ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নুরুল করিম নাসিম

কবি বেলাল চৌধুরী একটি বই কিছু স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ৩১ মার্চ ২০১৭

কবি বেলাল চৌধুরী একটি বই কিছু স্মৃতি

বিদেশ যাওয়ার তিন দিন আগে কবি বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে আমার শাহবাগে দেখা। সময়টা ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে আমার ফ্লাইট। বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন কোনদিন দেখিনি। হৃদয়ের ভেতরে এমন কোন তাড়নাও কখনী কোনদিন অনুভব করিনি। হঠাৎ করেই স্বপ্নের মতো সবকিছু ঘটে গেল। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম। যাব কি যাব না। আত্মীয়স্বজনরা সবাই চাপ দিতে লাগলেন। তা ছাড়া মাত্র মাস কয়েক আগে বাবা মারা গেছেন। পুরো সংসারের দায়-দায়িত্ব আমার কাঁধে। আমরা ৪ ভাই-১ বোন। আমি ছাড়া সবাই পড়াশোনা করছে। বাবা একটা বাড়ি রেখে গিয়েছিলেন পুরান ঢাকায়। মা খুব হিসাব করে গুছিয়ে সংসার চালাতেন। আমি একমাত্র উপার্জনের উৎস। সমস্ত সংসার আমার দিকে চেয়ে থাকত। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য বৈধ টাকার অনেক দরকার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদেশে অধ্যাপনার চাকরি বেছে নিলাম। বেলাল ভাই আমার বিদেশ যাওয়ার খবর শুনে খুব খুশি। তিনি বললেন, এবার অনেক বই পড়ার সুযোগ হবে, অনেক দেশও দেখার সুযোগ পাবে। যারা লেখালেখি করবে, তাদের জন্য এ দুটোই দরকার।’ বেলাল ভাইয়ের হাতে একটা বই। লেখক ভিএস নাইপল। বইয়ের নাম : অ্যান ইসলামিক জার্নি : অ্যামাং দ্য বিলিভারস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রকালীন অনার্সে আমাদের পাঠ্যসূচিতে ভিএস নাইপলের একটি উপন্যাস, ‘আ’ বেন্ড ইন দ্য রিভার’ ছিল। ভাষা খুব চমৎকার। খুব টানে। তার আর কোন বই পড়িনি। বেলাল ভাই বললেন, ‘বইটি পড়েছ?’ আমি মাথা নেড়ে না বললাম। তিনি তখনই আমাকে নিয়ে নীলক্ষেতের একটি দোকানে এসে বইটি ফটোকপি করতে দিলেন। দোকানি তার দেশী এবং বেশ চেনা। কয়েক ঘণ্টার ভেতর দোকানি বইটি ফটোকপি করে দেয়ার আশ্বাস দিলেন। এই সময়টা বেলাল ভাই শাহবাগে আবার নিয়ে এলেন আমাকে। চমৎকার এক সন্ধ্যা কাটল কফি খেলাম এবং বই নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হলো। প্রথম পরিচয়ের দিন থেকেই তাকে খুব পড়ুয়া মনে হয়েছিল আমার। কলকাতা থেকে ঢাকায় আসার অনেক আগে থেকে বেলাল ভাই এক কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। সুদর্শন প্রাণবন্ত খোলা মনের এই মানুষটির সঙ্গে আমার হৃদ্যতা ক্রমশ গড়ে উঠল দ্রুত। প্রায়ই দেখা হয়, আড্ডা হয়। শাহবাগে, সন্ধ্যায়। কখনও কখনও কবি রফিক আজাদ ভাইও থাকেন। মাঝে মধ্যে কবি-প্রাবন্ধিক আবদুল মান্নান সৈয়দও অংশগ্রহণ করেন আমাদের সেই সান্ধ্য আড্ডায়। যথাসময়ে, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৮০ মধ্যরাতে দেশ ছেড়ে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে যাই। ভূ-মধ্যসাগর তীরের একটি দেশে। প্লেনে উঠে মন খারাপ হয়ে যায়। ভিএস নাইপলের বইটি ব্যাগ থেকে বের করে চোখের সামনে