ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিলন কান্তি দে

বাংলার যাত্রা ॥ বাঁকে বাঁকে একুশ শতকে

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ৩১ মার্চ ২০১৭

বাংলার যাত্রা ॥ বাঁকে বাঁকে একুশ শতকে

(পূর্ব প্রকাশের পর) পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাত্রাকে সমৃদ্ধশালী করার ক্ষেত্রে এক বিশিষ্ট নাম ভোলানাথ রায় (১৮৯১-১৯৩৩)। বর্ধমান জেলার রায়ান গ্রামের অধিবাসী এই পালাকারের স্বতন্ত্র শিল্প চেতনা যাত্রার যাত্রাপথকে গতিশীল করেছে। যাত্রাপালায় দার্শনিক যুক্তিতর্কের চাতুর্যময় সংলাপ বুননের প্রথম কৃতিত্ব তাঁর। যাত্রার প্রচলিত অসম্ভব দীর্ঘ সংলাপকে যথাসম্ভব ক্ষুদ্রাকৃতি করার পরীক্ষা নিরীক্ষাও প্রথম তার হাতেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় হাটে-মাঠে খোলা প্রান্তরে যাত্রা প্রদর্শনী যখন অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল, তখন ভোলানাথ রায়ের ‘পৃথিবী’ পালাটি মঞ্চায়িত হয় কলকাতার মনমোহন থিয়েটারে। প্রসেনিয়াম মঞ্চে বিশেষ ব্যবস্থায় এটাই প্রথম যাত্রানুষ্ঠান। ১৯১৬ সালের ১৬ অক্টোবর গণেশ অপেরা পার্টির পরিবেশনায় এই যাত্রা সম্পর্কে পরের দিন অমৃতবাজার পত্রিকার রিপোর্ট : খধংঃ ঞঁবংফধু (১৬ ঙপঃড়নবৎ, ১৯৭১) ধঃ ৫. ঢ়.স ঃযব এধহবংয ড়ঢ়বৎধ ঢ়ধৎঃু যবষফ ধ ঢ়বৎভড়ৎসধহপব ড়ভ ঃযব মৎধহফ সুঃযড়ষড়মরপধষ ভরাব-ধপঃ ফৎধসধ ইধনঁ ইযড়ষধহধঃয জড়ু পধষষবফ ঃযব ‘চৎরঃযরার’ ড়হ ঃযব ঝঃধমব ড়ভ গড়হড়সড়যড়হ ঞযবধঃৎব, যিরপয ধিং ভরষষবফ ঁঢ় রিঃয ঃযব যরমযবংঃ হঁসনবৎ ড়ভ বহঃযঁংরধংঃরপ ধঁফরবহপব. ১৯২১ সালে কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ভাব ভাষা ছন্দে সাহিত্যাঙ্গনে যেমন নতুন জাগরণ নিয়ে আসে, তেমনি একই বছরে প্রকাশিত ভোলানাথ রায়ের ‘আদিশূর’ পালাটিও যাত্রাশিল্পে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই পালায় সঙ্গীতের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন। প্রথম দুই পঙ্ক্তি- ’আমার সোনার বাঙ্গালা দেশ সোনায় গড়া সযতনে নখ হতে দূর মাথার কেশ’ শৃঙ্খলিত বাঙালী জাতির মুক্তির জন্য আশু প্রয়োজন এক ঐক্যবদ্ধ লড়াই। এই একটি মাত্র বক্তব্যই তিনি পৌরাণিক ধাঁচে প্রতীক ও উপমা দিয়ে প্রকাশ করেছেন ‘জরাসন্ধ’ পালায় (১৯৩০)। ইংরেজ শাসকরা পালাটি বাজেয়াফত করে। বাংলা ভাষায় অগাধ পা-িত্যের জন্য ভোলানাথ রায় ‘কাব্যশাস্ত্রী’ উপাধি পান। কাব্যশাস্ত্রীর উত্তরসূরিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনজন পালাকার হলেন হাওড়া জেলার সাতরাগাছির ফণীভূষণ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৩-১৯৬৮), চব্বিশ পরগনার রামনগর গ্রামের সৌরিন্দ্র মোহন চট্টোপাধ্যায় (১৯০০-১৯৯৮) এবং হুগলী জেলার পাকড়ি গ্রামের বিনয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় (১৯০২-১৯৬৬)। ফণীভূষণ যাত্রাজগতে ‘বড়ফনীবাবু’ নামে পরিচিত। শিক্ষা দীক্ষায় জ্ঞান বুদ্ধিতে সেকালে তাঁর স্থান ছিল সর্বোচ্চে। তাকে বলা হয় ‘প-িত পালাকার।’ যে জন্য ‘বিদ্যাবিনোদ’ শব্দ অলঙ্কারটি তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। বিশ শতকের শুরু থেকেই দেখা যায় শিক্ষিত পালাকাররা যে বিষয়বস্তু এবং যে ঢংয়েই যাত্রার বই লেখেন না কেন, তার অন্তর্নিহিত মূল সরটি ছিল দেশপ্রেম। শব্দ ও সংলাপের ঝঙ্কারে ধ্বনিত হতো ঔপনিবেশিক শাসকচক্রের কবল থেকে বাংলা ও বাঙালীর মুক্তির বারতা। এসব পালা কাহিনী জনগণের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে পারে- এই আশঙ্কায় ব্রিটিশ সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মুকুন্দ দাশ থেকে পরবর্তীকালের অনেক লেখকের পালা বাজেয়াফত করে। কোন কোন পালা লেখকের কারাবরণও করতে হয়েছে। বড় ফণীবাবুও শ্বেতাঙ্গ ‘প্রভু’দের চক্ষুশূল ছিলেন। ‘নির্বাচিত বাংলা যাত্রা’ সঙ্কলনের তৃতীয় খ-ের ভূমিকায় দেবজিত বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ফণীভূষণের ‘বামণ অবতার’ আর ‘রতেœশ্বর’ পালার অভিনয় বন্ধ হয় ব্রিটিশ পুলিশের রোষে। এ ছাড়া তাঁর ‘মুক্তি’ যাত্রাপালা রাজরোষে পড়ে।’ মঞ্চ ও যাত্রার অভিনয়ের রীতিনীতি নিয়ে ‘অভিনয় শিক্ষা’ নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ। স্কুলশিক্ষক সৌরীন্দ্র মোহন চট্টোপাধ্যায় যাত্রাপালা রচনার পাশাপাশি সাময়িকীতে গল্প-কবিতা লিখতেন। ‘ধর্মবল’, ‘আত্মাহুতি’, ‘ব্যথার পূজা’, ‘পলাশীর পরে’ প্রভৃতি তাঁর সৃষ্টিশীল পালা রচনা। তার বিশেষ কৃতিত্ব বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসের পালারূপ দেয়া। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আদর্শ শিক্ষক হিসেবে সরকারী পদক লাভ করেন পালাকার বিনয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় (১৯০২-১৯৬৬)। স্বদেশ চেতনা ও সাম্য সম্প্রীতির জয়গানের পাশাপাশি তার পালায় উঠে এসেছে চোরাকারবারী, কালোবাজারীদের দৌরাত্ম্য, সরকারী আশ্রয় প্রশ্রয়ে দুর্নীতি ইত্যাকার বিষয়ে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্র। তাঁর রচিত পালার তালিকায় রয়েছে, ‘রক্তকমল’, ‘সংগ্রাম’, ‘মাটির প্রেম’, ‘বেঈমান’ ও ‘ভুলের কাজল।’ ইমাম যাত্রার কথা ১৯৩০ সাল। স্বদেশী যাত্রা থেকে আর এক নতুন যাত্রার জন্ম- ‘ইমাম যাত্রা’। মীর মোশাররফ হোসেনের (১৮৪৭-১৯৯২) ‘বিষাদ-সিন্ধু’ অবলম্বনে রচিত এজিদ বধ, জয়নাল উদ্ধার, সখিনার বিলাপÑ এই তিনখানা পালা নিয়েই ইমাম যাত্রার নামকরণ। এক সময় যাত্রাপালা বলতেই হিন্দু দেব-দেবীদের পুরাণনির্ভর কাহিনীই বোঝাত। তারপর রাজা বাদশাদের বীরত্ব গাথা নিয়ে ঐতিহাসিক পালা রচনার একটি ধারা গড়ে ওঠে। মুসলিম ঐতিহ্য ও ধর্মীয় আখ্যানভিত্তিক পালা যাত্রার আসরে পরিবেশিত হবে- সমকালীন সমাজে এটা ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার। বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানার দুধল গ্রামের স্বশিক্ষিত পালাকার মোজাহের আলী শিকদার (১৯১০-১৯৮৫) সেই কল্পনাকে যখন বাস্তবে রূপ দিলেন, মীর মোশাররফ হোসেনকে নিয়ে এলেন যাত্রার আসরে, তখনই এই শিল্পের ইতিহাসে উন্মোচিত হলো এক নতুন অধ্যায়। ইমাম যাত্রার রচয়িতা হিসেবে খ্যাত হলেন মোজাহের শিকদার। তার দলের নাম ছিল মুসলিম যাত্রাপার্টি। এখানেও আমরা দেখতে পাই এক ভিন্ন আদর্শিক চেতনা। ড. তপন বাগচী তাঁর গবেষণা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এটি মুসলিম পরিচালিত প্রথম যাত্রাদল। যাত্রায় জাতীয় জাগরণ স্বদেশী যাত্রার প্রভাবে দেশপ্রেমমূলক ঐতিহাসিক যাত্রাপালা রচনার একটি ধারা গড়ে ওঠে অবিভক্ত বাংলাদেশে। স্বদেশী আন্দোলনের চেতনা সাধারণ জনগণের মধ্যে সঞ্চারিত করার দায়বোধ থেকে কোন কোন ঐতিহাসিক চরিত্রকে জাতীয় নায়ক হিসেবে মঞ্চে এনে দাঁড় করিয়েছেন পালা লেখক ও নাট্যকাররা। ১৯০৫ সালে মঞ্চায়িত গিরিশ ঘোষের সিরাজউদ্দৌলার কথা আগেই উল্লিখিত হয়েছে। এ ধারার পরবর্তী নাট্যরচনা : দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৮৬৩-১৯১৩) ‘মেবার পতন’, ‘রানী দুর্গাবতী’ শচীন সেনগুপ্তের ‘গৈরিক পতাকা’, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং যাত্রাপালা শশাঙ্ক রায়ের ‘নবাব সিরাজ।’ হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে শচীন সেনগুপ্তের সিরাজ দাঁড়িয়েছেন মঞ্চে। মুখে তাঁর সাম্য সম্প্রীতির চিরায়ত সংলাপ- ‘বাংলা শুধু হিন্দুর নয়, বাংলা শুধু মুসলমানদের নয়। মিলিত হিন্দু-মুসলমানের মাতৃভূমি গুলবাগ এই বাংলা। এই ঐতিহাসিক ঘটনার ছয় বছর আগে ১৯৩২ সালে বাংলাদেশের এক বিখ্যাত যাত্রাপালাকার ব্রজেন্দ্র কুমার দে’র (১৯০৭-১৯৭৬) আত্মপ্রকাশ। পেশাদার যাত্রাদল গণেশ অপেরা পার্টির জন্য প্রথম পালা লিখলেন ‘বজ্রনাভ।’ বিশিষ্ট যাত্রানট একুশে পদকপ্রাপ্ত অমলেন্দু বিশ্বাস (১৯২৫১৯৮৭) রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত ত্রৈমাসিক ‘থিয়েটারে’ (এপ্রিল-মে-জুন সংখ্যা ১৯৮৭) ‘যাত্রার অতীত ও বর্তমান’ নিবন্ধে ব্রজেন দে সম্পর্কে লিখেছেন : ‘১৯৩২ সালে যাত্রাঙ্গনে আরেক মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হলো। আধুনিক যুগের আদ্যেভাগে ক্ষুরধার লেখনী হস্তে যাত্রাপালাকার রূপে আবির্ভূত হলেন পালাসম্রাট ব্রজেন্দ্র কুমার দে। শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত থেকেও তিনি পঞ্চাশ বছর যাবত যাত্রাপালা রচনায় নিবেদিত ছিলেন।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা, ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ’৪৩-এর দুর্ভিক্ষ- এই পটভূমিতে প্রগতিশীল ধারার লেখক ও নাট্যকর্মীদের সম্মিলিত উদ্যোগে গড়ে ওঠে সর্বভারতীয় গণনাট্য সংঘের নবনাট্য সংঘের নবনাট্য আন্দোলন। এই নতুন নাট্যধারার সূচনা বিজন ভট্টাচার্যের (১৯১৫-১৯৭৮) ‘নবান্ন’ নাটক দিয়ে। এর প্রভাব পড়ে যাত্রায়ও। দুর্ভিক্ষের জন্য মহাজন মজুতদার ও চোরাকারবারীদের দায়ী করে ব্রজেন্দ্র কুমার দে লিখলেন যাত্রাপালা ‘আকালের দেশ।’ অনেকে এই পালাটিকে সামাজিক পালা হিসেবে উল্লেখ করেন। পালাকার নিজেই বলেছেন এটি আধা সামাজিক পালা। প্রথম পূর্ণাঙ্গ সামাজিক পালা ‘নিষিদ্ধ ফল’ বা ‘দোষী কে’ তিনি রচনা করেন ১৯৬০ সালে। ‘আকালের দেশ’ অভিনীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপথগামী উচ্ছৃঙ্খল ব্যবসায়ীরা পালাকারের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ফলে নিজের জন্মভূমি (শরীয়তপুর জেলার গংগানগর গ্রাম) ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যেতে বাধ্য হন তিনি। (চলবে)
×