ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাদিক ইসলাম

একাত্তরের বীর কন্যারা

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ৩১ মার্চ ২০১৭

একাত্তরের বীর কন্যারা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। তারা যেমন মুক্তিযুদ্ধে আড়ালে থেকে বা ওতপ্রোতোভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে মহান ভূমিকা পালন করে গেছেন তেমনি চরমতম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। দেশ আর মুক্তিযুদ্ধকে ভালবেসে ছিলো বলে এই বীরকন্যা কিশোরী বা তরুণীদের কোমল জীবনে নেমে এসেছিল নজিরবিহীন নিষ্ঠুরতা। মানবিকতার জঘন্যতম লঙ্ঘন ঘটেছিল এই নারীদের ঘিরে। তারা পাশবিকভাবে যেমনি নির্যাতিত হয়েছিলেন তেমনি স্বামী, সন্তান, ঘর, ভূমি আর আত্মসম্মান হারিয়ে নিদারুণ এক ক্রান্তিকালের মাঝ দিয়ে পার করেছে অসহনীয় সময়। জীবনসংগ্রামে পরাজিত হয়েও দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ এই কিশোরীরা আজ নারী বা বৃদ্ধা। এই নারীরা অনেকেই আজো সেই গ্লানি আর বীভৎস ইতিহাসের ক্ষত বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। এমন কিছু বীর কন্যা বা বীরাঙ্গনাকে এই লেখায় স্মরণ করা হয়েছে । লালমনিরহাট সদর উপজেলার হালিমা খাতুন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সব হারানো হতভাগ্য বীরকন্যাদের একজন। মুক্তিযুদ্ধ তার জীবন থেকে সবকিছু কেড়ে নেয়। গা শিউরে ওঠার মতো এক করুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে তাকে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দিনগুলো শুধু অপার বেদনা নিয়ে কাটাতে হয়েছে। তিনি তার স্বামী আর ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন যুদ্ধে। যুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে তার বুয়েটে পড়া বড় ছেলে ও ছোট ছেলে এবং স্বামীকে তার সামনেই হত্যা করে নরপশুরা। এছাড়ার সেই সময় তার পরিবারের ভাসুর, দেবর আর অন্য সব পুরুষ সদস্যকেই তার সামনে একে একে হত্যা করে পাকিস্তানী সেনা নামে পশুরা। মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছে তা নিয়ে হালিমা খাতুন গর্ববোধ করলেও এই সব হারানোর চরম আঘাত তাকে ছিন্ন ভিন্ন করে অন্তরে। বীরাঙ্গনা নূরজাহানের বাড়ি রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। যখন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলছে মাত্র তেরো বছরের কিশোরী নূরজাহানও রেহাই পাননি পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকারদের নখর থেকে। প্রথমে মা ও ছোট ভাইকে মারধর করে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় ওরা। তারপর রাজাকাররা নূরজাহানকে তুলে দেয় বিহারীদের হাতে। একটি বদ্ধ ঘরে আটকে রেখে দিনে এক কি দুই বেলা কিঞ্চিত খাবার দিয়ে রাতে নরপশুরা সেই কোমল হৃদয় সদ্য কিশোরীর দেহ নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠত। এভাবে একদিন দু’দিন নয় দীর্ঘ দুইমাস অবিরাম চলে নূরজাহানের উপর মানসিক, শারীরিক ও পাশবিক অত্যাচার। উপজেলার পশ্চিম মাঝিগাতি গ্রামের বীরাঙ্গনা রওশনারা বেগমের বয়স এখন প্রায় ৭০। