ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

২২ হাজার স্কুল ও মাদ্রাসা ছেয়েছে পোস্টারে পোস্টারে

আজ স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচন, স্কুলে স্কুলে উৎসবের আমেজ

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৩০ মার্চ ২০১৭

আজ স্টুডেন্টস কেবিনেট নির্বাচন, স্কুলে স্কুলে উৎসবের আমেজ

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ভর্তির হার বৃদ্ধি, ঝরে পড়া রোধ, উন্নয়ন কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করা আর শিশুদের মাঝে গণতন্ত্র চর্চার ব্যতিক্রমী আয়োজন ‘স্টুডেন্টস কেবিনেট’ নির্বাচন হতে যাচ্ছে আজ। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ নির্বাচন হতে যাচ্ছে দেশের ২২ হাজার মাধ্যমিক স্কুল ও মাদ্রাসায়। যেখানে প্রায় এক কোটি ভোটার নির্বাচিত করবেন ২২ হাজার প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী। নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে এখন স্কুলে স্কুলে শিশুদের মাঝে রীতিমতো উৎসবের আমেজ। প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন, ছাপা পোস্টার নিষিদ্ধ, তাই স্কুলে স্কুলে ঝোলানো হয়েছে হাতে লেখা পোস্টার। গত বছর মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে স্টুডেন্ট কেবিনেট গঠনের ঘটনা ইতিবাচক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। ‘ছোটদের মন্ত্রিসভা’ গঠনের ঘটনা ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মাঝে। সেই সফলতার ধারাবাহিকতায় আজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ব্যতিক্রমী এ স্টুডেন্ট কেবিনেট নির্বাচন। যেখানে শিশুরাই ভোট দিয়ে নিজেদের মধ্য থেকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে। যাদের কেউ দেখবে শিক্ষা, কেউ দেখবে সাংস্কৃতিক কর্মকা-, কেউ দেখবে স্কুলের পরিবেশ, কেউ দেখবে আইনশৃঙ্খলা আবার কেউ দেখবে খেলাধুলার সকল বিষয়। একজন হবে প্রধানমন্ত্রী। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) অধীন সকল প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন কমিশনার, প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করবে শিশুরাই। শিক্ষা অধিদফতর জানিয়েছে, ইতোমধ্যে নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার বড় পরিসরে নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই নির্বাচন দেশের প্রতিটি বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য আছে সরকারের। নির্বাচনী দায়িত্ব পালন সম্পর্কে নীতিমালায় বলা হয়েছে, এ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনার, প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসার এবং আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব ছাত্রছাত্রীরাই পালন করবে। শিক্ষক ও স্কুল ম্যানেজিং কমিটি এবং অভিভাবকরা এ বিষয়ে সহযোগিতা করবেন। নির্বাচনে মুদ্রিত কোন পোস্টার ও প্রতীক ব্যবহার করা হবে না। স্টুডেন্ট কেবিনেটের মেয়াদ হবে এক বছর। এদিকে নির্বাচনে বিজয়ীদের দায়িত্ব ও এর উদ্দেশ্যের দিকে তাকালেই যুগান্তকারী এই উদ্যোগের ইতিবাচক দিক নজরে আসবে যে কারও। যেখানে নেই কোন অপরাজনীতি। আছে গণতন্ত্র ও শিক্ষা এবং শিক্ষাঙ্গনের উন্নয়নে শিশুদের সম্পৃক্ত করার নানা দিক। ছাত্রছাত্রীদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত আট প্রতিনিধির প্রধান দায়িত্ব ও সম্পাদিত কর্মকা-গুলো হলোÑ পরিবেশ সংরক্ষণ (বিদ্যালয়, আঙিনা ও টয়লেট পরিষ্কার এবং বর্জ ব্যবস্থাপনা), পুস্তক ও শিখন সামগ্রী, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি এবং সহপাঠ কার্যক্রম, পানি সম্পদ, বৃক্ষরোপণ ও বাগান তৈরি, দিবস ও অনুষ্ঠান উদ্যাপন এবং অভ্যর্থনা ও আপ্যায়ন, আইসিটি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এসব দায়িত্ব বণ্টন করবেন। স্টুডেন্ট কেবিনেট গঠনের উদ্দেশ্যগুলো হলোÑ বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম এবং উন্নয়ন কর্মকা- বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, বিদ্যালয়ে শতকরা ১০০ ভাগ শিক্ষার্থী ভর্তি ও ঝরে পড়া রোধে সহযোগিতা করা, অন্যের মতামতের প্রতি সহিষ্ণুতা এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন, শিক্ষা কার্যক্রমে ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা সম্পর্কে অভিভাবক এবং অন্যদের অবহিত এবং উদ্বুদ্ধকরণ, শিশুকাল থেকে গণতন্ত্রের চর্চা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। এ নির্বাচনে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আটজন করে প্রতিনিধি নির্বাচন করা হবে। যাদের মধ্য থেকে একজন প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হবেন। আর স্কুলে সাধারণত প্রতিনিধিদের মন্ত্রী আর প্রধান প্রতিনিধিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ডাকা হবে। এছাড়া কেবিনেট নির্বাচনের সকল কার্যক্রমই আয়োজন করবে শিক্ষার্থীরা। দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে প্রধান শিক্ষক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মনোনীত করবেন। আর অষ্টম ও নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে দুজন নির্বাচন কমিশনার মনোনীত করা হবে। প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসারেরও দায়িত্ব পালন করবে শিক্ষার্থীরা। ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবে আট সদস্যের এই স্টুডেন্টস কেবিনেট। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর যে কোন শিক্ষার্থী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারছে। একজন ভোটার সর্বোচ্চ আটটি ভোট দেবে। এর মধ্যে প্রতি শ্রেণীতে একটি করে এবং যে কোন তিন শ্রেণীতে সর্বোচ্চ দুটি করে ভোট দেয়া যাবে। ফলে প্রতিটি শ্রেণী থেকে একজন করে প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। পাঁচ শ্রেণীতে পাঁচজন নির্বাচনের পর সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত তিন শ্রেণীর আরও তিনজন নির্বাচিত হবে। অন্যান্য নির্বাচনের মতোই ব্যালট বাক্স, ব্যালট পেপার, ভোটকেন্দ্র, বুথ থাকবে। তবে প্রার্থীদের কোন প্রতীক দেয়া হবে না। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রতিটি শ্রেণী থেকে দুজন করে সহযোগী সদস্য মনোনীত করবে। স্টুডেন্টস কেবিনেট প্রতি মাসে কমপক্ষে একবার করে সভা করবে। ছয় মাস পর পর সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিতে সাধারণ সভা করবে। এদিকে দেশের ২২ হাজার মাধ্যমিক স্কুল ও মাদ্রাসায় প্রায় এক কোটি ভোটারের অংশগ্রহণে এখন বিরাজ করছে রীতিমতো উৎসবের আমেজ। ছাপা পোস্টার নিষিদ্ধ তাই বলে বসে নেই কেউ। স্কুলে স্কুলে ঝোলানো হয়েছে হাতে লেখা পোস্টার। পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। একই চিত্র রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলেও। রাজধানীর মিরপুরের সিদ্ধান্ত হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম রনি বলছিলেন, সারাদেশের স্কুলগুলোর মতো তার স্কুলেও নির্বাচনকে ঘিরে শিশুদের মাঝে এখন আনন্দ। শিশুরা কেউ প্রধানমন্ত্রী, কেউ মন্ত্রী হতে চায়। তারা নেতৃত্ব দিতে চায়। অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে তারা নির্বাচনের জন্য এখন প্রস্তুত। একই চিত্র ঢাকার বাইরেও। মাদারীপুরের নামী প্রতিষ্ঠান ডনোভান উচ্চ বিদ্যালয়ে নির্বাচনকে ঘিরে যেন শিশুদের উৎসব চলছে কদিন ধরেই। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক বিবেকানন্দ বাড়ৈ বলছিলেন, শিশুরা যেন উৎসব করছে। আদন্দের মাঝে চলছে নির্বাচনের প্রস্তুতি। পোস্টারে পোস্টারে তারা পুরো প্রতিষ্ঠান এমনকি গাছেও লাগিয়েছে হাতে লেখা শত শত পোস্টার। নরসিংদীর ঘোড়াশাল ইউরিয়া সার কারখানা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও তাদের শিশুদের নিয়ে নির্বাচনের আনন্দে মেতেছেন। শিশু শিক্ষার্থী তাবাসসুম বলছিল, আমাদের খুব ভাল লাগছে। আমরা মিছিল করেছি কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কোন কথা বলিনি। কোন প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেনি। সবাই মিলে আমরা নির্বাচন করছি। স্যারেরা আমাদের সহযোগিতা করছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সচিব মোঃ সোহরাব হোসাইন বলেন, শিশুকাল থেকেই গণতন্ত্রের চর্চা, মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন শেখাতে এই স্টুডেন্ট কেবিনেট নির্বাচন। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের দায়িত্বের পাশাপাশি শিক্ষকদের নানা কাজেও সহায়তা করবে। শিশুদের ব্যতিক্রমী এ আয়োজনকে অত্যন্ত ইতিবাচক উল্লেখ করে মাউশি অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রায় প্রত্যেকেই বলছেন, খুদে শিক্ষার্থীদের মাঝে সামাজিক দায়িত্ববোধ, নেতৃত্বসুলভ গুণাবলীর বিকাশ, গণতন্ত্র চর্চার অভ্যাস গড়ে তোলা, পরমত সহিষ্ণুতা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে সম্পৃক্ত করাই এর লক্ষ্য। উদ্যোগ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকলের সহাযোগিতা কামনা করেন কর্মকর্তারা। মাউশির শিক্ষা কর্মকর্তা (মাধ্যমিক-১) চন্দ্র শেখর হালদার ব্যতিক্রমী এ আযোজনকে ইতিবাচক উল্লেখ করে বলছিলেন, যেসব স্কুলে আগে স্টুডেন্ট কেবিনট হয়েছে আমরা দেখেছি সেখানে অনেক পরিবর্তন এসেছে। স্কুলের পরিবেশই পাল্টে গেছে। অনেক স্কুলে অভিভাবকদের সহায়তায় স্কুলে কম্পিউটার সংগ্রহ করেছে প্রতিনিধিরাই। এছাড়া নিজেরাই নির্বাচন আয়োজন করার অভিজ্ঞতা তাদের ভবিষ্যতের কাজে সহায়ক হবে। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ বিল্লাল হোসেন বলছিলেন, নির্বাচিত স্টুডেন্ট কেবিনেট প্রতি মাসে একবার করে সভা করবে। এর বাইরে প্রতি ৬ মাসে একবার সকল শিক্ষার্থীদের নিয়ে সাধারণ সভা করবে। এই সভায় কেবিনেটের সকল কার্যক্রম সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের অবহিত করতে হবে।
×