ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছোটমণি নিবাস

পরিচয়বিহীন শিশুরা যেখানে বড় হচ্ছে নিবিড় পরিচর্যায়

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৩০ মার্চ ২০১৭

পরিচয়বিহীন শিশুরা যেখানে বড় হচ্ছে নিবিড় পরিচর্যায়

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ নাম-পরিচয়বিহীন শিশুদের নিরাপদ আবাসস্থল কোথায়? তা হয়ত অনেকেরই অজানা। পত্রিকার পাতায় আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্নস্থান থেকে পরিত্যক্ত শিশু উদ্ধারের সংবাদ পেয়ে থাকি। রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব শিশুর আশ্রয় মেলে ছোটমণি নিবাসে। যেখানে শূন্য থেকে সাত বছর বয়সী শিশুরা নিবিড় পরিচর্যায় বড় হয়। সাত বছরের মধ্যে যদি কেউ আদালতের মাধ্যমে কোন শিশুর অভিভাবকত্ব না নেয়, তাহলে তাদের জায়গা হয় সরকারেরই আরেক প্রতিষ্ঠান ‘শিশু পরিবারে’। সেখানে পিতমাতৃৃহীন এসব শিশু আঠারো বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। সম্প্রতি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল থেকে পরিচয়বিহীন নবজাতক দুই কন্যাশিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। এই দুই শিশু জন্মানোর পর হাসপাতালে রেখেই তাদের মা চলে যান। খোঁজ করে সন্ধান না পাওয়ায় দুই শিশুর আশ্রয় মিলেছে ছোটমণি নিবাসে। এরা বড় হবে তার মতো নাম-পরিচয়বিহীন অন্যান্য শিশুর সঙ্গে। ছোটমণি নিবাসে আনার পর দুই শিশুর নাম দেয়া হয়েছে আয়েশা ও জিনিয়া। বুধবার দুপুর ১২টা নাগাদ রাজধানীর আজিমপুর গোরে শহীদ মাজার সংলগ্ন শিশুদের সরকারী পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘ছোটমণি নিবাস’ সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেল, আয়েশা ও জিনিয়াকে কোলে নিয়ে নিবাসের দুই কর্মচারী ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার পুরনো বিমানবন্দর এলাকায় এক নবজাতককে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল। যাকে মৃত মনে করে তাকে কুকুরের একটি দল খেতে শুরু করেছিল। তাৎক্ষণিক কয়েক জন দৃশ্যটি দেখে কুকুরকে তাড়িয়ে শিশুটি ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসে। দীর্ঘ চিকিৎসার পর শিশুটি আশ্রয় পায় আজিমপুরের ছোটমণি নিবাসে। তবে নাকে এবং হাতে এখনও সে বহন করছে কুকুরের কামড়ের ক্ষতচিহ্ন। এখানে আসার পর তার নাম দেয়া হয়েছে ফাইজা। আড়াই বছর যাবত ফাইজা এখানে আছে। ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে সে। ছোটমণি নিবাসের হলরুমে ঘুমিয়ে থাকতে দেখা গেল তাকে। যদিও সে একাই ঘুমাচ্ছিল। বাকিরা খেলায় মগ্ন। ফাইজার মতো মোট ২৬ শিশু রয়েছে ছোটমণি নিবাসে। সমাজসেবা অধিদফতরের উদ্যোগে ১৯৬২ সালে পরিত্যক্ত শিশুদের পুনর্বাসনের জন্য গড়ে তোলা হয় ‘ছোটমণি নিবাস’। পাঁচ তলাবিশিষ্ট ভবনের দুই আর তিন তলায় ছোটমণি নিবাসের শিশুদের থাকা ও খাওয়া, পড়াশোনা, খেলার জায়গা রয়েছে। ভবনের চতুর্থ তলায় শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র। চুরি হওয়া বা হারিয়ে যাওয়া শিশুরও জায়গা হয় এই নিবাসে। ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহী বিভাগীয় শহরে রয়েছে ‘ছোটমণি নিবাস’। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেল, একটি হলরুমের মতো বড় ঘরে শিশুদের থাকার ব্যবস্থা। সেখানে তাদের খেলার ব্যবস্থা আছে, বিনোদনের জন্য টিভি, সঙ্গে নানা শিক্ষামূলক উপকরণও। হলরুমে দেখা গেল, লম্বা একটি খাট। এই খাটেই ২৬টি শিশু একসঙ্গে শুয়ে ঘুমায়। দেখা গেল ফাইজা ও আরও তিনটি এক বছরের শিশু সারি বেঁধে শুয়ে আছে এই খাটে। আর বাকিরা একসঙ্গে খেলছে যে যার মতো। এরা সবাই পিতৃমাতৃহীন, পরিত্যক্ত। কেউ জানে না এদের ঠিকানা কোথায়, আত্মীয়-পরিজন কারা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থান থেকে এদের উদ্ধার করা হয়েছে। এখন রাষ্ট্রীয় আশ্রয়ে আছে তারা। ২৬টি শিশুর মধ্যে ৪টি ছেলে শিশু ও বাকিরা কন্যা শিশু। এসব শিশু মিলে একটি পরিবার তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদককে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল কয়েকটি শিশু। নাম জিজ্ঞাসা করতেই ফিক করে হেসে একজন বলল জান্নাতী। পাশেরজন বলল আকাশী। তারা দুজনেই গোলাপী রঙের ফ্রক পরে আছে। দুজনের বয়স আনুমানিক চার বছর। জান্নাতীকে দেখিয়ে যখন আকাশীকে প্রশ্ন করা হলো, সে তোমার কি হয়? তখন আকাশী বলল ‘ও আমার জান্নাতী’। এরা প্রত্যেকেই একে অন্যের ওপর মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। এসব ছোট্টমণি জানে না কে তাদের বাবা-মা? তবে এখানকার দায়িত্বরতরা তাদের বাবা-মার অভাবও বোধ করতে দেন না। কারণ এদের প্রত্যেককেই হাসি খেলার মধ্যে বড় করা হচ্ছে। এখানকার প্রত্যেকেই সমান সুযোগ-সুবিধার ভোগ করছে। এসব শিশুর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মোট ১৩ কর্মচারী বরাদ্দ রয়েছে। তারা বিভিন্ন সময়ে শিফটিং ডিউটি করে। রাতে দুজন নারী কর্মচারী শিশুদের দেখাশোনার জন্য থাকে। দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা বিভিন্ন কর্মচারীর দেখভালের মধ্যে এসব শিশু বড় হয়ে উঠছে। এছাড়াও দুজন শিক্ষক আছেন যারা এসব শিশুকে পড়ানোর পাশাপাশি দেখাশোনা করেন। ছোটমণি নিবাসে উপ-তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিযুক্ত আছেন জুবলী বেগম রানু। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ছোট মণি নিবাস হচ্ছে শিশুদের ফাউন্ডেশন। এখানে একদিন বয়সী নবজাতক থেকে শুরু করে সাত বছর বয়স পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সী শিশুরা থাকে। এখানে অনুমোদিত আসনসংখ্যা রয়েছে ১০০টি। বর্তমানে ২৬ শিশু আছে এখানে। এদের মধ্যে যারা একেবারে ছোট তাদের পেছনে সারাক্ষণই একজন আয়া থাকে। ছয়মাস বয়স পর্যন্ত তাদের কৌটার দুধ খাওয়ানো হয়। এর পর আস্তে আস্তে খিচুড়িসহ স্বাভাবিক খাবার খাওয়ানো হয়। অসুস্থ হলে বাচ্চাদের কোথায় চিকিৎসা করানো হয় প্রশ্নের উত্তরে জুবলী বেগম বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে আমরা ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসা চলে। বিনামূল্যে সেখানে শিশুকে দেখানো হলেও ওষুধ এখান থেকেই কেনা হয়। জানা গেল, খাদ্য, দুধ ও জ্বালানিবাবদ ছোটমণিদের জন্য জনপ্রতি মাসিক বরাদ্দ দুই হাজার টাকা। শিক্ষা-বিনোদনের জন্য বরাদ্দ ১০০ টাকা। পোশাক-পরিচ্ছদের জন্য বরাদ্দ ২০০ টাকা। চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ ১৭৫ টাকা ও তেল-সাবানের জন্য রয়েছে ১২৫ টাকা। মোট বরাদ্দ দুই হাজার ৬০০ টাকা। এর বাইরে বিভিন্নজন বিভিন্ন খাবার ও অন্যান্য অনুদান দিয়ে থাকেন। সম্প্রতি ছোটমণি নিবাসের বিভিন্ন রুম, রান্নাঘর, টয়লেট-বাথরুমসহ বারান্দায় রঙের কাজ করা হয়েছে। দেয়ালে আঁকা হয়েছে বিভিন্ন ছবি। টয়লেট-বাথরুমগুলোও অনেকটা ঝকঝকে। উপ-তত্ত্বাবধায়ক জুবলী বেগম বলেন, আমি গত বছরের নবেম্বরে এখানে এসেছি। মাত্র পাঁচ মাস হচ্ছে। আমি এসে দেখেছি এখানকার টয়লেট বাথরুমগুলো পিচ্ছিল, সব রুম ও বারান্দার দেয়ালে রংচটা। ইতোমধ্যেই সব ঠিক করা হয়েছে। এখন ছোটমণি নিবাসে অনেক সুন্দর পরিবেশ। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেল, বারান্দায় ছোট ছোট কাপড় শুকাতে দেয়া হয়েছে। রান্নাঘরও বেশ পরিষ্কার। রান্নাঘরের পাশের ঘরটি স্টোর রুম, তার সামনের ঘরে দুপুরের খাবার রাখা আছে। সেখানে একটি বড় টেবিল ও বেঞ্চ রাখা আছে। সেখানে বসেই শিশুরা খাবার খায়। এ ঘরে বসে থাকতে দেখা গেল একজন মধ্যবয়স্ক নারীকে। জুবলী বেগম জানালেন তিনি এখানকার বাবুর্চি। তবে তিনি সরকারীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত নন। সাময়িকভাবে তাকে এখানে রাখা হয়েছে। অনেকদিন ধরেই বাবুর্চির পদটি খালি রয়েছে। ছোটমণি নিবাসে ঢুকতেই দেখা গেল পাঁচ তলা ভবনের নিচে নেই কোন প্রহরী। ছোট ছোট পা দিয়ে সোনামণিরা যে কোন সময় গেটের বাইরে চলে যেতে পারে। তবে তা দেখভালের জন্যও নেই কোন রক্ষী বা দারোয়ান। জানা গেল নৈশপ্রহরীর পদও খালি। একমাত্র কলাপসিবলই গেটই নিরাপত্তার বলয়। প্রায় সবসময়ই এই গেট লাগানো থাকে। আর শিশুরা এই গেট খুলে যেতে পারে না বলে জানালেন এক কর্মচারী। সোনামণিরা অসুস্থ হলে তাদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য দুজন চিকিৎসকের নিয়োগ থাকার কথা ছোটমণি নিবাস ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৩ এ লেখা থাকলেও এই পদে কোন জনবল নেই। এছাড়া কম্পাউন্ডারের পদও খালি। শীঘ্রই এসব পদে জনবল নিয়োগ দেয়া হবে বলে জানালেন দায়িত্বরত উপ-তত্ত্বাবধায়ক। এসব শিশুর দত্তক নেয়া প্রসঙ্গে জুবলী বেগম জানালেন, এই ছোটমণি নিবাস ও শিশু পরিবারগুলোতে থাকার চাইতে শিশুরা আরও ভালভাবে বেড়ে উঠতে পারত, যদি তারা থাকত পারিবারিক আবহে। কিন্তু সারা বিশ্বে দত্তক নেয়ার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশের আইনে এ ব্যবস্থাটি নেই। তবে পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে অনেক নিঃসন্তান দম্পতি এসব শিশুকে দত্তক নিতে পারেন। এক্ষেত্রে ওই পরিবারের অর্থনৈতিক সচ্ছলতাসহ পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো তত্ত্বাবধায়নের মাধ্যমেই আদালত শিশুটিকে তাদের হাতে তুলে দেয়। ছোটমণি নিবাসের এসব সোনামণিরা এখানে মাত্র সাত বছর পর্যন্ত থাকতে পারবে। এর পর তাদের আশ্রয় মিলবে সরকারী শিশু পরিবারে। সেখানে তারা থাকতে পারবে আঠারো বছর পর্যন্ত। সেখানে তাদের পড়াশোনা করানো হবে। সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণও দেয়া হবে। বর্তমানে ছোটমণি নিবাসে কয়জন সাত বছর বয়সী শিশু আছে জানতে চাইলে জুবলী বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, তিনটি শিশু আছে একটি ছেলে ও দুটি মেয়ে যাদের বয়স সাত বছরের কাছাকাছি। এক মাসের মধ্যেই তাদের শিশু পরিবারে পাঠানো হবে। জানা গেল, শিশু পরিবারে থাকতেই নানা অপরাধের জন্য দায়ী শিশুদের ছোটদের কারাগার হিসেবে খ্যাত গাজীপুরের কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। অনেকে দীর্ঘদিন সেখানেই থাকে সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত। আবার অনেকে ফিরে এসে পড়ালেখা অথবা কারিগরি প্রশিক্ষণে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আঠারো বছর পার হওয়ার পর এসব কিশোর-কিশোরী নিজ উপার্জনে বাঁচতে চেষ্টা করে। তারা ছড়িয়ে যায় সমাজের মূল স্রোতে।
×