ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মৌলভীবাজারের নাসিরপুরের জঙ্গী আস্তানায় ‘অপারেশন হিট ব্যাক’

আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত ৮

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৩১ মার্চ ২০১৭

আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত ৮

গাফফার খান চৌধুরী/ সৈয়দ হুমায়েদ আলী শাহীন/মীর শাহ আলম ॥ মৌলভীবাজারে আবিষ্কৃত হওয়া দুটি জঙ্গী আস্তানার মধ্যে নাসিরপুরের আস্তানায় চালানো ‘অপারেশন হিট ব্যাক’ শেষ হয়েছে। অভিযানে নিহত হয়েছে আট জঙ্গী। তারা আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিহত হয়েছে। অভিযানকালে পুলিশ ও জঙ্গীদের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে অন্তত এক ডজন শক্তিশালী গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল নিহত জঙ্গীরা। আস্তানার ভেতরে বিপুল অস্ত্র, গোলাবারুদ নিষ্ক্রিয় করা, আলামত সংগ্রহ ও লাশ উদ্ধার করে হাসপাতাল মর্গে পাঠানোর কাজ চলছে। আস্তানার ভেতরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে মনুষ্যবিহীন বিশেষ গোয়েন্দা ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে। মৌলভীবাজারের অপর আস্তানা এবং কুমিল্লার আস্তানাটিতে শুক্রবার ভোর থেকে কড়া অভিযান শুরুর প্রস্তুতি চলছে। আস্তানা দুটি ঘিরে রেখেছে পুলিশ, র‌্যাব ও সোয়াট। সার্বিক কর্মকা- শেষ না হওয়া পর্যন্ত আস্তানার চারদিকে ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকবে। আস্তানাসহ আশপাশে বিদ্যুত ও গ্যাস সংযোগ সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। অভিযানসহ সার্বিক কর্মকান্ড শেষ হওয়ার পরই সেখানকার বিদ্যুত ও গ্যাস সংযোগ দেয়া হবে। মৌলভীবাজারে দুটি জঙ্গী আস্তানা ঘিরে টান টান উত্তেজনা ॥ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাতে মৌলভীবাজার পৌরসভার বড়হাট এলাকার একটি তিনতলা বাড়িতে জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মেলে। এর প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের সরকার বাজারের কাছে নাসিরপুর গ্রামের প্রায় তিন একর জমির ওপর নির্মিত একটি একতলা বাড়িতে আরেকটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পায় গোয়েন্দারা। বাড়ি দুটির মালিক যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশী সাইফুর রহমান। রাত থেকেই আস্তানা দুটি ঘিরে রাখে পুলিশ, র‌্যাব ও সোয়াট। আস্তানা দুটিতে অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত চারদিকে দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১৪৪ ধারা জারি বলবৎ থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে এলাকায় টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। নাসিরপুরের জঙ্গী আস্তানায় অভিযানে ৮ জঙ্গী নিহত ॥ বুধবার থেকে নাসিরপুরের জঙ্গী আস্তানায় সোয়াট ‘অপারেশন হিট ব্যাক’ শুরু করে। বৃহস্পতিবার দুপুর বারোটার দিকে চূড়ান্ত অভিযান শুরু করে সোয়াট। বৃহস্পতিবার বিকেল পৌনে চারটার দিকে শেষ হয়। অভিযান শেষে বৃহস্পতিবার বিকেলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের জানান, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ নাসিরপুরের ফতেহপুর জঙ্গী আস্তানাটি ঘেরাও করে। বুধবার পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, সোয়াট ও বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট সেখানে পৌঁছায়। প্রথমেই আস্তানার ভেতরে থাকা বিস্ফোরকের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আত্মসমর্পণের আহ্বানে জঙ্গীরা গুলি চালায় ও গ্রেনেড হামলা করে ॥ অভিযান শুরুর আগে সোয়াট মাইক দিয়ে আস্তানার ভেতরে থাকা জঙ্গীদের আত্মসর্মপণ করার আহ্বান জানায়। কিন্তু ভেতর থেকে মৌখিক কোন সাড়া দেয়নি। জঙ্গীরা গ্রেনেড হামলা করে ও গুলি চালিয়ে তাদের অবস্থার জানান দেয়। অভিযানকালে সোয়াটকে এপিবিএন, কাউন্টার টেররিজমের অন্যান্য টিম, পুলিশ ও র‌্যাব সহযোগিতা করে। জঙ্গীরা অভিযানের সময় অভিযানকারীদের লক্ষ্য করে ১২টি বিস্ফোরণ ঘটায়। সেগুলো শক্তিশালী গ্রেনেড ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাড়ির ভেতরে তল্লাশি ॥ বৃহস্পতিবার বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে সম্ভব হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বাড়িটির ভেতরে গ্রেনেড ও শক্তিশালী বোমা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিহত হয় জঙ্গীরা ॥ পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম জানান, অভিযানকালে জঙ্গীরা পালানোর পথ না পেয়ে তারা সম্ভবত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সপরিবারে আত্মহনন করে। সেখানে অন্তত ৮টি লাশ দেখা গেছে। লাশের চিত্র খুবই বীভৎস। এতটাই বীভৎস যে তা প্রচার করা সম্ভব নয়। নিহতদের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। দেখে বোঝার উপায় নেই সেগুলো পুরুষ না নারী। অভিযান শুরুর পর আত্মঘাতী জঙ্গীরা নিরুপায় হয়ে নিজেদের শরীরে সুইসাইডাল ভেস্টে থাকা গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মহত্যা করে বলে সার্বিক পর্যালোচনায় ধারণা করা হচ্ছে। আস্তানাটি নব্য জেএমবির ॥ মনিরুল ইসলাম আরও জানান, আস্তানাটি নব্য জেএমবি গড়ে তুলেছিল বলে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। জঙ্গী সংগঠনটির সদস্যরা ওই বাড়িতে আত্মগোপন করেছিল। এর আগে জঙ্গীদের ব্যবহৃত বিস্ফোরকে সঙ্গে নাসিরপুরে পাওয়া বিস্ফোরকের মিল রয়েছে। সীতাকু-ের অভিযানে যে ধরনের আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) পাওয়া গেছে, এখানকার আইইডিও একই রকম। ঘটনাস্থলে থাকা অবিস্ফোরিত বোমা ও গ্রেনেডের সঙ্গে বিমানবন্দরে পুলিশ চেকপোস্টে আত্মঘাতী হামলার চেষ্টাকারীর কাছে পাওয়া বোমা ও গ্রেনেডের মিল রয়েছে। মনিরুল ইসলাম বলছেন, আতিয়া ভবন ও নাসিরপুরের জঙ্গী আস্তানায় নিহত জঙ্গীরা নব্য জেএমবির সদস্য। মৌলভীবাজারের নাসিরপুরের আস্তানাটি নব্য জেএমবির সদস্যরা অতি গোপন আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছিল। জঙ্গীদের এই ঘাঁটি সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন ধারণা ছিল না। যে আস্তানার সূত্র ধরে নাসিরপুরের জঙ্গী আস্তানাটির সন্ধান মিলেছে সেটিও ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। এখনও সেখানে অভিযান চালানো হয়নি। মৌলভীবাজারে জঙ্গীদের আর কোন আস্তানার তথ্য বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশের কাছে নেই বলেও জানান তিনি। অভিযানে মনুষ্যবিহীন ড্রোনের ব্যবহার ॥ মনিরুল ইসলাম জানান, অভিযানে ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে। ড্রোন দিয়ে বাড়ির ভেতরের ছবি তোলা হয়েছে। পরবর্তীতে সেই ছবি দেখেই বাড়ির ভেতরে ও প্রবেশমুখে রাখা জঙ্গীদের গ্রেনেড ও বোমা নিষ্ক্রিয় করা হয়। আস্তানার জঙ্গীদের সঙ্গে কারও যোগাযোগ ছিল না ॥ নাসিরপুরের জঙ্গী আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত বাড়িটির কেয়ারটেকারের সঙ্গে জঙ্গীদের বিশেষ কোন যোগাযোগ বা আদর্শগত মিল আছে কিনা সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। নিহত জঙ্গীরা স্থানীয় নয় বলে স্থানীয়দের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। কারণ সেখানে আত্মগোপনে থাকা জঙ্গীরা কারও সঙ্গে মেলামেশা করত না। আশপাশের কেউ তাদের চেনেও না। জঙ্গীরা সব সময়ই বাসায়ই থাকত। জঙ্গীদের কেউ চাকরি করত না। তাদের সন্তানদের কেউ স্কুলে যেতে দেখেনি বলে স্থানীয়রা পুলিশকে জানিয়েছেন বলে জানান মনিরুল ইসলাম। অপর আস্তানায় অভিযানের প্রস্তুতি ॥ সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে মৌলভীবাজারের বড়হাটে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার আগেই সোয়াটের অভিযান চালানোর কথা রয়েছে। তবে অন্ধকার হয়ে গেলে অভিযানে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি থাকে। ঝুঁকিমুক্ত অভিযান চালানোর জন্য প্রয়োজনে শুক্রবার অপারেশন চালানো হবে বলে মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন। এর আগে বাড়িটির কেয়ারটেকার জুয়েল মিয়া পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে থাকা ব্যক্তিরা জঙ্গী কিনা জানতে চাইলে জঙ্গীরা সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালায় ও গ্রেনেড হামলা করেছিল। জঙ্গী আস্তানা দুটির বাড়ির মালিকের শ্যালক আটক ॥ বড়হাট ও নাসিরপুর গ্রামের জঙ্গী আস্তানা দুটির বাড়ির মালিক লন্ডনপ্রবাসী বাংলাদেশী সাইফুর রহমান। বাড়ি দুটিতে জঙ্গীদের আশ্রয় দেয়ার বিষয়ে জানতে বাড়ির মালিকের শ্যালক মিজানুর রহমানকে (৪০) বুধবার অভিযানকালে আটক করেছে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। যদিও পুলিশ এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেনি। ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার ও আলামত সংগ্রহের কাজ চলছে ॥ অভিযান শেষ হওয়ার পর আস্তানায় প্রবেশ করেছে পুলিশের বম্ব ডিসপোজাল টিম ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট। বোমা নিষ্ক্রিয়কারীরা ভেতরে থাকা বোমা নিষ্ক্রিয় করার কাজ করছে। তবে তারা কি পরিমাণ বোমা ও গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করেছেন তার সুনির্দিষ্ট কোন পরিসংখ্যান জানা যায়নি। ক্রাইম সিন আলামত সংগ্রহ করছে। সেই সঙ্গে চলছে নিহত জঙ্গীদের লাশ উদ্ধারের কাজ। লাশগুলো মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হবে। সেখানে লাশ থেকে আলামত সংগ্রহ করা হবে। এসব আলামতের ডিএনএ পরীক্ষা- নিরীক্ষা হবে। আস্তানার বাসিন্দা এক রিক্সাচালকের বক্তব্য ॥ নাসিরপুরের আস্তানায় তিনটি টিনশেড ঘর রয়েছে। তার একটিতে ছিলেন এক রিক্সচালক। তিনি জানান, তিনটি ঘরের মধ্যে একটিতে বাড়ির মালিকের আত্মীয় জুয়েল রানা কেয়ারটেকার হিসেবে থাকতেন। অন্য ঘরটি ভাড়া দিয়েছিলেন। যে ঘরটি জঙ্গীরা ভাড়া নিয়েছিল, তিন মাসে সেই ঘরের বাসিন্দাদের মধ্যে দুজন পুরুষ সদস্যকে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে একজনের বয়স ৪৫ থেকে ৫০ বছর। আরেকজনের বয়স ৩০ থেকে ৩২ বছর। তারা সম্ভবত শ্বশুর-জামাতা। বয়স্ক পুরুষ ব্যক্তির সঙ্গে তার একবার কথা হয়েছে। তিনি নিজেকে কাপড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। আর অন্য পুরুষ ব্যক্তি একটি কোম্পানিতে কাজ করেন বলে জানান। তারা কোন নির্দিষ্ট সময়সূচী মেনে বাড়ির বাইরে যেতেন না। বয়স্ক লোকটির পাঁচ সন্তান আছে বলে তার মনে হয়েছে। সবার বড় মেয়ে। তিনি বিবাহিত, সঙ্গে স্বামী আছেন। বয়স্ক ব্যক্তির এক সন্তান কোলের শিশু। বাকি তিন কন্যাশিশুর বয়স দুই থেকে সাত বছর। পাঁচ থেকে সাত বছর বয়সী দুই কন্যাশিশু বোরখার মতো পোশাক পরে থাকত। তিন শিশু মাঝেমধ্যে খেলতে ঘরের বাইরে বের হতো। এ সময় তাদের সঙ্গে বয়স্ক ব্যক্তিকেও দেখা যেত। তাকে দেখলে বয়স্ক ব্যক্তিসহ শিশুরা ঘরের ভেতরে চলে যেত। বয়স্ক ব্যক্তির স্ত্রী ও তার বড় মেয়েকে কখনও দেখেননি তিনি। ওই পরিবারটি তাদের ঘরের দরজা-জানালায় পর্দা দিয়ে রাখতেন। ফলে তাদের ঘরের ভেতরে কি আছে বা কি হচ্ছে, তা বোঝার কোন উপায় ছিল না। বাড়ির কেয়ারটেকারের বক্তব্য ॥ জুয়েল মিয়া জানান, নাসিরপুরের বাড়িটি চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভাড়া নেন বর্তমান ভাড়াটিয়ারা। ভাড়া নেয়ার সময় নিজেকে মাহফুজ বলে পরিচয় দেন। তার বাড়ি টাঙ্গাইল বলে জানান। মাহফুজ নিজেকে একটি কোম্পানির ডিলার পরিচয় দেন। সাত হাজার টাকায় বাড়িটি ভাড়া দেয়া হয়। ঘরে আট জন থাকে। আর অপর বাড়িটি বেলাল নামে পরিচয় দিয়ে ভাড়া নিয়েছেন। তিনি নিজেকে একটি কোম্পানির ম্যানেজার পরিচয় দিয়েছেন। শুক্রবার ভোরে কুমিল্লার জঙ্গী আস্তানায় অভিযান শুরুর কথা ॥ মঙ্গলবারই কুমিল্লার কোটবাড়িতে একটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। আস্তানাটি মঙ্গলবার থেকেই ঘিরে রাখা হয়েছে। বুধবার কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন থাকায় সেখানে অভিযান চালাতে নিষেধ করা হয় নির্বাচন কমিশন থেকে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা জানান, ভোটের সার্বিক কর্মকা- শেষ হওয়ার পর সেখানে অভিযান হবে। এ ব্যাপারে পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে শুক্রবার ভোরেই কুমিল্লার আস্তানায় অভিযান চালানোর কথা রয়েছে সোয়াটের।
×