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনিও পাকিস্তানী হায়েনা বাহিনী আর তাদের সহযোগীদের হাতে সম্ভ্রম হারান। স্বামী আবদুল মজিদ শেখ দিনমজুরি করে কোনরকমে সংসার চালাতেন। স্বামী মারা গেছেন তাও প্রায় ১৩ বছর। এরপর থেকেই নতুন করে রওশনারার কষ্টের জীবন শুরু। তিন সন্তানের এ জননীর কষ্টের জীবন শেষ হয়নি। দুই ছেলে আলীম শেখ ও জামাল শেখ ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান। ছেলেরা মায়ের খোঁজও নেন। মেয়ে রহিমন মানুষের বাড়িতে কাজ করে মাকে নিয়ে আধপেটা খেয়ে দিন পার করছেন। রওশনারা এখন ঠিকমতো কানেও শোনেন না; চোখেও দেখতে পান না। তবুও মাঝে মধ্যে রহিমনের যখন কাজ থাকে না, তখন বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে চালান পেটের ক্ষুধা। যদিও যুদ্ধে তিনি সম্মান হারান। রওশনারা বলেন, ‘এতদিন পরে এগুলো বলে আর কী হবে? বীরাঙ্গনার পরিচয় দিতে আমার লজ্জা নাই বরং গর্ব হয়।’ কোটালীপাড়া উপজেলার উত্তরপাড়া গ্রামের রিক্সাচালক (মৃত) সামছুল হকের দুই কন্যা লাইলি বেগম ও সালেহা বেগম। মুক্তিযুদ্ধের মাত্র আট মাস আগে তিনি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী বড় মেয়ে লাইলীকে বিয়ে দেন তারই গ্রামের (উত্তরপাড়া) সালাম শিকদারের সঙ্গে। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় অন্তঃসত্ত্বা হন লাইলি। আর মেজো মেয়ে ১৪ বছরের সালেহার তখনও বিয়ে দেননি। খুলনার বাবুখান রোডে ভাড়া করা বাসায় সামছুল হক তার স্ত্রী, তিন মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে একসঙ্গে থাকতেন। সেখানেই রিক্সা চালিয়ে যা আয় করতেন তা দিয়ে চলত তার সংসার। যুদ্ধের ডামাডোলে শহরে থাকা নিরাপদ নয়। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফেরেন সামছুল হক। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। পাকিস্তানী হায়েনারা তার দুই মেয়েকে তুলে নিয়ে দিনরাত জঘন্য অত্যাচার চালায়। পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতায় তার দুই মেয়ে আজ বীরাঙ্গনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় মর্জিনা বেগমের বয়স ছিল ১৭। দুই বোন ও বাবা-মাসহ চারজনের সংসারে তখনও তার বিয়ে হয়নি। গোপালগঞ্জ জেলার শংকর পাশায় ছিল তাদের স্থায়ী বসতবাড়ি। আর পাশের গ্রামে কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়ায় ছিল পাকিস্তান আর্মির শক্ত ঘাঁটি। মর্জিনা বেগমের নিজের ভাষ্য, ‘মে মাসে একদিন দুপুরে পাকিস্তানী আর্মি তাদের বাড়িঘর ঘিরে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং চাচাত ভাই ইয়ার আলী, বোনাই হাবিবর শেখ, প্রতিবেশী চাচা আওয়াল মোল্লা, কুদ্দুস মোল্লা, মোখন শেখকে গুলি করে খুন করে। এত হত্যা করেও তাদের পিপাসা মিটে না। এ সময় দু’জন আর্মি মর্জিনাকে পাশে রাজ্জাক মোল্লার বাড়ির রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে পাশবিক অত্যাচার করে চলে যায়। ঘটনার পর তারা জীবন বাঁচানোর তাগিদে পরিবারসহ গ্রামের পূর্বদিকে তিলপায় এক খালার বাড়ি গিয়ে যুদ্ধের পুরো সময়টা পালিয়ে থাকেন। বর মিঠামইনের কাটাখাল ইউনিয়নের ছত্রিশ ঢালারগাঁও গ্রামের কলিকান্ত চক্রবর্তী। ১৪ বছরের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বাবা রামলোচন পরিবারের অন্য সদস্যদের পাশের কেওয়ারজোড় গ্রামে পাঠিয়ে দেন। মেয়ে রাসমনির বিয়ের ঠিক চারদিন পর ১৫ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানী সেনারা পুরো ছত্রিশ ঢালারগাঁও গ্রাম ঘিরে ফেলে। শতভাগ হিন্দু অধ্যুষিত এ গ্রামের সবাই দরিদ্র জেলে। পাকিস্তানী জান্তারা এই গ্রামকে