ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাচীন বাহন গরুর গাড়ি

ওকি গাড়িয়াল ভাই কতো রবো আমি পন্থের পানে চাইয়া রে...

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১ এপ্রিল ২০১৭

ওকি গাড়িয়াল ভাই কতো রবো আমি পন্থের  পানে চাইয়া রে...

সমুদ্র হক ॥ কাঠের বিশাল চাকার ক্যাঁ-এ্যাক- ক ক্যাঁ-এ্যাক শব্দের গরুর গাড়ি আজ আর নেই। প্রযুক্তির পালা বদলের সঙ্গে সেদিনের সেই গরুর গাড়িও আজ আধুনিকায়ন হয়েছে। যোগাযোগের অতি প্রাচীন বাহন এই গরুর গাড়ি। পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের এই গাড়ি একদা শহরেও চলত। দূর অতীতে গ্রামের মানুষ কাঁচা সড়কে হেঁটেই ১০/১৫ মাইল পাড়ি দিত। আত্মীয় স্বজন অতিথিদের জন্য ব্যবস্থা ছিল গরুর গাড়ির। বিয়ে বাড়ির বর কনে ও লোকজনের পরিবহনে গরুর গাড়ি রিজার্ভ করা হতো। কৃষি পণ্যসহ নানা মালামাল পরিবহনে গরুর গাড়ি ছাড়া চলতই না। বর্তমানে আধুনিককৃত গরুর গাড়ি প্রত্যন্ত এলাকার বাহন। এই গরুর গাড়িকে নিয়ে রচিত হয়েছে কত গান কবিতা গল্প উপন্যাস। ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের সেই কালজয়ী গান ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই কতো রবো আমি পন্থের পানে চাইয়া রে/ ওহকি গাড়িয়াল ভাই হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে....’ গরুর গাড়িকে কিংবদন্তি করে দিয়েছে। শরৎচন্দ্রের দেবদাস উপন্যাসে শেষ অঙ্কে গরুর গাড়ি দেবদাসকে বহন করে নিয়ে যায় পার্বতীর বাড়ির অল্পদূরে বটগাছের নিচে। সেদিনের গ্রামীণ জীবনে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে কুটুম্বিতা, বাঙালীর উৎসব পার্বণে মেয়ে জামাইকে নাইওর নিয়ে যাওয়া, বিয়ে বাড়িতে বরকে নিয়ে যাওয়া হতো গরুর গাড়িতে করে। বিয়ের গরুর গাড়ি চেনা যেত সামনে কারও হাতে মিষ্টির হাড়ি দেখে। রোদ বৃষ্টি শীত থেকে রক্ষা পেতে গরুর গাড়িতে ছই লাগানো হয়। ষাটের দশকেও গ্রামের থানাগুলোতে ওসি ও পুলিশের বাহন ছিল বাইসাইকেল। দূরে গ্রামে তদন্তের জন্য ওসি সাহেবদের জন্য গরুর গাড়ি রিজার্ভ থাকত। গরুর গাড়ির চালককে বলা হয় গাড়োয়ান নামে। বাঁশে তৈরি ফ্রেমের সঙ্গে কাঠের বিশাল চাকার সামনে থাকে একটি জোয়াল। ওজন নিয়ন্ত্রণে চাকার দুই ধারে ভেতরের অংশে কাঠের তৈরি এক ধরনের কাঠামো এঁটে দেয়া হয়। এই গাড়িতে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের অংশটি বাঁশ বেতে তৈরি। ত্রিকোনা ও মোটা বাঁশ দিয়ে আঁটানো। জোয়ালটি দুই গরুর কাঁধের ওপর থাকে। মোটা রশি দিয়ে গরুর কাঁধ বেঁধে জোয়ালের ওপর দিয়ে রশি পার করে দেয়া হয় গাড়োয়ানের হাতে। গরু পেটানোর জন্য গাড়োয়ান একটি বেত নিয়ে হাই হাই হাইত হাইত বাইত বাইত ডাইন ডাইন বাম বাম এ ধরনের শব্দ করে