ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এজন্য জেল-জরিমানার বিধান রেখে আইন সংশোধনের উদ্যোগ

হাসপাতাল-ক্লিনিকের টেস্ট ফির তালিকা প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৩১ মার্চ ২০১৭

হাসপাতাল-ক্লিনিকের টেস্ট ফির তালিকা প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে

নিখিল মানখিন ॥ ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা হাসপাতালে প্যাথলজি ও ডাক্তারি পরীক্ষার মূল্য তালিকা প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে সরকার। এ জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন সংশোধন করছে সরকার। কোন প্রতিষ্ঠান তা না করলে এক বছর কারাদ-, ৫০ হাজার টাকা অর্থদ- অথবা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে খসড়া আইনে। জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বেসরকারী ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা হাসপাতালে প্যাথলজি ও ডাক্তারি পরীক্ষার ফি ইচ্ছেমতো আদায় করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। শুধু তাই নয়, রোগী মারার কারখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও নিম্নমানের হাসপাতাল। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। অধিদফতর জানায়, ২০০৯ সালের এ আইন সংশোধন হলে রক্ত, মলমূত্র পরীক্ষা, এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাম, এমআরআই, এনজিওগ্রাম, ইসিজি ও ইটিটি পরীক্ষার মূল্য তালিকা সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে ‘সহজে দৃশ্যমান স্থানে’ প্রদর্শন করতে হবে। বর্তমানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে বিভিন্ন ‘সেবা’র মূল্য তালিকা প্রদর্শনের কথা বলা হলেও সেবাগুলো নির্দিষ্ট করা ছিল না। আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত ই-মেইলে (ফহপৎঢ়@ুধযড়ড়.পড়স) খসড়ার ওপর মতামত দেয়া যাবে। সবার মতামত পাওয়ায় পর সংশোধিত আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হবে। সংশোধিত আকারে আইনটি পাস হলে সরকার এ আইনের আলোকে বিধি প্রণয়ন করতে পারবে বলে জানিয়েছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর। রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে দেশের অবৈধ ও প্রশ্নবিদ্ধ শত শত বেসরকারী ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা আর্থিক সুবিধা নিয়ে ওই সব অবৈধ প্রতিষ্ঠান লালনপালন করে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। র‌্যাব সদস্যের অভিযান প্রশংসিত হলেও ঘন ঘন অভিযান চালানো তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে দেশজুড়ে অবৈধ এসব সেন্টারের ছড়াছড়ি। সাইনবোর্ড সর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মনীতির বালাই নেই, হাতুড়ে টেকনিশিয়ানে চালানো হয় রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় পরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে ঠকাচ্ছে নিরীহ মানুষকে। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও দেশের অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। সরলতার সুযোগ নিয়ে এসব ক্লিনিকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দিনের পর দিন রোগীদের ঠকিয়ে যাচ্ছে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সরকারী হাসপাতালের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ফি ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, নামমাত্র খরচে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় সরকারী হাসপাতালে। অপারেশন, সিসিইউ, আইসিসিইউ ও ডায়ালাইসিস সেবার ক্ষেত্রে কোন টাকা নেয়া যাবে না। তবে বেশকিছু পরীক্ষা করাতে স্বল্প ফি নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও সরকারী ফি বেসরকারী হাসপাতালের ফির তুলনায় অনেক গুণ কম। সরকারী হাসপাতালে করোনারি এনজিওগ্রামে ২ হাজার টাকা, সিটি স্ক্যানে ২ হাজার টাকা, এমআরআই ৩ হাজার টাকা, ইসিজি ৮০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ২০০ টাকা, এক্স-রে ২০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ৩০০ টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ২ হাজার টাকা, ইউরিন ৩০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ১০০ টাকা। সকল হাসপাতালে ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। এই মুহূর্তে কোন ঘাটতি নেই। বেসরকারী হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি ॥ বেসরকারী হাসপাতালসমূহের চিকিৎসাসেবার খরচ অনেকটা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। প্রতিটি অপারেশনে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা লাগে। প্রতিদিন সিসিইউ সেবা পেতে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং আইসিইউ সেবা পেতে লাগে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। প্রতি সেশনে ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হয় প্রায় ৫ হাজার টাকা। এভাবে করোনারি এনজিওগ্রামে ১৫ হাজার টাকা, সিটি স্ক্যানে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা, এমআরআই ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা, ইসিজি ৩০০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা, এক্স-রে ৫০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ১ থেকে ৩ হাজার টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ১৫ হাজার টাকা, ইউরিন ২০০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ৪৫০ টাকা। রোগী মারার কারখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও নিম্নমানের হাসপাতাল। এসব সেন্টার থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। নানা সমালোচনার মধ্যেও সরকারী হাসপাতালের একশ্রেণীর ডাক্তারদের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্ট বাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। ডায়াগনস্টিক প্রতারণার শিকার হচ্ছে মানুষ। বার বার অভিযোগ তুলেও প্রতিকার পাচ্ছেন না। অভিযোগ উঠেছে, কমিশনের লোভে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বেশিরভাগ সরকারী হাসপাতালের প্যাথলজিক্যাল বিভাগটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দেয়া হয় না। এখানে সবচেয়ে দামী দামী আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হলেও অজ্ঞাত কারণে দ্রুততম সময়েই সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। রোগ নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারী অনুমোদন নেয়ারও প্রয়োজনবোধ করে না। কেউ কেউ লাইসেন্সের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে আবেদন পাঠিয়েই বড় বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রোগ নিরাময় কেন্দ্র খুলে বসেছেন। ভুঁইফোড় এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল বিভাগটি বরাবরই চরম উদাসীন। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রও নেয়নি অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টার। প্রতিনিয়ত রক্ত মিশ্রিত ব্যান্ডেজ, মাংসের টুকরো, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ও অন্যান্য আবর্জনা ফেলা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের আশপাশে, খোলা স্থানেই। নিয়ম অনুযায়ী এগুলো ইনসিনেটরে পোড়ানোর কথা। এসব বর্জ্য থেকে সিরিঞ্জসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ধুয়ে-মুছে আবার ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। ফলে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ ঘটছে। অপরদিকে এই বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে খোলা জায়গায় ফেলে রাখায় পরিবেশ দূষণ হচ্ছে মারাত্মকভাবে। ডাক্তাররা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সরবরাহকৃত সিøপে টিক মার্ক দিয়ে দেন কোন কোন টেস্ট করাতে হবে। রোগী তার পছন্দ মতো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই টেস্ট করালে ডাক্তার সে রিপোর্ট গ্রহণ করেন না। ডাক্তার তার নির্ধারিত সেন্টার থেকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে চাপ দেন। ওই সেন্টার তাকে কমিশন দেয়। কমিশন নিশ্চিত হলে পরেই চিকিৎসা। পরীক্ষার ফি বাবদ ইচ্ছে মাফিক টাকা-পয়সা আদায় করা হচ্ছে। একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য একেক প্রতিষ্ঠানে ধার্য আছে একেক ধরনের ফি। নিয়ম আছে রেট চার্ট স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের চোখে পড়ার মতো স্থানে লাগিয়ে রাখার। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ দীন মোহাম্মদ জানান, রাজধানীসহ সারা দেশের অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর তালিকা তৈরির কাজ চলছে। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান মহাপরিচালক। অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার উচ্ছেদকরণে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা শত শত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার দেশের স্বাস্থ্যসেবার জন্য চরম হুমকি। ওই সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজ সম্পাদনের অভিযোগও পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, দেশের ভাল ভাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক উঠিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। তবে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোরও উচিত চিকিৎসাসেবার দেয়ার সময় মানবিক দিক বিবেচনা করা। রোগীদের কাছে থেকে চড়া ফি আদায় করা ঠিক হবে না। দেশের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে খারাপের সংখ্যাই বেশি বলে তিনি মনে করেন। নির্ধারিত ফি আদায়ের ব্যাপারে অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে ফি নির্ধারণ করা উচিত। আর বিভিন্ন ক্লিনিকে সরকারী ডাক্তারের সঙ্গে রোগী পাচারের প্রথা বন্ধ করার দাবি জানান তিনি।
×