টার্গেট করে এগোয়। রাজাকারদের সহায়তায় পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় মেতে উঠে লুটতরাজ শ্লীতাহানির উন্মত্ত নেশায়। অনেককে হত্যা করে গ্রামের প্রায় ৭৫ জনকে ধরে নিয়ে যায়। যার মাঝে ছিল রাসমনিও, তার স্বামী আর আত্মীয়স্বজনরা। নৌকার মধ্যেই চলে বর্বর হত্যাযজ্ঞ; রাসমনি কেঁপে উঠে সেই ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে; তার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করে পানিতে ফেলে দেয়া হয়। অন্যদেরও উল্লাস করতে করতে খুন করে পাকসেনারা। এর পরে রাসমনি আর অল্পবয়সী মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয় মিলিটারি ক্যাম্পে । রাসমনি নিজের বুদ্ধিমত্তায় সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে কিন্তু হিন্দু সমাজ তাকে আর গ্রহণ করে না। রাজিয়া খাতুন আদিবাড়ী কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলায়। ১৯৭১ সালে মেয়েটির বয়স ছিল ১৩ বছর। যুদ্ধ শুরু হওয়ায় উদ্বিগ্ন মা-বাবা তখনই মেয়েটিকে বিয়ে দেন একই এলাকায়। কিন্তু স্বামীর বাড়ি গিয়ে স্বামী-শ্বশুরের দেখা আর পায়নি সে। কয়েকদিন পর নিজের বাবার বাড়িতে ফিরে আসার পথে রাজাকারের খপ্পরে পড়ে ঠাঁই হয় পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্পে। সেখানে তার ওপর চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন। একদিন সেখানে থেকে কৌশলে পালানোর পর মুক্তি মেলে হতভাগ্য এ মেয়েটির। এরপর যুদ্ধরত মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে পরিচয় হলে তাদেরই একজন যুদ্ধ শেষে তাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেন; কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস; সেই মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধেই শহীদ হন। যুদ্ধ শেষে বিয়ে হয় কিন্তু স্বামীও কিছুদিন পর মারা যান। রেখে যান দুই সন্তান। রাজিয়া খাতুনের দুই ছেলের বয়স এখন ২৩ ও ২৬ বছর। কিন্তু তারা বেকার। মায়ের জীবনের দুর্ভাগ্য আর যন্ত্রণার প্রভাব পড়েছে তাদের জীবনেও। কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাজিয়া বলেন, ‘ জীবনডা শুরু অইল দুঃখ দিয়া, শেষও হইল দুঃখ দিয়া।’ পাহাড়ের বীরাঙ্গনাদের খবর অজানা ছিল অনেকের কাছেই। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও তারা থেকে গেছেন অন্ধকারে। মেলেনি কোন খেতাব বা স্বীকৃতি। ন্যূনতম সহায়তা পাননি কখনো। পাহাড়ী বলেই কি এই অবহেলা- এমন কথাও উঠেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খাগড়াছড়ির বীরাঙ্গনাদের মধ্যে একাত্তরের সবচেয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার এবং পরবর্তী সময়ে করুণ জীবনযাপনকারী হলেনÑ মহালছড়ি উপজেলার পাহাড়ী গ্রাম থলিপাড়ার চাইন্দাউ মারমা (৭০)। মা-বাবা বহু আগেই মারা গেছেন। স্বামী বেঁচে নেই। নেই ছেলেমেয়েও। এতটাই নিঃসঙ্গ তিনি। প্রতিদিন ভিক্ষা করতে পারলে হয়ত একবেলা ভাত জোটে। রাত পোহালেই খাবারের সন্ধানে ছুটতে হয়। না হয় খালি পেটেই থাকতে হয় সারাদিন। লাইলি বেগমের বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মদনপুর গ্রামে। বিয়ের পর লাইলির স্বামী যুদ্ধে গেলে পাকিস্তানীরা তাকে লাঞ্ছিত করে কেড়ে নেয় সম্ভ্রম। যুদ্ধ শেষে লোকলজ্জার ভয়ে তার বাবা মা তাকে মেয়ে হিসেবে শিকার করে নেয় না। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনার বিষয়ে জানা যায়, মাত্র ১৫-১৬ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় শ্রীপুরের মদনপুর গ্রামের মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। পরের বছরই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো তার স্বামী যশোর অঞ্চলে ৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর শ্রীপুর বাহিনীর প্রধান আকবর হোসেন মিয়ার দলে যোগ দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একই সঙ্গে যুদ্ধে যান তার দেবর মশিউর। পাকী সেনাদের শ্রীপুর অঞ্চলের ক্যাম্পটি ছিল তাদের বাড়ির খুব কাছাকাছি। যুদ্ধের শেষভাগে এক দুপুরে হঠাৎ গুলির শব্দে গোটা গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়ে। এ সময় ছয়-সাতজনের একদল পাকী সেনা লাইলি বেগমের বাড়িতে ঢুকে তাকে তাড়া করে। আতঙ্কিত লাইলি প্রতিবেশী আনোয়ারুল কবির আজমের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। পাকিস্তানী সেনারা লাইলিকে ঘর থেকে বের করে দেয়ার জন্য আনোয়ারুল আজম ও তার স্ত্রীকে গালাগাল করে ও অস্ত্র তাক করে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। আনোয়ারুল আজম সেনাদের বোঝাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে একপর্যায়ে পাকী সেনারা টেনেহিঁচড়ে লাইলিকে ঘর থেকে বের করে পাশের জঙ্গলে নিয়ে নির্যাতন চালায়। পরে তার দাদা শ্বশুর অচেতন অবস্থায় তাকে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে বাড়িতে এনে চিকিৎসা করান। মনোয়ার হোসেন বলেন, তার স্ত্রী লাইলির মতো বীরাঙ্গনাদের ত্যাগকে তিনি শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। কিন্তু কষ্ট পান যখন ভাবেন, এদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার লোহাগড়া ইউনিয়নের চরকালনা গ্রামের বিধবা বীরাঙ্গনা মর্জিনা বেগম। তিনিও স্বাধীনতা সংগ্রামে নির্মম নির্যাতনের শিকার। একাত্তরে মর্জিনার বয়স ছিল মাত্র সতেরো বছর। গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানি উপজেলার ভাটিয়াপাড়ায় ছিল পাকিস্তানী আর্মির শক্ত ঘাঁটি। কাশিয়ানি উপজেলার শংকর পাশা গ্রামে ছিল তাদের বাড়ি। দুই বোন ও বাবা-মাসহ চারজনের সংসার তখন। একাত্তরের মে মাসে আর্মিরা তাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। একজন আর্মি তাকে রান্নাঘরে নিয়ে ধর্ষণ করে। কয়েকদিন পর গ্রামের রাজ্জাক মোল্লার বাড়িতে তাকে ধরে নিয়ে দু’জন আর্মি আবার ধর্ষণ করে। দরিদ্র মর্জিনার যুদ্ধের পর পেট চলে অন্যের বাড়িতে কাজ করে। রাহেলা বর্তমানে থাকেন সিরাজগঞ্জের সয়াধানগড়া বাসস্ট্যান্ডের পাশে পুকুরপাড় বস্তিতে। একাত্তরের একদিনের কথা। বগুড়া থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি সিরাজগঞ্জ এসে পৌঁছায়। শহরে নির্বিচারে ঘরবাড়ি পোড়াতে থাকে পাকিস্তানী সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকাররা। রাহেলা বেগম ও তার স্বামী বেলগাতি গ্রামের এক হিন্দু বাড়িতে আশ্রয় নেন। ওই বাড়িতে তারা ছাড়াও আরও তিন নারী একটি ঘরে লুকিয়ে ছিলেন। ঘরে ঢুকে পড়ে হানাদাররা। নারীদের ওপর চলে তাদের লালসা কামনার অত্যাচার; এ সময় তার স্বামী এসে উপস্থিত হলে স্বামীর সামনেই রাহেলাকে বিবস্ত্র করা হয় তিনি হন ধর্ষিতা। সমাজে তিনি খারাপ মেয়ে বলে গ্লানি বয়ে বেড়ান। