ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনে ব্যস্ত চারুকলা

লোকজীবন আর শেকড়ের সংস্কৃতি, বর্ণাঢ্য উপস্থাপনা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৩০ মার্চ ২০১৭

লোকজীবন আর শেকড়ের সংস্কৃতি, বর্ণাঢ্য উপস্থাপনা

মোরসালিন মিজান ॥ চারুকলার পরিবেশটা সব সময় যেমন, এখন তার থেকে আলাদা। অনেক বেশি প্রাণবন্ত। ভরপুর। নতুন পুরনো সব শিক্ষার্থীদের বিপুল সমাবেশ ঘটেছে সবুজ খোলা আঙিনায়। বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরাও আছেন ছায়ার মতো। সবার উপস্থিতিতে দারুণ সরগরম হয়ে ওঠেছে প্রিয় প্রাঙ্গণ। একদিকে চলছে হাসিরাশি আড্ডা গান। গুনগুন। অন্যদিকে ওয়াটার কালার। এ্যাক্রেলিক। দারুণ সব ছবি। ততোধিক উজ্জ্বল রঙ গায়ে মেখে উপুড় হয়ে আছে মাটির সরা। বহুবিধ মুখোশ তৈরি হচ্ছে। সুতোয় বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে কাগজের পাখি। বিশাল আকার ও আকৃতির বাঘ হাতি পুতুল গড়ার কাজও শুরু হয়ে গেছে। সব দেখে মনে হয়, বৈশাখের বুঝি আর বাকি নেই। আদতে, কিছুদিন এখনও হাতে আছে। তাতে কী? বাংলা নববর্ষ বরণ বলে কথা। বিশাল কর্মযজ্ঞ। তাই অন্যান্যবারের মতো আগেভাগেই শুরু হয়েছে প্রস্তুতি। বিদায়ী বছর ১৪২৩ বঙ্গাব্দের শেষ মাস চৈত্র এখন। মাসের অর্ধেক গত হয়েছে। বাকি দিনগুলো দেখতে দেখতে চলে যাবে। তারপর ১৪২৪ বঙ্গাব্দ। নতুন বছর বরণ করে নিতে এবারও থাকছে অযুত আয়োজন। তবে প্রধানতম আয়োজনটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা। সকলের মঙ্গল কামনায় পহেলা বৈশাখ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে এই শোভাযাত্রা বের করা হবে। অজস্র মানুষের পদযাত্রা থেকে লোকায়ত জীবন ও সংস্কৃতির জয়গান গাওয়া হবে। সেই লক্ষ্যে চলছে প্রস্তুতি। বুধবার বিকেলে চারুকলা অনুষদের অর্ধেক খোলা গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই বৈশাখ যেন হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিল। জয়নুল গ্যালারির সামনের জায়গাটুকু আর খালি পড়ে নেই। এইটুকুন জায়গায় কত কী যে হচ্ছে! গ্যালারির একেবারে গা ঘেঁষে আছে কয়েকটি টেবিল। পাশাপাশি রাখা টেবিলে রঙের ছড়াছড়ি। কৌটোগুলোর মুখ খোলা। ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে হলুদ সবুজ লাল নীল সাদা কালো তরল। পছন্দের রং তুলিতে মেখে নিয়ে সরাচিত্র আঁকছেন শিক্ষার্থীরা। গ্রামীণ ঐতিহ্যের চেনা অনুসঙ্গ মাটির সরা চোখের সামনে স্বতন্ত্র শিল্পকর্ম হয়ে ওঠছে। লোক ঐতিহ্যের নানা অনুসঙ্গ থেকে মোটিভ খুঁজে নিচ্ছেন শিল্পীরা। সেভাবেই আঁকছেন। হাতি বাঘ মাছ পাখি থেকে শুরু করে হরেক রকমরে প্রাণীর মুখ দৃশ্যমান হচ্ছে সরার গায়ে। লোকজ ফর্মের সঙ্গে চলছে নীরিক্ষাও। শিল্পী সুবণ্যার আঁকা লক্ষ্মী প্যাঁচাটির কথাই যদি ধরা যায়, প্যাঁচার চেনা অবয়বটি নতুন ফর্মে তুলে ধরেছেন শিল্পী। হুবহু আঁকা হয়নি রাধা কৃষ্ণকেও। কিছু সংযোজন বিয়োজন লক্ষ্য করা যায়। গ্রামীণ লোককাহিনীগুলোকেও আশ্রয় করা হয়েছে। আঁকা হয়েছে মহুয়ার মতো কালজয়ী চরিত্র। নকশিকাঁথার ফর্ম ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবে শহুরে জীবন আর ধারকরা সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হওয়ার সচেতন প্রয়াস গ্রহণ করেছেন শিল্পীরা। আঁকা সরার চমৎকার প্রদর্শনী চলছে দেয়ালে। কী যে ভাললাগে দেখতে! প্রতিটি সরা আপাতত ৫০০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পরে দাম আরও বেড়ে যাবে বলে জানান আয়োজকরা। সরার ঠিক উল্টো দিকে চলছে পেইন্টিংয়ের কাজ। শিল্পীরা নিজেদের মতো করে ছবি আঁকছেন। বিখ্যাত শিল্পদের কাজ আছে। তেমনি আঁকছেন নবীন শিল্পীরা। একেকজনের কাজ একেক রকম। ছবি আঁকা শেষ হতেই সেগুলো ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে দেয়ালে। বেশিরভাগ ওয়াটার