তুলে ধরি। কিন্তু কিছুতেই মনোনিবেশ করতে পারি না। চমৎকার গদ্যে গল্পের ঢংয়ের নাইপল ৪টি মুসলিম দেশ ভ্রমণ করে সেই সব দেশের শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতি, ধর্ম ও জীবন সম্পর্কে লিখেছেন। বইয়ের ক্লাবে এসব কথা লেখা আছে। বাতি নিভিয়ে দেয় এক লাবণ্যময়ী বিমানবালা। এসব বই এ রকম হেলাফেলা করে পড়া যায় না। ব্যাগে বইটি রেখে আমি ঘুমুতে চেষ্টা করি। ঘুম আসে না। ঘুম ও জাগরণের মাঝে এক ধরনের ঝিমুনির ভেতর সময় কেটে যায়। সেই আমার ভিসি নাইপল অন্বেষণ। খুঁজতে থাকি নাইপলের গদ্যের বই। যে দেশে আমার কর্মস্থান, সেখানে লাইব্রেরিতে ভাল ইংরেজী বই পাওয়া যায় না। একমাত্র নিউজ উইক, টাইম সাপ্তাহিক আসে, মাঝে মধ্যে ত্রৈমাসিক প্যালেস্টানিয়ান স্টাডিজ হঠাৎ কখনও পেয়ে যাই। ছুটিতে ঢাকায় এসে নাইপলের অসংখ্য বই সংগ্রহ করি। সঙ্গে আমার অন্য প্রিয় লেখকদেরও। আমার ভেতর-বাইরের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ উসকে দিয়েছিলেন কবি ও সম্পাদক আহসান হাবিব। তিনি আমাকে দিয়ে দৈনিক পাকিস্তান/দৈনিক বাংলার সাহিত্য-সাময়িকীর পাতায় বাইরের কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রবন্ধকার সম্পর্কে লিখিয়েছেন। মাসিক কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত, ছদ্মনাম মাহমুদ আল জামান, কবি ও শিল্প সমালোচক, তিনিও তার মাসিক সাহিত্য পত্রিকায় বিশ্বসাহিত্যের নতুন বই নিয়ে লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সেখানে এক সময় নিয়মিত বাইরের নতুন বই সম্পর্কে লিখতে হতো। ঢাকায় ছুটিতে এলে কবি বেলাল চৌধুরীর উষ্ণ ও প্রাণবন্ত সান্নিধ্য পেতাম। তিনি এখন অসুস্থ। কিছুদিন আগে কবি রফিক আজাদ চলে গেলেন। আনিসুজ্জামান স্যার হাসপাতালে। কবি হারিসুল হক তার ফেসবুকে জানিয়েছেন, তার অবস্থা ভাল নয়। ভিএস নাইপল বেশকিছু ভাল উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু আমার কাছে তার প্রবন্ধের বইগুলো অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী। তার প্রবন্ধের বইয়ের গদ্য উপন্যাসের মতো গীতল; ভাষা ঝরঝরে, স্মার্ট এবং মেদহীন। এবারের (২০১৬) ঢাকা লিটারেরি ভেসটিভেলে প্রধান অতিথি হয়ে তিনি ও তার স্ত্রী সাংবাদিক নাদিরা এসেছিলেন। তাকে হুইল চেয়ারে দেখে খারাপ লাগল। এই হলো মানুষের জীবন! তার ‘অ্যামাং দ্য বিলিভারস’ এবং ‘বেয়ন্ড বিলিভ’ বই দুটো বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। সালমান রুশদী তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘নাইপল ঝটিকা সফরের ভিত্তিতে কয়েক ব্যক্তির সাক্ষাতকার নিয়ে একটি দেশ, সেই দেশের জীবনশৈলী ও ধর্ম বিষয়ে মন্তব্য করেছেন।’ নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক ভিএস নাইপলের নন-ফিকশন আমার ভীষণ প্রিয়। খুব সহজ সরল গদ্যে ন্যারেটিভ স্টাইলে তিনি এসব মুক্তগদ্য লিখেছেন। কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে তার ‘রাইটার্স ওয়ার্ল্ড।’ এই বইটির গদ্য ও সাবলীল এবং খুব টানে। নাইপলের দীর্ঘজীবন কামনা করি। কামনা করি আনিসুজ্জামান স্যার এবং কবি বেলাল চৌধুরী শীঘ্র সুস্থ হয়ে উঠুন।
×