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাহেলা বেগমকে তালাক দেন তার স্বামী। কিন্তু সবার সামনে একাত্তরে ঘটে যাওয়া ঘটনা বর্ণনা করতে রাহেলা লজ্জিত হন না বরং দেশকে রক্ষার জন্যে সম্ভ্রম হারিয়েও নিজেকে গর্বিত ভাবেন কারণ তিনি স্বাধীন দেশে বাস করেন। স্বাধীনতা অর্জনে সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়েছিলেন। অনেক বীর কন্যার মতো মুক্তিযুদ্ধের পর বছরের পর বছর খেয়ে না খেয়ে চলতে হয় তাকে। অকুতোভয় কমলা বানু জানান, ১৯৭১- এ থাকতাম খোসসাবাড়িতে। মিলিটারিরা বাড়িতে আগুন দিলে পালিয়ে কাজিপুরের শালিভিটায় আশ্রয় নিই। সেখানে মুক্তিবাহিনীর রান্না-বান্নার কাজ করতাম। ক্যাম্পে তাদের গোলাবারুদ দেইখা রাখতাম, যারা মাটির নিচে লুকাইয়া থাকত তাদের খেয়াল রাখতাম। যখন মিলিটারিরা হামলা দিত তখন তারারে খবর দিয়া নিজেরা পালাইয়া থাকতাম। শালিভিটায় যখন হামলা দিল তখন ছালগাছা চইলা গেলাম। সে সময় আমাদের ধইরা অনেক হেস্তনেস্ত করে মিলিটারির লোকেরা। একটা ছেলে ছিল সে মিলিটারিদের খবর দিত। এখন তারাই নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে। সরকার তাদের বাড়িঘর দিছে। শান্তিতে দিন কাটাইতাছে তারা। আর আমরা খাইয়াপইরা বাঁচতে পারি না। ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের শশীগঞ্জ চাঁদপুর গ্রামের মজিদ পাটোয়ারী বাড়ির রেজাউল হকের স্ত্রী মালেকা বেগম। একাত্তরে তার ভগ্নিপতি আব্দুল মন্নান হাওলাদার ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বীরাঙ্গনা মালেকা বেগম বলেন, ‘ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে আমি বড় বোনের সেবা-শুশ্রƒষা করছি। ইংরেজী তারিখ ঠিক মনে নেই। বৈশাখ মাসের ২৫ তারিখে সকাল ১০টার দিকে ছয় পাকিস্তানী হানাদার আচমকা আমাদের বাসায় হানা দেয়। তখন আমরা দুই বোন সামনে এলেও ভগ্নিপতি আবদুল মন্নান চৌকির নিচে লুকিয়ে থাকেন। তাকে সেখান থেকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে দেয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলে। ভয়ে আমরা পালানোর চেষ্টা করি। একপর্যায়ে আমি, আমার ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বোন ফাতেমা ও তার পাঁচ বছরের মেয়ে রিজিয়া গোসলখানার ভেতরে পালালাম। অনেক খোঁজখুঁজির পর গোসলখানায় আমাদের পেয়ে সেখানেই অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করল নরপশুরা। এরপর ইস্কাটনি কলেজের দোতলায় নিয়ে ক্যাম্পে বন্দী করল। মালেকা বেগম জানান, টানা ৯ মাস পাকিস্তানীদের ওই ক্যাম্পে চলে মালেকা বেগম ও তার অন্তঃসত্ত্বা বোনের ওপর অমানুষিক নির্যাতন। ক্যাম্পে তাদের সঙ্গে ছিলেন আরও সাত-আটজন নারী। ওরা ঠিকমতো খাবারও দিত না। খাবার পানিও দিত না। অত্যাচার আর লালসা মিটানোর পর সবাইকে ঘরে রেখে বাইরে থেকে তালা মেরে দিত। ওই ক্যাম্পেই বোন ফাতেমা জন্ম দিল একটি পুত্র সন্তান। হানাদারদের সঙ্গে ছিল এক সিস্টার ও সুইপার। তারাই সন্তান জন্মের ব্যবস্থা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বন্দী জীবন থেকে মুক্ত করে আনেন। মালেকা বললেন, মুক্তিযোদ্ধারা পথ খরচা বাবদ ৫০০ টাকা করে দিয়ে যার যার ঠিকানা অনুযায়ী বাড়ি পাঠিয়ে দেন। সেই টাকা দিয়ে আমরা দুই বোন কুমিল্লা থেকে তজুমদ্দিনে চলে আসি। কিন্তু কোন দিন কারও কাছে একাত্তরের সেই দুর্বিষহ বন্দী জীবনের কথা বলতে পারিনি। একাত্তরের আরেক