আরাফাত মুন্না, কুমিল্লা থেকে ফিরে ॥ কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার পরাজয়ের কলকাঠি নাড়লেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারই। সীমার নির্বাচনী প্রচারের সময় মেয়ে তাহসিন বাহার সূচনাকে মাঠে নামানোও আইওয়াশ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এমপি বাহার ও আফজাল খান গ্রুপের কোন্দলই কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের পরাজয়ের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তারা। এছাড়া নেতাকর্মীদের মধ্যে সমন্বয় হীনতা, কুমিল্লার প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল খান পরিবারের দখল-দুঃশাসনও তার মেয়র পরাজয়ের নেপথ্যে কাজ করেছে।
এদিকে, বৃহস্পতিবার রাতে ফল ঘোষণার সময় কুমিল্লা টাউন হলের সামনে গলায় নৌকার ব্যাচ লাগিয়ে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর বিজয় উল্লাস করতে দেখা গেছে অন্তত ৫০ জনকে, যারা এমপি বাহারের কর্মী বলে নিশ্চিত করেছেন (২ পৃষ্ঠা ১ কঃ দেখুন) কুমিল্লায় আওয়ামী
(প্রথম পৃষ্ঠার পর)
স্থানীয়রা। তারা বলেন, এইসব কর্মীরা পুরো নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে থাকলেও নৌকার পক্ষে ভোট চাইতে দেখা যায়নি তাদের। এদের মতো এমপি বাহারের সব কর্মীই তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ভোটের দিন পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় ছিল।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও মনে করেন, দলীয় সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহার ও তার অনুসারীদের অসহযোগিতার কারণেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারতে হয়েছে। তবে, নৌকার এই পরাজয়ের পেছনে স্থানীয় দলীয় নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয়তাকেই দায়ী করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুমিল্লা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, দলীয় প্রার্থী স্বচ্ছ ইমেজের হলেও তার বাবা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা প্রবীণ রজানীতিবিদ এ্যাডভোকেট আফজল খান ও বাহাউদ্দিনের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণেই কুমিল্লায় ক্ষমতাসীন দলকে হারতে হয়েছে। আফজল-বাহার দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করে তারা জানান, কুমিল্লায় নৌকার ভোট বেশি হলেও দ্বন্দ্ব-কোন্দল যতদিন শেষ হবে না, ততদিন নৌকাকে এভাবে হারতে হবে, তা আবারও প্রমাণিত হলো।
এদিকে বৃহস্পতিবার ফল ঘোষণার সময়ে তাৎক্ষণিক পর্যালোচনা করেছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সন্ধ্যায় কুমিল্লার ভোট নিয়ে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ধানম-ির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত পর্যালোচনা বৈঠকে বাহাউদ্দিনকেই দায়ী করেছেন। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সম্পাদকম-লীর সদস্য জানান, এই হারের পেছনে কুমিল্লা দক্ষিণের সভাপতি পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও কিছুটা দায়ী। নির্বাচনে জেতার জন্য তার যতটা সক্রিয় হওয়ার কথা ছিল, তিনি ততটা সক্রিয় হননি। বৈঠকে বলা হয়, বাহার উদ্দিন কাউন্সিলর প্রার্থীদের জন্য যতটা সক্রিয় ছিলেন, মেয়র-প্রার্থীর জন্য ততটাই বিপরীত অবস্থানে ছিলেন।
ভোটের দিন যেসব ওয়ার্ডে দলের সিনিয়র নেতারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেছেন নৌকার সমর্থকরা। কুমিল্লার ২৭ ওয়ার্ডে প্রায় ৪০ হাজার সংখ্যালঘু ভোটার রয়েছেন। তারা আওয়ামী লীগ করলেও তাদের অনেকেই নৌকার পক্ষে ভোট দেননি। কেউ-কেউ ভোট দিতেই আসেননি। সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কুমিল্লা আওয়ামী লীগের রাজনীতি যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, বিভিন্ন কারণে তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
পরাজয়ের কারণ হিসেবে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র নৌকার পরাজয়ের অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। বঙ্গবন্ধুর কন্যা আমাকে মনোনীত করেছিলেন। নৌকা প্রতীক আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আওয়ামী লীগের কিছু ব্যক্তি বিশেষের ষড়যন্ত্রের জন্য আমি শেখ হাসিনার কাছে আজ লজ্জিত।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সমন্বয়ের দায়িত্ব পালনকারী আওয়ামী লীগ নেতা একেএম এনামুল হক শামীম সাংবাদিকদের বলেন, কুমিল্লার রাজনৈতিক গ্রুপিংয়ের কারণেই আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছে। কারও নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, সীমার পক্ষে প্রচারের সময় আমরা অনেক অসহযোগিতার শিকার হয়েছি।
কুমিল্লা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান সমন্বয় ও দলের সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফরউল্ল্যাহ বলেছেন, নৌকার বিপক্ষে ছিলেন কাউন্সিলররা ও সদর আসনের এমপি। আমরা কিভাবে জিতব? ১১ তারিখ পর্যন্ত কুমিল্লায় নৌকার কোন অবস্থান ছিল না। আমরা দৌড়ঝাঁপ করে অবস্থার পরিবর্তন করেছিলাম। বাহার যদি আমাদের সহযোগিতা করতেন, তাহলে আমরা ভালভাবে জিততে পারতাম।
সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করে জনকণ্ঠকে বলেন, কর্মীদের আরও সক্রিয় হওয়া দরকার ছিল। ঢাকা থেকে যেসব কেন্দ্রীয় নেতারা এসেছিলেন, তারাসহ আমাদের সবারই আরও এ্যাকটিভ হওয়া দরকার ছিল। ভোটের জন্য কাউকে বলে বা বাধ্য করে ভোট আদায় করা যায় না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে আমার বিরুদ্ধে যেসব কথা বলা হয়, সেগুলো একেবারেই অপপ্রচার।
তিনি বলেন, আমি একজন সংসদ সদস্য। সে হিসেবে আমি প্রকাশ্যে নির্বাচনের প্রচারে নামতে গেলে নির্বাচনী আচরণ বিধি অনুযায়ী সমস্যায় পড়ি। আমি নিজে মাঠে নামতে পারিনি বলে আমার মেয়েকে মাঠে নামিয়েছি। ও সীমার সঙ্গে মাঠে কাজ করেছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কাজী জাফরউল্ল্যাহ সাহেব সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি ভালভাবে সমন্বয় করতে পারেননি। ওনার কথামতো সংখ্যালঘু ভোটারদের নিয়ে আমি একটা মিটিংও দিয়েছিলাম, কিন্তু সেইদিন উনি নিজেই আসেননি। সবাই মিলে ভালভাবে কাজ করতে পারলেই কুমিল্লায় নিজেদের জয় হতো বলে মনে করেন কুমিল্লার এই প্রভাবশালী সংসদ সদস্য।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: