ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ এপ্রিল ফুল বৃত্তান্ত

প্রকাশিত: ০৪:১০, ৩১ মার্চ ২০১৭

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ এপ্রিল ফুল বৃত্তান্ত

মিথ্যা কথা বলে বোকা বানিয়ে তামাশা করার দিন হিসেবে পয়লা এপ্রিল বিবেচিত হলেও এই দিনটিতে লুকিয়ে আছে এক করুণ বিয়োগান্ত ঘটনার স্মৃতি, যা আজও অন্তরে দারুণ ব্যথার উদ্রেক করে। বোকা বানিয়ে তামাশা করার দিন হিসেবে পরিচিত হলেও বস্তুত এ দিনটি হচ্ছে শোকের। আমরা জানি, স্পেনের গথিক রাজা রডারিকের জুলুম-নির্যাতন ও কুশাসনে সেখানকার প্রজাসাধারণ এতই পীড়িত অবস্থায় দিন গুজরান করছিল যে, তারা এই অত্যাচার ও উৎপীড়নের হাত থেকে রক্ষাকারীর আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল। রাজা রডারিক শুধু অত্যাচারীই ছিলেন না, তার চরিত্রও ছিল অত্যন্ত জঘন্য, এমনকি সিউটা দ্বীপের শাসনকর্তা কাউন্ট জুলিয়ানের সুন্দরী কন্যা ফ্লোরিন্ডার শ্লীলতাহানি করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। অত্যাচারী ও লম্পট রাজা রডারিকের অপশাসন থেকে মুক্তি পাবার জন্য, স্পেনের মানুষের স্বাধীনতা লাভের জন্য স্পেনের জনগণের পক্ষে কাউন্ট জুলিয়ান উমাইয়া খলিফা, ওয়ালিদের খিলাফতের পশ্চিম অঞ্চলের গবর্নর মূসা বিন নূসায়েরের কাছে পত্র প্রেরণ করেন। মূসা বিন নূসায়ের স্পেন দেশ থেকে এই আকুল আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৭১০ খ্রিস্টাব্দে বীর সিপাহসালার তারিক ইব্নে যিয়াদকে ৪০০ সৈন্য, ১০০ ঘোড়া ভর্তি চারখানা রণতরীসহ স্পেনের উদ্দেশে প্রেরণ করেন। তারিক সাগর পাড়ি দিয়ে স্পেন ভূখ-ের যে পর্বতের পাদদেশে অবতরণ করেন তার নামকরণ হয়ে যায় জাবালুত্ তারিক বা তারিকের পাহাড়, যা জিব্রালটার নামে স্প্যানিশ ভাষায় পরিচিত হয়। তারিক এই স্থানটিতে একটি সুরক্ষিত সেনানিবাস স্থাপন করে অতিদ্রুত স্পেনের অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালনা করেন। আলজিরিয়াস প্রদেশে এসে পৌঁছলে সেখানকার প্রাদেশিক গবর্নর থিওডমিরকে পরাজিত করে তিনি আরও সামনের দিকে অগ্রসর হন এবং বীর বিক্রমে রাজধানী টলেডোর দিকে দ্রুতবেগে এগিয়ে যেতে থাকেন। উত্তর স্পেনে বিদ্রোহ দমনরত রাজা রডারিক মুসলিম সেনাপতির স্পেন ভূখ-ে আগমনের খবর পেয়ে দ্রুত রাজধানীতে এসে এক লাখ বিশ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে তারিক বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য অগ্রসর হন। ইতোমধ্যে তারিকের বাহিনীতে আরও সৈন্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে মূসা বিন নূসায়ের সৈন্য প্রেরণ করেন। মোট বারো হাজার সৈন্য নিয়ে বীর সিপাহসালার এগোতে থাকেন। রডারিক বারো লাখ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে গোয়াডিলট নদীর তীরে অবস্থিত মেডিনা সিডোনিয়া নামক স্থানে তারিক বিন রিয়াদের বাহিনীকে মোকাবেলা করতে আক্রমণ পরিচালনা করেন। এক সপ্তাহ ধরে যুদ্ধ হয়। অতঃপর মুসলিম মুজাহিদ বাহিনীর জিহাদী তাকতের সামনে রডারিক টিকতে না পেরে পলায়ন করতে গিয়ে গোয়াডিলট নদীতে সৈন্যবাহিনীসহ ডুবে মারা যান। এটা ছিল মুসলিম বাহিনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজয়। এর ফলে কারমোনা, ইসেজা, সিডোনা প্রভৃতি তারিকের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই বিজয়ে স্পেনের সাধারণ জনগণ আনন্দ উল্লাস করতে থাকে। তারা গথিক শাসনের করালগ্রাস থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পায়। তাদের মধ্যে স্বাধীনতার আনন্দ জোয়ার প্রবাহিত হয়ে যায়। তারিক সম্পূর্ণ স্পেনকে স্বাধীন করার জন্য সেনাবাহিনীকে চার ভাগে বিভক্ত করে একটিকে কর্ডোভার দিকে, আর একটিকে মালাগার দিকে, একটিকে গ্রানাডা ও ইলভিয়ার দিকে পাঠালেন আর মূল বাহিনী নিয়ে তিনি গথিক রাজার রাজধানী টলেডোর দিকে অগ্রসর হলেন। প্রায় বিনা বাধায় সাধারণ জনগণের প্রচুর খোশ্ আম্দেদ লাভ করতে করতে মালাগা, কর্ডোভা, গ্রানাডা, টলেডোতে ৭১১ খ্রিস্টাব্দেই ইসলামের বিজয় নিশান উড্ডীন হলো, স্বাধীনতার সুবাতাস প্রবাহিত হলো। তারিক বিন যিয়াদের এই গৌরবময় সাফল্যের খবর পেয়ে সম্পূর্ণ স্পেনে বিজয়ের সুফল সংহত করার জন্য গবর্নর মূসা ইবনে নূসায়ের আঠারো হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে ৭১২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে স্পেনে এসে উপস্থিত হলেন। মূসা এবং তারিকের সম্মিলিত বাহিনী একে একে সারগোসা, তেরাগোনা, এ্যারাগোনা, বারসিলোনা, লিওন, গ্যালিসিয়া প্রভৃতি প্রদেশে বিজয় অর্জন করে। তাদের এই বিজয় পর্তুগাল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, পর্তুগালের নাম হয় আল গারব অর্থাৎ পশ্চিমাঞ্চল। স্পেনে যে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো, ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এই স্পেনে যে প্রকৃত স্বাধীনতার বিজয় নিশান উড্ডীন হলো তা ৭৮০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। স্পেনে মুসলিম শাসনের ফলে কেবলমাত্র স্পেনের ইতিহাসেই নয়, সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে শিক্ষা, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান সবকিছুর ক্ষেত্রেই এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সংযোজন করে। কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগা, সেভিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানপীঠে পরিণত হয়। পৃথিবীর সবখান থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্পেনে শিক্ষার্থীদের ভিড় জমত। মানব প্রতিভার ও শিল্পকলার সর্বোৎকৃষ্ট বিকাশ সাধিত হয়েছিল স্পেনে। আধুনিক সভ্যতার অনেক উপাদানই স্পেনে উদ্ভাবিত হয়েছিল। স্থাপত্য শিল্পের অসাধারণ নিদর্শন গড়ে উঠেছিল স্পেনে, যেমন : কর্ডোভার মসজিদ, গ্রানাডার দারুল উসূদ বা সিংহপুরী, আলহামরা প্রাসাদ। এই আলহামরার মৌচাকের মতো মনোরম ঝাড় স্থাপত্য শিল্পে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করে। মুসলিম স্পেনে বহু বিজ্ঞানী, প-িত, সমাজবিজ্ঞানী, আবির্ভূত হন, যারা বিশ্ব জ্ঞানরাজ্যে আজও শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত রয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ইবনে হায়সম, আল-ইদ্রীসী, আবূ উবায়দুল্লাহ, আলবাকারী, ইবনে জুবায়ের ইবনে বতুতা, ইবনে খলদুন প্রমুখ। ইবনে খলদুনের পুরো নাম হচ্ছে আবদুর রহমান ইবনে খলদুন। আধুনিক সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের জনক বলা হয় ইবনে খলদুনকে। তার ইতিহাসগ্রন্থের মুকাদ্দামা বা ভূমিকা আধুনিক ইতিহাসের পথনির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হয়। আল বাকারী ও আল ইদ্রীসী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভূগোলবিদ ও ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে সর্বস্বীকৃত মনীষী। এ ছাড়াও আল মাজরিতী, আল জারকানী, ইবনে ফালাহ প্রভৃতি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে এবং আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ উদ্ভিদতত্ত্ববিদ হিসেবে অগ্রপথিক হিসেবে গণ্য হন। বিশ্বসভ্যতার তদানীন্তন কেন্দ্রস্থল মুসলিম স্পেনে পুনরায় করায়ত্ত করার লক্ষ্যে খ্রীস্টানরা অত্যন্ত সন্তর্পণে রিকনকয়েস্টা অর্থাৎ পুনর্দখল আন্দোলন শুরু করে। ক্রমান্বয়ে তারা সর্বত্র ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে এবং শাহী মহলে বিরোধের আগুন প্রজ্বলিত হতে থাকে। কয়েক শ’ বছর ধরে চলা এই ষড়যন্ত্র একে একে তাদের সিংহাসন দখলের পথ খুলে দিতে থাকে। একে একে তারা সব দখল করতে থাকে। শেষ দখলকার্যটি তারা সম্পন্ন করে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ৩ জানুয়ারি সুলতান আবূ আবদুল্লাহর সঙ্গে কাস্তলার সম্রাট ফার্ডিনান্ডের ৬০ দিন মেয়াদী এক চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৫টি শর্ত সংবলিত ওই চুক্তি অতি গোপনে সম্পাদিত হওয়া সত্ত্বেও তা জানাজানি হয়ে যায়। সৈন্যবাহিনী এবং শান্তিপ্রিয় জনসাধারণের মধ্যে সুলতানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও বিক্ষোভ এ জন্য ছড়িয়ে পড়ে যে, আবূ আবদুল্লাহ্ অযৌক্তিকভাবে মুসলিম শাসনের ক্ষতি সাধন করছেন। অত্যাচারী ফার্ডিনান্ড যদি ক্ষমতা পায় তাহলে স্পেনের স্বাধীনতা বিঘিœত হবে, সর্বস্তরের জনগণের ওপর নেমে আসবে শোষণ-নির্যাতন এবং অত্যাচারের জগদ্দল পাথর। সেনা ছাউনিতে এবং নগরে নগরে বিক্ষোভের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। আবু আবদুল্লাহ্ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিজের জান বঁাঁচানোর জন্য চুক্তির ৬০ দিন পূর্ণ হতে না হতেই ফার্ডিনান্ডের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ফার্ডিনান্ড ক্ষমতা পেয়েই জনগণের বিক্ষোভের তোয়াক্কা না করে আলহামরা প্রাসাদে রানী ইসাবেলাসহ প্রবেশ করেন এবং আলহামরা প্রাসাদ চূড়ায় উড্ডীয়মান ইসলামী পতাকা নামিয়ে সেখানে ক্রুশ স্থাপন করেন। এরপর নেমে আসে অত্যাচার আর নির্যাতন, যা ব্যাপকভাবে কার্যকর করা হয় মুসলিমদের ওপর। হাজার হাজার মুসলিমকে বন্দী করে প্রহসনমূলক বিচারের কাঠগড়ায় দঁাঁড় করিয়ে মুত্যুদ-ে দ-িত করা হতে থাকে এমনকি অনেককে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। অতঃপর এক সাধারণ নির্দেশ জারি করা হয় যে, স্পেনে বসবাসরত প্রত্যেক মুসলিমকে খ্রীস্টান হতে হবে, যদি কেউ খ্রীস্টান না হয় তাহলে যেখানেই তাকে পাওয়া যাবে সেখানেই হত্যা করা হবে। এই হুকুমনামা জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিমগণ নগর ত্যাগ করে পাহাড়-পর্বতে আত্মগোপন করতে লাগল। একটি মুসলিমও খ্রীস্টান হতে রাজি ছিল না। এ অবস্থা দেখে চতুর ফার্ডিনান্ড মুসলিম নিধনের এক নতুন কৌশল প্রয়োগ করল। ঘোষণা দেয়া হলো : যে সব মুসলিম জানমাল, পরিবার-পরিজন নিয়ে এ দেশ ছেড়ে ওপারের আফ্রিকায় যেতে চায় তাদের জন্য অনেক নৌজাহাজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে, তাতে আরোহণ করলে তাদের নিরাপত্তার সঙ্গে ওপারে পৌঁছে দেয়া হবে। এ জন্য নির্দিষ্ট সময়ও বেঁধে দেয়া হয়। এই ঘোষণা শুনে পাহাড়-পর্বতে, নিরাপদ স্থানে যারা লুকিয়েছিল সেই সব মুসলিম নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধ সবাই জাহাজে গিয়ে উঠল। তাদের সঙ্গে কয়েক লাখ মূল্যবান গ্রন্থও ছিল। যথাসময়ে জাহাজ ছাড়ল। পয়লা এপ্রিল সকালবেলায় সবার অজান্তে খ্রীস্টান গুপ্তচররা জাহাজের তলা ফুটো করে দিয়ে অন্য জাহাজে করে পালাল, আর মুসলিমদের বহনকারী জাহাজগুলো গভীর সমুদ্রে তলিয়ে গেল। সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হলো। মূল্যবান সম্পদ ও গ্রন্থরাজি ডুবে গেল। সেই শোকের স্মৃতি, মুসলিম নিধনের করুণ স্মৃতিবাহী পয়লা এপ্রিল তামাশা করে বা মিথ্যার আশ্রয়ে বোকা বানাবার দিন হিসেবে পরিগণিত করা হয়েছে, এটা মানবতার জন্য অতি লজ্জাকর। যাকে মিথ্যা কথা বলে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে তামাশা করা হয় তাকে বলা হয় এপ্রিল ফুল। এটার প্রবর্তন করা হয় ফ্রান্সের নবম চার্লস কর্তৃক ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ক্যালেন্ডারের সংস্কারকালে পয়লা এপ্রিলকে এপ্রিল ফুল ডে হিসেবে চিহ্নিত করেন। এটা ইংল্যান্ডে বিস্তৃত হয় ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। ফ্রান্সে যাকে নিয়ে এই তামাশা করা হয় তাকে এপ্রিল ফিশও বলা হয় আবার স্কটল্যান্ডে বলা হয় এপ্রিল গাউক। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ২৩ জুন পলাশী প্রান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাছ থেকে আমাদের জন্মভূমি ছিনিয়ে নিয়ে এখানে ব্রিটিশ শাসনের বুনিয়াদ স্থাপন করে, এপ্রিল ফুলও আমাদের দেশে এসে যায়। আমরা না জেনে, না বুঝে অনেক সময় ভিনদেশী সংস্কৃতিকে গ্রহণ করি, যা আমাদের জন্য ক্ষতিকরই শুধু নয়, অপমানজনকও। অতএব, এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের বিশ্বাস, ইমান-আকিদা বিনষ্টকারী, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধ্বংসকারী কোন কিছু যত বেশি আমরা পরিহার করতে পারব, তত আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বুনিয়াদ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে, আমাদের স্বকীয়তা বিশ্ব দরবারে আমাদের মর্যাদাকে সমুন্নত করবে। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা)
×