বীরকন্যা আমেনার জীবন চলে ভিক্ষা করে। তাকে পাকিস্তানীরা অত্যাচার করে কারণ একাত্তরের যুদ্ধে তার ছেলে মুক্তিবাহিনীর হয়ে কাজ করায়। আমেনা বলেন, ‘আমাকে ক্যাম্পের একটি কক্ষে অন্য মহিলাদের সঙ্গে আটকে রাখা হয়। রাতে সাত আট জন নরপশু পাকী সেনা তার ওপর চালায় পাশবিক নির্যাতন। ছেলে মুজাফ্ফরের খবর জানতে এভাবেই তার উপর চলে পাকী হায়েনাদের পাশবিক অত্যাচার। তার শরীর থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে মৃত ভেবে ফেলে দেয়া হয় বলে জানান আমেনা বেগম। পরে আল্লাহর রহমতে বেঁচে যান। আমেনা জানান, তাকে যে কক্ষে আটকে রেখে নরপশুরা পাশবিক নির্যাতন চালায় সেখানে আরও পঁচিশ তিরিশজন নারী ছিল। আমেনার এখনও মনে আছে লাইলি নামে এক মহিলা নরপশুদের ধর্ষণে মারা যায়। লক্ষ্মী রানী রায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের আরেক বীরকন্যা। একাত্তরের ৩ নবেম্বর নাজিরপুরের শাখারীকাঠি গ্রামে রাজাকারদের সহায়তায় প্রবেশ করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। গ্রামজুড়ে চালায় ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা, নির্যাতন। হানাদারদের হিংস্র থাবায় ক্ষতবিক্ষত হন লক্ষ্মী রানী। সম্ভ্রম হারানোর পর স্বামীর ঘরে ঠাঁই না পেয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন লক্ষ্মী। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর ছোট ভাইয়ের কাছে একটি ছোট্ট খুপরি ঘরে দিন কাটে তার। স্বাধীনতার এতদিন পরেও অনেকেই তাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে । এমন ঘটনা ঘটেছিল বীরকন্যা নূরজাহানের উপরও। একাত্তরে টানা ৪৪ দিন আটক ছিলেন পাকিস্তানীদের বন্দীশিবিরে। দেশ স্বাধীনের পর সেখনে থেকে উদ্ধার হলেন। কিন্তু ফিরে যেতে পারলেন না পরিবারে। চেষ্টা করেছিলেন বেশ কয়েকবার। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন আপনজনরা। কারণ তখনো বীরাঙ্গনা নূরজাহান বেগমকে (১৬) মেনে নেয়নি স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজ, সংসার, পরিবার। এখানেই শেষ নয়; লাঞ্ছিত বীরাঙ্গনাকে প্রয়োজন হলে বিয়ে করে সামাজিক প্রতিষ্ঠা দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সহযোদ্ধা কোম্পানি কমান্ডার; লজ্জায়, ঘৃণায়, অপমানে, অভিমানে তার কাছেও ফিরে যাননি নূরজাহান। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় গৌরবদীপ্ত রাজধানীর জনারণ্যে মিশে গিয়ে মুক্তি সংগ্রামী নূরজাহান শুরু করেছিলেন আরেক জীবন সংগ্রাম। অজানা মানুষের ভিড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বস্তিতে। ঝিয়ের কাজের পাশাপাশি মহিলা মুর্দার গোসল, প্রসূতির ধাত্রীর কাজ কোনটাই বাদ দেননি তিনি। অশ্রুসিক্ত প্রভা রানী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার দিন পনেরো পর গ্রামে পাঞ্জাবি আসে। একদিন সন্ধ্যার দিকে রাজাকারা বাড়িতে এসে মায়ের সামনে থেকে আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে যায় পার্শ্ববর্তী বাদল মাস্টারের বাড়ি। প্রথমে ভেবেছিলাম দৌড়ে পালাব, কিন্তু তাদের হাতে বন্দুক থাকায় গুলির ভয়ে আর পালাইনি। মাস্টার বাড়িতে পাকিস্তান আর্মিরা আগেই অবস্থান নিয়েছিল। এরপর ওই রাতেই হারাতে হয় সম্ভ্রম। পর দিন সকালে আর্মিরা আমাকে ছেড়ে দিলে বোনের বাড়ি জাঙ্গালহাটে গিয়ে আশ্রয় নিই। কয়েকদিন আত্মগোপন করে থাকি। কিন্তু কপাল মন্দ বিশ পঁচিশ দিন পর রাজাকাররা আবার আমার সন্ধান পেয়ে যায়। এবার আমাকে নিয়ে আসা হয় শমশের নগর ডাকবাংলোর পাকিস্তানী আর্মিদের ক্যাম্পে; পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দেয় রাজাকাররা। সেখানে ফের নির্যাতিত হতে হয়। একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। জ্ঞান ফিরে এলে কোন এক সময় হেঁটে হেঁটে নিজের বোনের বাড়িতে ফেরত আসি। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার পূর্ব চ-িপুর গ্রামের খাতুনপাড়ায় দরিদ্র জীবনযাপন করেন আলিফজান বিবি। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেন আর সেই সময় তার বয়স ছিল মাত্র পনেরো-ষোল। তার ভাষায়- মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়িতে তখন মা, ভাই আর খালা। বর্ষাকালে একদিন দুপুরে পাকিস্তানী সেনারা রাজাকারের সহযোগিতায় তাদের বাড়িসহ পূর্বপাশের বাড়ি ঘেরাও করে সবাইকে লাইনে দাঁড় করায়। তখন বাড়ির কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ শুরু করলে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। ভয়ে লাইনে দাঁড়ানো সবাই তখন একসঙ্গে কালেমা পড়া শুরু করেন। এক পাঞ্জাবি ‘সাচ্চা মুসলমান’ বলে কয়েকজন রাজাকারকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু আলিফজানকে ছাড়েনি তার অপরাধ সে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী আর নারী । দুই হানাদার তাকে ধরে রাখে এবং সবাইকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তারপর তাকে জোর করে ভয় দেখিয়ে তার শ্লীলতাহানি করে। যুদ্ধের পর বেঁচে গেলেও সবাই তাকে ছি ছি করে তাড়িয়ে দেয়। অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসে আর ভেঙ্গে যায় এরপর একজন বিয়ে করলেও কিছুদিন পরে ছেড়ে চলে যায়। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শুধু নারী হওয়ার কারণে ও মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার জন্যে যে বিপুলসংখ্যক কিশোরী থেকে শুরু করে তরুণী ও নারী, মা, বোন পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের দ্বারা নির্যাতনের শিকারে পরিণত হন তা সারাবিশ্বে খুব কমই ঘটেছিল। তাদের দোষ ছিল নারী হয়েও তারা যুদ্ধে সহায়তা করেছে বা তাদের স্বামী, ছেলে, বাবা বা ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এত বেশি সংখ্যক নারী তখন নির্যাতিত ছিলেন যে তাদের সঠিক হিসাব জানা কঠিন আর আরও কঠিন এ জন্যে যে তারা মুখ ফুটে লোকলজ্জার ভয়ে তাদের নির্মম অত্যাচারের কথা বলতে পারেন না। মহান মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অবদান রাখা লাখ লাখ নারীদের মাঝে মাত্র গুটিকয় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি পেয়েছেন আর বেশিরভাগই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাই মুক্তিযুদ্ধে বেঁচে যাওয়া এই বীরাঙ্গনাদের প্রাপ্য স্বীকৃতি দিতে আরও বেশি জোরালোভাবে সমাজকর্মী, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে। যারা আড়াল থেকে, নীরব যন্ত্রণা সহ্য করে জীবনের সব খুইয়ে ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। তাদের যথাযথ সম্মান না জানালে, প্রাপ্য মর্যাদা না দিলে আমাদের মহান স্বাধীনতার একটা বড় অধ্যায়কে অস্বীকার করা হবে । (তথ্য সূত্রঃ বীরাঙ্গনাদের জীবন সংগ্রাম- ২০১২ ও সহায়ক গ্রন্থ)
×