ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

লাক্ষা ও সিল্ক

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ৩১ মার্চ ২০১৭

লাক্ষা ও সিল্ক

লাক্ষা একটি অপ্রচলিত কৃষিপণ্য হলেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিশ্বজুড়ে। এক সময়ে সরকারী অফিস-আদালতে গোপনীয়তা রক্ষার নিমিত্ত সিলগালার কাজে লাক্ষাজাত গালার ব্যাপক ব্যবহার হতো। এর বাইরেও গহনাশিল্প এবং আসবাবপত্র পালিশের কাজে গালার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। পরিবেশবান্ধব এবং অর্গানিক বিধায় এর রফতানির সম্ভাবনাও সমুজ্জ্বল। যে কারণে লাক্ষাকে বলা হয় কালো সোনা। এক সময়ে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সন্নিহিত অঞ্চলে লাক্ষা চাষ হতো ব্যাপকভাবে। লাক্ষা একটি অতি ক্ষুদ্র কীটবিশেষ, যার শরীর থেকে প্রতিবছর অন্তত দুবার লাল রঙের রস নির্গত হয়ে থাকে, যা মূলত শিশু লাক্ষা। এটি পোষক গাছের ডালের রস খেয়ে বেঁচেবর্তে থাকে এবং লালা নিঃসরণ করে। যা পরিণত হয় শক্ত আঠালো পদার্থে। এটিই লাক্ষা বা লাহা নামে পরিচিত। পরে চাষীরা তা সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করে লাক্ষা রসকে পরিণত করে চাকতি আকৃতির গালায়। কুল, পলাশ, ডুমুর, বাবলা, খয়ের, শাল, শিরীষ ইত্যাদি বৃক্ষ লাক্ষা চাষের জন্য সমধিক উপযোগী। তবে বাংলাদেশে বর্তমানে এসব গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় প্রধান পছন্দ হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে কুল অর্থাৎ বড়ই গাছকে। এতে একদিকে যেমন অর্থকরী ফল হিসেবে কুল আহরিত হচ্ছে, অন্যদিকে পাওয়া যাচ্ছে ঘনীভূত লাক্ষা রস। চল্লিশের দশক পর্যন্ত ওই অঞ্চলে লাক্ষা চাষের রমরমা অবস্থা ছিল। পরে স্থানীয় অধিবাসীসহ সরকার তথা কৃষি বিভাগ আম চাষে অধিক মনোযোগী হওয়ায় ভাটা পড়ে লাক্ষা চাষে। লাক্ষার জমি প্রায় সবই চলে যায় আম বাগানে। তদুপরি আম চাষে পোকামাকড় দমনে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলেও সম্প্রসারিত হতে পারছে না লাক্ষা চাষ। তবে সর্বশেষ, ১৯৯০ সাল থেকে নতুন করে কাজ শুরু করেছে লাক্ষা চাষ উদ্ভব, উন্নয়ন ও গবেষণা কেন্দ্র। এই কেন্দ্র থেকে কৃষকদের স্বল্পমূল্যে লাক্ষা বীজ বিতরণসহ প্রয়োজনীয় পরামর্শও প্রদান করা হচ্ছে। আশাব্যঞ্জক দিক হলো, এর ফলে আশপাশে ধীরে হলেও লাক্ষা চাষের পুনরুজ্জীবন ঘটছে। লাক্ষার অনুরূপ আরও একটি প্রাকৃতিক কৃষি পণ্য ছিল বাংলাদেশের রেশম শিল্প। রাজশাহী সিল্কের সুনাম এক সময় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বিদেশেও। তবে দুঃখজনক হলো রেশম চাষের সেই স্বর্ণযুগ আজ আর নেই। রাজশাহী সিল্কের গৌরবও মৃতপ্রায়। প্রধানত আম চাষ ও আম বাগানের আধিক্যে রেশমের গুটি পোকার প্রধান খাদ্য তুঁত গাছ প্রায় নির্বাসিত। বর্তমানে রেশম চাষের পরিমাণ খুবই সীমিত হয়ে আসছে বিধায় সিল্কের চাহিদা মেটাতে হয় উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে সুতা আমদানি করে। অথচ দেশে পতিত জমির অভাব নেই। অনাবাদী জমিও রয়েছে। সেসব অব্যবহৃত জমিতে পরিকল্পিত উপায়ে তুঁত ও লাক্ষা গাছ লাগানো হলে রেশমের গুটি উৎপাদন এবং লাক্ষা চাষ খুবই সম্ভব। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় এসব কৃষিজাত পণ্য আবাদের জন্য সবিশেষ উপযোগী। অপ্রচলিত কৃষিপণ্য বিধায় বর্তমান বিশ্বে এসব পণ্যের ব্যাপক চাহিদা, দামও চড়া। এর ফলে স্থানীয়ভাবে বেকারত্ব হ্রাসের পাশাপাশি বাড়তে পারে কর্মসংস্থান। সব সময় সবকিছু যে সরকারী উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় হতে হবে, এমন কোন কথা নেই। এ ক্ষেত্রে বেসরকারী উদ্যোক্তা এবং এনজিওগুলো এগিয়ে আসতে পারে। সে অবস্থায় রাজশাহী সিল্ক ও লাক্ষা চাষের গৌরব পুনরুদ্ধার হবে বলেই প্রত্যাশা।
×