। যা পাঠকের জন্য তুলে দেয়া হলো। ‘সকলকে কাঁদিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে চিরবিদায় নিলেন প্রিয় সহযোদ্ধা লে. কর্নেল আজাদ! সহযোদ্ধার মৃত্যু বেদনা দেয়- একথা যেমন সত্য তেমনি সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করে মানবকুলে সৃষ্ট দানব ধ্বংসে আমাদের আরও বেশি সংকল্পবদ্ধ করে! আজাদ, আপনাকে ফিরে পাব না জানি কিন্তু কথা দিচ্ছি আপনার হত্যাকারীদের রক্ষা নেই। সমূলে তাদের বিনাশ অনিবার্য করে তুলবই! আপনার স্মৃতি বুকে ধারণ করেই অসুর দমনে এগিয়ে যাচ্ছি, যাব। এমন ভাই হয় না ॥ শুক্রবার বিকেলে যখন র‌্যাব্ সদর দফতরে দ্বিতীয় দফা জানাজার প্রস্তুতি চলছিল তখন সেখানে আবুল কালাম আজাদের বড় ছেলে আফনান ইশরাত জারিফকে নিয়ে হাউমাউ করে বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন ভাই ইউসুফ হিমেল। তিনি ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে করতে বলেন, আমার ভাই রাসেল (ডাকনাম) খুবই ভাল মানুষ ছিলেন। এমন ভাই হয় না, শুধু ভাই বলে বলছি না- তিনি গণমানুষের কাছেই ভাল মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন। তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল গত বুধবার রাতে। তিনি রাত সোয়া বারোটার দিকে বাসায় ফেরেন। কিন্তু রাত দেড়টার দিকে কাজের কথা বলে ফের বেরিয়ে পড়েন। এরপর আর বাসায় ফেরেননি তিনি। ইউসুফ হিমেল বলেন, তিন শিশুকে নিয়ে এখন কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। জারিফ তবুও কিছুটা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু মেয়ে জারা ও জারি কিছুই বুঝে না। ওরা বুঝতে পারছে না ওদের বাবাকে আর কখনও দেখা যাবে না। ছোট ছেলে জারির বয়স এখন ২ বছর তিন মাস। ও শুধু ‘পাখি’ও ‘ভাইয়া’ ডাকতে পারে। বাবা ও মা কাউকে এখনও ডাকা শেখেনি। কিন্তু যখন বাবা ডাক শিখবে তখন জারির আর বাবাকে দেখতে পাবে না। বাবার আদর, স্নেহ, ভালবাসা কিছুই জুটবে না ওর কপালে। শীঘ্রই নিয়ন্ত্রণে আসবে ॥ র‌্যাব সদর দফতরে জানাজা শেষে অচিরেই দেশের সন্ত্রাসী ও জঙ্গী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন-নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করেন, যা সব সময়ই করে থাকেন তারা। যাকে যখন প্রয়োজন তাকে তখন ডাকা হয়। অচিরেই সন্ত্রাসী ও জঙ্গীদের কন্ট্রোলে (নিয়ন্ত্রণে) নিয়ে আসব বলে আশা করছি। আমরা একরকম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি-বেনজীর ॥ জানাজার সময় সংক্ষিপ্ত কথায় চলমান জঙ্গীবিরোধী অভিযান, জঙ্গীদের আত্মঘাতী হওয়া ও তাদের বোমা বিস্ফোরণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিহত হওয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, আমরা একরকম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। জাতীয় পার্টির শোক ॥ র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদের মৃত্যুতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শুক্রবার এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, লে. কর্নেল আজাদের অকালমৃত্যুতে মনে হলো আমি যেন আমার পরিবারের আরও এক সদস্যকে হারিয়েছি।
×