ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মিরাজুল ইসলাম

ধা রা বা হি ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ৩১ মার্চ ২০১৭

ধা  রা  বা  হি  ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

(পূর্ব প্রকাশের পর) কি সেটা? আপনি তো জানেন শাহজাদা মুরাদের গুপ্তচররাও দিল্লি ও আহমেদাবাদের মধ্যে সংবাদ চালাচালি নিয়ে ব্যস্ত থাকে, এবং প্রায়ই আমাদের গুপ্তচরদের হাতে ধরা খায়। আওরঙ্গজেব এই প্রসঙ্গে মীর জুমলার কথায় হাসি ঠেকাতে পারলেন না। - বেচারা ভাই আমার। সে নিজেও জানে না তার গুপ্তচরদের আরো বেশী স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে আমরা তার সব খবর আগেই পেয়ে যাই।- জী হুজুর। এ ক্ষেত্রে হবে উল্টো।- মানে? বিস্মিত হন আওরঙ্গজেব। - সুজার নিজেকে সম্রাট ঘোষণার দিন-তারিখ হিসেব করে তার পূর্ববর্তী তারিখ দিয়ে দারার হাতের লেখা ও সীলমোহর কঠিনভাবে নকল করে একটা চিঠি আমরা বানাবো। এই নকল চিঠিতে শাহজাদা দারা লিখবেন সুজা’কে দিল্লির ক্ষমতা ভাগাভাগিতে মুরাদকে কি ভাবে নিঃশেষ করা যায়। তারপর সেই নকল চিঠি নিয়ে যাওয়া আমাদের দূত ইচ্ছে করে ধরা খাবে দিল্লির কাছে মুরাদের গুপ্তচরদের হাতে। - মুরাদ কি টের পাবে না পুরো ঘটনা বানোয়াট? - মোটেও না। খুব সূক্ষ্ম কারসাজি থাকবে সে টেরও পাবে না। আর তার সভাসদরা কেউ টের পেলেও ভয়ে মুখ খুলবে না। আলী নকীর পরিণতি তো নিজের চোখেই গুজরাটবাসী দেখলো, তাই না? - সুবহানাল্লাহ! কি বুদ্ধি না বের করলেন আপনি। আওরঙ্গজেব নিজ আসন হতে উঠে এসে আলিঙ্গন করলেন মীর জুমলাকে। - আশা করি তখতে আসীন হবার পর এই বান্দাকে আপনার মনে থাকবে। স্মিত হাসলেন মীর জুমলা। - সেটা আপনাকে বলতে হবে না। মনে রাখবেন, আওরঙ্গজেব জানেন কিভাবে বিশ্বস্তদের পুরস্কৃত করতে হয়। মীর জুমলা কক্ষ ত্যাগ করা মাত্রই আওরঙ্গজেব দ্রুত কাজটি সমাধা করার তোড়জোড় শুরু করলেন। এই কাজ তাঁর একমাত্র বিশ্বস্ত আলাউদ্দীন খান ছাড়া আর কেউ সম্পন্ন করতে পারবে না। গতরাতে আলাউদ্দীন খান বিশেষ খবর এনেছেন। সম্রাট শাহজাহান সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভের পথে। চারপাশ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আওরঙ্গজেবের নিজেকেও অচেনা মনে হচ্ছে। তাঁর লুকানো দ্বৈত সত্তা কি কন্যা জেবুন নেসা দেখতে পেয়েছে? তাই কি নিজেকেও সে অচেনা, গোপন ভাবতে পছন্দ করে? কন্যার খোঁজ নিতে গিয়ে জানলেন স্ত্রী দিলরাস বেগম শাশুড়ী মমতাজ বেগমের মতোই সন্তান প্রসবজনিত জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন। আকাশ-পাতাল জ্বর বেগমের । হেকিমরা বলছেন, বেগমের স্বাস্থ্যের সংবাদ ভালো নয়। জেবুন নেসা চব্বিশ ঘণ্টা তাঁর মায়ের খেদমতে ব্যস্ত। সঙ্গে আছেন মা-পাগল ছেলে শাহজাদা আজম। আওরঙ্গজেব ভেতর ভেতর ছটফট করতে থাকলেন। এক বিষণœ সুফী রাত শাহজাদা দারা জানেন বাদশাহ শাহজাহানের এই রোগমুক্তি সাময়িক। পূর্ণ শক্তি নিয়ে সম্রাটের পক্ষে সব কিছু সামাল দেয়া সম্ভব নয়। পূর্ব দিক হতে শাহ সুজা, দক্ষিণে মুরাদ আর আওরঙ্গজেব দিল্লির দখল নিতে উদগ্রীব। এর সঙ্গে আছে রাজপুত-মারাঠা’দের মুঘল সালতানাতের বিরুদ্ধে এক জোট হওয়া। এমনকি পারস্যের সম্রাট সুযোগে আছেন হিন্দুস্তানের দুর্বলতার সুযোগ নিতে। ইতিমধ্যে শাহজাদা দারা’র শক্তি বৃদ্ধি করতে তাঁর সামরিক ক্ষমতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন সম্রাট। কিন্তু তাতেও ভেতর ভেতর ভরসা করতে পারছেন না দারা। মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে