ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নূর কামরুন নাহার

জুবাইদা গুলশান আরা একজন সফল জীবনশিল্পী

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ৩১ মার্চ ২০১৭

জুবাইদা গুলশান আরা একজন সফল জীবনশিল্পী

জুবাইদা গুলশান আরা বাংলাদেশের শিক্ষা ও সাহিত্যাঙ্গনে সুপরিচিত এক নাম। সাহিত্যের নানা শাখায় তার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরবঙ্গের নদী ঘেঁষে রূপপুর গ্রামে তাঁর পিতৃভূমি। তবে পিতা আলহাজ মুহম্মদ ইউনুস ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার। বদলি হয়েছেন নানা জেলায়। পিতার কর্মস্থল খুলনায় ১৯৪২ সালে ২২ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সেই কৈশোরেই তার লেখালেখির শুরু। ভাষা আন্দোলনের সেই উত্তাল সময়টাতেই তার মধ্যে জন্ম দেয় চেতনার আর জোগায় লেখার উদ্দীপনা। লেখা প্রেরণায় প্রভাব রাখে তার শৈশবের দিনগুলোও। তার শৈশব তার কেটেছে কলকাতায় ও দার্জিলিং, কার্লিয়াং পাহাড়ের কোলে, নৈসর্গিক পরিবেশে। এই উদ্দাম খোলা প্রকৃতি তার ভেতরে জাগিয়ে তোলে প্রকাশের বেদনা ও আনন্দ আর উন্মোচিত করে সৃজনশীলতাকে। বরিশাল সদর গার্লস স্কুলে পড়ার সময় পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। প্রথম ছড়ার বই ‘মজার ছড়া’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। টাঙ্গাইলের বিখ্যাত বিন্দুবাসিনী স্কুলে পড়েছেন তিনি। সেখানেই তিনি প্রতিভার প্রকাশ ঘটান। পড়াশোনা, গান, আবৃত্তি সবদিকেই দেখান তার পারদর্শিতা। বিন্দুবাসিনী স্কুলের পর তিনি পড়েন ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী স্কুলে। সেখান থেকেই ১৯৬৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ভর্তি হন আনন্দ মোহন কলেজে। তার পরবর্তী শিক্ষাজীবন কাটে ইডেন কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করে করেন। ভিকারুননিসা গার্লস স্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে শুরু করেন শিক্ষকতা জীবন। ১৯৬৪ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে নির্বাচিত হয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা ইডেন গার্লস কলেজে। শিক্ষকতা জীবনের পাশাপাশি তিনি সাহিত্য চর্চায় গভীর মনোনিবেশ করেন। তার লেখার উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে রয়েছে দেশপ্রেম, দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং মানবিকতা। জীবনকে তিনি দেখেছেন গভীরভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রাণীবিজ্ঞানী স্বামী মাহমুদ-উল-আমীনের সঙ্গে তিনি বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন, কর্মজীবন এবং লেখালেখির অংশ হিসেবে অংশ নিয়েছেন নানা আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও সেমিনারে। দেখেছেন নানা মানুষ ও নানা ধরনের জীবন। এই ব্যাপক জীবন দেখা তার মধ্যে সৃষ্টি করেছে জীবন অন্বেষা, তাই তার লেখায় উঠে এসেছে জীবন ও সমাজ। জীবন ও সমাজের এই চিত্রণ তার লেখা ও সাহিত্যকে নিয়ে গেছে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি। সর্বস্তরের মানুষের কাছেই তিনি তৈরি করেছেন তার লেখার গ্রহণযোগ্যতা। তাই সাধারণ মানুষ থেকে সুশীলসমাজ পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের কাছে যেমন তার লেখা প্রশংসিত হয়েছে তেমনি সব শ্রেণীর মানুষকেই তিনি তার লেখায় তুলে এনেছেন। আর এই জন্যই তার লেখা হয়ে উঠেছে সার্বজনীন সমাজের চিত্র। দেশপ্রেম থেকেই জুবাইদা গুলশান আরা মুক্তিযুদ্ধের গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। তার লেখার এক বড় অনুষঙ্গ এই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিশোর গল্প ও উপন্যাস তার গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। তার লেখার আরও একটি বড় উপাদান নারীর জীবন ও সংগ্রাম। এখানে তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন নারীর জীবনাচারণকে। এই গভীর পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে নারীর গোপন বঞ্চনা, ক্ষোভ, যন্ত্রণা, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির বিষয়গুলো। মূলত সৌন্দর্য অন্বেষণ ও জীবনের শিল্পিত প্রকাশই ছিল তার লেখার শক্তি। তাঁর ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা, জীবনদেখার দৃষ্টি এবং বিদ্যমান সমাজ এই ত্রয়ী উপাদানের সমন্বয়েই জুবাইদা গুলশান তার সাহিত্যকে মানুষের করে তুলেছেন আর এখানেই তাঁর লেখার শক্তি। জুবাইদা গুলশানের আরও একটি বড় বিষয় হচ্ছে তিনি শিশুদের জন্য প্রচুর কাজ করেছেন। তার শিশুতোষ বইগুলোর মধ্যে রয়েছে শিশুকিশোর সমগ্র, মন ছুটেছে তেপান্তরে, নিঝুম দ্বীপের গল্প, রূপমের চিড়িয়াখানা (২০০৩), তোমাদের জন্য গল্প (২০০২), অচিন পথের বন্ধু, পরিচয় হোক বন্ধুর সঙ্গে (২০০২), শিশু, তোর খেলার