এক জোড়া গরুর গতি পরিচালনা করে। গরু একটু ধীরে চললে শক্তি ফেরাতে পিঠে দেয়া হয় দুই তিনটা বেত্রাঘাত। এতেই গরু বুঝে নেয় গাড়োয়ান কতটা দক্ষ। বর্তমানে এই গরুর গাড়ির চাকা পাল্টে দেয়া হয়েছে। মোটর গাড়ির ছোট বড় টায়ারের চাকা বসানো হয়। মোটর গাড়ির এই চাকা বসিয়ে দিতে মোটর গাড়ির কিছু যন্ত্রাংশের দরকার হয়। বর্তমানে গ্রামের বেশিরভাগ সড়ক পাকা হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হওয়ায় মিনিবাস সিএনজি চালিত অটোরিক্সা ব্যাটারিতে চালিত অটোগাড়ি গ্রামের পথে চলাচল করে। গরুর গাড়ির সেদিনের সেই আবেদন আজ আর নেই। গরুর গাড়ি অনেক কমে গিয়েছে। তারপরও যমুনার চর এলাকা গ্রামের কাঁচা সড়কে গরুর গাড়ি আজও চলে। কাঠের চাকার গাড়ি টানতে গরুর বেশি কষ্ট। তা কমিয়ে দিতে ব্যবহার শুরু হয় মোটর গাড়ির চাকার। গরুর গাড়ি দ্রুত চলতে বর্তমানে এই আধুনিকায়ন হয়েছে। তা ছাড়া কাঠের চাকায় পাকা সড়কে চলতে রাস্তার ক্ষতি হয়। সেই দিক থেকেও গরুর গাড়ির চাকা পাল্টে দেয়া হয়েছে। বাকি সকল কাঠামো একই রয়েছে। এই গরুর গাড়ির ইতিহাস অনেক প্রাচীন। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই ছিল গরু ও মহিষের গাড়ি। ১৫ শতকেই ভারতবর্ষে গরুর গাড়ির প্রচলন। গরুর গাড়ির সবচেয়ে ব্যবহার ছিল পাঞ্জাব রাজ্যে। রাজস্থান বিহার উড়িষ্যা হরিয়ানা মেঘালয় ত্রিপুরা এলাকাগুলোতে এক সময়ের একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম আজও বিদ্যমান। গরুর গাড়ি ও মহিষের গাড়ির ধরন প্রায় একই। কোনটি দুই গরুতে চালিত কোনটি দুই মহিষে চালিত। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি গরুর গাড়ি ছিল নীলফামারীর চিলমারী ডিমলা জলঢাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, নওগাঁর পোরশা পত্নীতলা মহাদেবপুর পাবনার সুজানগর আটঘরিয়া চাটমোহর এলাকা। বগুড়ার পূর্বাংশের গাবতলি সোনাতলা শিবগঞ্জ এলাকাগুলোতে গরুর গাড়ির আধিক্য বেশি। আবার বগুড়ার পশ্চিমাংশের কাহালু দুপচাঁচিয়া নন্দীগ্রাম এলাকার ছিল মহিষের গাড়ি। আজও গরুর গাড়ি ও মহিষের গাড়ির চলাচল দেখে দুই অঞ্চলকে পৃথক করা যায়। বগুড়া শহরের কাটনারপাড়া এলাকার এক মহল্লা গাড়োয়ান পট্টি হিসেবে আজও পরিচিতি বহন করছে। একটা সময় ঘোড় দৌড়ের মতো গরুর গাড়ির দৌড় প্রতিযোগিতা হতো। ভারতের অনেক রাজ্যে আজও গরুর গাড়ির দৌড়ের আয়োজন করা হয়। বিংশ শতাব্দীতেও সিঙ্গাপুরে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল। ঘোড়ার রেসের মতো এক সময় বিদেশে গরু ও গরুর গাড়ির রেস হতো। আধুনিক গরুর গাড়ির রেস বিনোদন দেয়। বগুড়ার শিবগঞ্জ এলাকায় বাংলা বর্ষবরণে গরু ও মহিষের গাড়ির দৌড় প্রতিযোগিতা হয়। বিনোদন ও পরিবহনে গরুর গাড়ি আসন করে নিয়েছে।
×