আওরঙ্গজেবের নানামুখী চক্রান্তের খবর শুনে। মন হালকা করতে দারা রাতে আয়োজন করতে চাইলেন সুফী কাওয়ালীর। দায়িত্ব দিলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী রা-না-দিল বেগমকে। তাঁকেও তিনি প্রথম দেখেছিলেন এক গানের জলসায়। আগ্রায় এমনই এক ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা শীতের রাতে অন্তঃপুরে গানের আসর বসেছিল। গোয়ালিয়র ঘরানায় তালিম নেয়া খুবসুরত বাঈজী রা-না-দিল প্রথম রাতেই দারা’র ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন। মোটেও মিহি মিষ্টি কন্ঠের অধিকারী নন তিনি। ভারী ঘষা ঝাঁঝালো কণ্ঠধারী রা-না-দিল। মুদারার মন্দ্রসপ্তকের পঞ্চম হতে তারা ছুঁয়ে চকিতে আড়াই সপ্তকব্যাপী মীড়ের টানে যেভাবে গলা খেলান মনে হয় যেন সারেঙ্গী’র কোমল নিষাদ। এখনো সেই রাত ভুলতে পারেন না দারা। গানের আসর শেষে দারা চোখ বন্ধ করে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে শ্রান্তিবিলাসের পরই দেহ মন শান্ত হয়েছিলো। হিন্দু রমণী রা-না-দিল বাঈজীকে শাদী করে দারা খোদ শাহজাহানকে রাজী করিয়েছিলেন তাঁকে পুত্রবধূর সম্মান দিতে। রা-না-দিল দিল্লির কেল্লার গুমোট পরিবেশ হালকা করতে প্রথমে অনুমতি চাইতে এলেন সম্রাটের কক্ষে। নেকাব পড়লেও অনিন্দ্যসুন্দর মুখ খোলা রেখেছেন। আয়তকার টানা চোখে সুরমা পড়া, দাঁড়ালেন অসুস্থ শ্বশুরের সামনে। কুর্ণিশ করলেন কায়দা মাফিক। - কে তুমি সুন্দরী? ঠিক চিনতে পারলাম না। - বাদশাহ আলমপনা, বাঁদীর নাম রা-না-দিল। আপনার প্রিয় পুত্রের প্রিয়তমা স্ত্রী। - আহা! বহুদিন তোমার জান্নাতী গলা শুনি না। আগে তাও মহলের ভেতর তোমার রেওয়াজ শুনতে পেতাম। সব কেমন যেন ঝিমিয়ে গেছে। - জ্বী দিল্লি-এ-এলাহী। এ জন্যই আপনার আজ্ঞা চাইতে এসেছি। আমাদের মহান স্বামী চাইছেন আপনার সুস্বাস্থ্যের সুবাদে সুফী কাওয়ালী গানের আসর বসাতে। - কাওয়ালী? অবাক হন সম্রাট। তা হলে কি দরবারী কানাড়া, মালগুঞ্জ, হিন্দুস্তানী টপ্পা শোনা হবে না? - তা হবে না কেন? মাওলা চাইলে সব হবে। তবে সবাই চাইছেন কাওয়ালীর জলসায় একটু হৈ হুল্লোড় হোক। মাথা নেড়ে বললেন রা-না-দিল বেগম। - কোন খুদ নসীবরা গাইবেন? আগ্রহ দেখালেন সম্রাট। - খাজা নিজামুদ্দিন আওলিয়ার দরবারে লাহোর আর পাঞ্জাব হতে আসা উস্তাদদের কালোয়াতী মেহফিল চলছে। তাঁদের মধ্যে যমজ দুই ভাই আছেন সেরা। তাঁরাই হবেন বিশেষ মেহমান। - বহুত খুব! সম্রাট মাথা ঝুঁকে সায় দিলেন। দুই হাত জড়ো করে নত মস্তকে বেরিয়ে এলেন রা-না-দিল। তাঁর নিজেরও ইচ্ছে ওস্তাদদের সঙ্গে সঙ্গত করবেন। রঙমহলে কাওয়ালী শুনতে বেছে বেছে শিয়া মতালম্বীর আমীর-ওমাত্যদের নিমন্ত্রণ জানানো হলো। শেষ মুহূর্তে বিশেষ বিবেচনায় আমন্ত্রিত অতিথির তালিকা হতে বাদ দেয়া হলো মীর জুমলার ছেলে মোহাম্মদ আমীনকে। জাহান আরা’র সঙ্গে এলেন তাঁদের সবচেয়ে ছোট বোন গওহর আরা। কানাঘুষা আছে তিনি শাহজাদা মুরাদকে অন্দর মহলের যাবতীয় সংবাদ পাঠিয়ে থাকেন। বাদশাহের জন্য পৃথক আসনের ব্যবস্থা করা হলেও শারিরীক অবস্থা বিবেচনায় শেষ মুহূর্তে আসতে পারলেন না। সেই আসনে বসলেন শাহজাদা দারা। সুফী গায়ক দুই ভাই খোদাতায়ালার সৌন্দর্য বর্ণনায় লাইলী-মজনুর উপমা দিয়ে আসর শুরু করলেন। “মজনু বলেন, আমার লাই-লাকে সবাই লাইলী ডাকো- তিনিই তো আমার প্রেমিকা। আর সেই লাইলা’কেই দুনিয়া যখন ডাকে লা-ইলাহা বলে তখন তিনি সবার আশিক হয়ে যান।” এভাবে ক্রমে গভীর রাতে লাল কেল্লায় কাওয়ালী ক্রমে জমে উঠে। (চলবে)
×