সাথী (২০০২), ছোটদের নাটক মালা (২০০৩), বাবুই পাখির বাসা, ঘুম ভাঙ্গানো নদীসহ (১৯৮৮) এছাড়াও ছোটদের জন্য লিখেছেন অসংখ্য লেখা। তার ছোটদের বই গল্প তবু গল্প নয় (২০০৩) ইউনিসেফ থেকে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শিশুকিশোরদের জন্য প্রচারিত টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি অসাধারণ মেধা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে শিশুদের জন্য প্রচারিত অনুষ্ঠানের জনপ্রিয় ও সফল উপস্থাপক ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে শিশু অনুষ্ঠান, সাহিত্য আসর ও গণশিক্ষা অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। টিভি বেতারে তার রচিত একাধিক নাটক প্রচারিত হয়েছে। শিশুদের আদর্শ জীবন গড়ার অনুপ্রেরণা হিসাবে লেখা তার ‘অচিন পথের বন্ধু’ বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে সফলভাবে চলচ্চিত্রায়িত হয়। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে-আমি যোদ্ধা অযুত বছর (১৯৯৯) (মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস), বিষাদ নগরে যাত্রা (১৯৮২), ধল প্রহরের আলো (১৯৮২), কি লিখেছ তরবারি তুমি (১৯৯২), ছোঁ বুড়ির দৌড় (১৯৮৭), ঘৃণার জঠরে জন্ম (১৯৮৮), প্রমিথিউসের আগুন (১৯৮৭), অশ্রুনদীর ওপারে (১৯৮৯), ঊষারাগ (১৯৯০), ঘাসের উপরে মুখ রেখে (১৯৯৪), পদ্মা আমার পদ্মা (১৯৯৪), হৃদয়ে লিখো নাম (১৯৯৪), চৈতী তোমার ভালোবাসা (১৯৯৪), বিবর্ণ নগরী (১৯৯৫), মন্দাকিনী (১৯৯৫), ভালোবাসার স্বভাব এমন (২০০৪), বিধাতার চারদিন ও সোনালি রঙের নদী (২০০২), অপরিচয়ের স্বপ্নযাত্রা (২০১২)। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, উপাধ্যক্ষ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনে বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষক, মৌখিক পরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব। জাতীয় কমিটি ও গ্রন্থনীতি পিএসসি এবং জাতীয় শিশুনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি ইংল্যান্ডে চিত্রশিল্প ও মৃৎশিল্পে, ডেনমার্কে ডেনিশ ফোকলোর ও ভাষাবিষয়ে স্বল্পকালীন শিক্ষা লাভ করেন। জুবাইদা গুলশান আরা সম্মানিত হয়েছেন বহুবিধ পুরস্কারে। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশের পদক (২০০৫), কবি আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৯), কমর মসতরী স্বর্ণপদক (১৯৮৫), বাংলাদেশ জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশন পদক (২০০০), শের-এ বাংলা স্মৃতি পুরস্কার, জিসাস স্বর্ণপদক (২০০৪), কবি জসিম উদ্দীন পরিষদ পুরস্কার (১৯৯৩), চয়ন সাহিত্য পত্রিকা স্বর্ণপদক (২০১৩), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক (১৯৮৯) এবং লেখিকা সংঘ প্রবর্তিত ড. তাইবুন নাহার রশীদ (কবিরতœ) স্বর্ণপদক (২০১৬), ত্রিভুজ সাহিত্য সংসদ পুরস্কার (১৯৯৩), কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (২০০২), দেশনেত্রী সাংস্কৃতিক পুরস্কার (২০০২), নন্দিনী সাহিত্য পুরস্কার ও আরও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সাহিত্য সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান থেকে সংবর্ধনা ও সম্মাননা লাভ করেন। নারী উন্নয়ন এবং নারী ক্ষমতায়নও নিয়েও নানাবিধ কাজ করেছেন তিনি। বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের জন্মলগ্ন থেকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। আমৃত্যু এই সংগঠনের সহ-সভাপতি ছিলেন। লেখিকা সংঘ প্রকাশিত বার্ষিক সাহিত্য পত্রিকা ‘সঞ্চয়ন’-এর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করতেন তিনি সুচারুরূপে। পেন ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ শাখার সাহিত্যপত্র সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে এশিয়ান উইমেন্স, ড্রামাটিক কনফারেন্স ফিলিপিন্সের ম্যানিলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ও তার তৈরি শর্ট ফিল্ম ‘উইম্যান ওয়াক আপ ইটস টাইম’ ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে। ২০০৫ সালে তিনি ‘উইম্যান অব দ্য ইয়ার’ উপাধিতে ভূষিত হন। গত ১৯ মার্চ এই খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক ও কর্মবীর চলে যান জীবন নদীর ওপারে। দৈহিক প্রস্থান নিয়েছেন তিনি আমাদের থেকে। কিন্তু তার সৃষ্টি, অক্লান্ত পরিশ্রম, সুন্দরের দিকে তার অবিরাম যাত্রা, মানবিক বোধ আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার সাহিত্য পাঠককে যুগের পর যুগ কালের পর কাল আনন্দ দিয়ে যাবে। জীবন থেকে ছুটি নিলেও এই জীবনশিল্পী পাঠকের মন থেকে ছুটি নিতে পারবেন না। পাঠকের মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন, বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টির মধ্যে। [email protected]
×