কালার। কিছু এ্যাক্রেলিক মাধ্যমে করা। এখান থেকে তিন থেকে চার লাখ টাকার শুধু ওয়াটার কালার বিক্রি হয় বলে জানান আয়োজকরা। সমকালীন শিল্পীদের কাজ অপেক্ষাকৃত কম দামে সংগ্রহ করার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন শৌখিন সংগ্রাহকরা। বর্ষবরণ উৎসবের আরেক অনুসঙ্গ মুখোশ। মুখোশ না হলেই নয়। জয়নুল গ্যালারির ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, কাঁচি দিয়ে কাগজ কাটার কাজ চলছে। টুকরো টুকরো কাগজ জোড়া দিতেই বাঘের অবয়ব। প্যাঁচার মুখটি! সেই মুখ পরে রং দিয়ে এঁকে নেয়া হচ্ছে। মুখোশের কাজ দেখাশোনা করছেন নামিরা ফারজানা। চারুকলার এই শিক্ষার্থী জানান, তারা মূলত বাঘ ও প্যাঁচার মুখোশ তৈরি করছেন। আকারে কোনটি বড়। কোনটি আবার ছোট। দাম ২০০ থেকে ৩০০০ টাকার মধ্যে। সময় পাওয়া গেলে ছোট ছোট পাখি গরু মহিষের মুখোশ তৈরির ইচ্ছে আছে বলে জানান তিনি। জয়নুল গ্যালারি থেকে লিচুতলায় যাওয়ার পথে দেখা যায়, বড় মুখোশ তৈরির কাজও সমান তালে এগিয়ে চলছে। বড় মুখোশ মানে, পেপারম্যাশ। মেঝেতে মাটি দিয়ে বেশ কয়েকটি অবয়ব তৈরি করা হয়েছে। আঠাযুক্ত কাগজ দিয়ে এগুলো মুড়িয়ে দেয়া হবে। কয়েক স্তর কাগজ শুকোলে সহজেই মাটি থেকে আলাদা করা যাবে। তখনই মুখোশগুলো পরিষ্কার হবে। অধিকাংশই রাজা রানীদের মুখোশ। এগুলো বিক্রির জন্য নয়। মঙ্গল শোভাযাত্রার অগ্রভাগে রাখা হবে। চারুকলার প্রস্তুতির মূল আকর্ষণ ভাস্কর্য। বিশাল বিশাল ভাস্কর্য গড়া হচ্ছে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে। লিচুতলায় দু একটি কাঠামো দাঁড়াতে শুরু করেছে। একটি বিশালাকৃতির মা পুতুল। মহাস্থান গড় থেকে নেয়া ফর্ম ব্যবহার করা হচ্ছে পুতুল তৈরিতে। অন্য ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে থাকছে বাঘ, হাতি, দুই মাথা বিশিষ্ট পাখি উল্লেখযোগ্য। এগুলোকে প্রধান করেই এগিয়ে যাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রস্তুতি পর্ব এগিয়ে নিতে বিশেষ ভূমিকা আছে কাগুজে পাখির। কাগজ কেটে বানানো পাখির চাহিদা তুঙ্গে। তুহিন পাখি নাম। না হলেই নয়। লিচুতলা সংলগ্ন ছোট্ট ঘরটিতে চলছ তুহিন পাখি বানানোর কাজ। অনেকে একসঙ্গে বসে পাখি তৈরি করছে। কিছুক্ষণ আগে কাগজ। কেটে জোড়া দিতেই অদ্ভুত পাখি! সুতোয় বাঁধা পাখি বাতাস পেয়ে যেন ওড়ছে। এবার আয়োজনটির মূল দায়িত্ব পেয়েছে চারুকলা অনুষদের ১৮ ও ১৯তম ব্যাচ। কয়েকজন মিলে গোটা কাজের সমন্বয় করছেন। তাদের একজন রাজিব। প্রস্তুতির পুরোটা ঘুরে দেখান তিনি। বলেন, সব কাজ এগিয়ে চলেছে। আমরা প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করছি। যত দিন যাবে ব্যস্ততা ততো বাড়বে। সারারাত জেগে কাজ করতে হবে। সবাই মনের আনন্দে এই কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করছে জানিয়ে তিনি বলেন, শিল্পীদের শিল্পকর্ম বিক্রির অর্থে আয়োজন করা হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবারের আয়োজন সম্পর্কে জানতে কথা হয় চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেনের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, পরস্পরের মঙ্গল কামনায় আমরা এই মঙ্গল শোভযাত্রার আয়োজন করে থাকি। আয়োজনটি এবার ইউনেস্কোর ইনটেনজিবল কালচারার হ্যারিটেজের মর্যাদা লাভ করেছে। অর্জনের দিকটি বিবেচনায় রেখে সেøাগান ঠিক করা হয়েছে- ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে। আমরা আনন্দের সঙ্গে এই বিশ্ব স্বীকৃতি উদ্যাপন করব। ফিরে তাকাব পেছনে। বিগত বছরগুলোতে যেসব উল্লেখযোগ্য মোটিফ শোভাযাত্রায় বহন করা হয়েছে সেগুলো আবারও তুলে ধরা হবে। সকল অশুভ অপশক্তি মৌলবাদ জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বছরের প্রথম দিনে আসুন হাতে হাত ধরি। একে অন্যের মঙ্গল চিন্তা করে শুরু হোক নতুন বছর।
×