ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

তেলবাহী ওয়াগনের সঙ্কট;###;ভারতের ঋণে কেনা ৮১ ফুয়েল ট্যাংকার ত্রুটিপূর্ণ

ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৩০ মার্চ ২০১৭

ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ গ্রীষ্ম মৌসুমে সব বিদ্যুত কেন্দ্রের নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন চালু রাখার প্রস্তুতি নেয়া হয় প্রতিবছর। বোরো মৌসুম, গরমের তীব্রতা ও আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে তেল নির্ভর বিদ্যুত কেন্দ্রে পর্যাপ্ত জ্বালানি মজুদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ইতোমধ্যে। কিন্তু পরিবহন জটিলতায় চট্টগ্রামের দুটি বিদ্যুত কেন্দ্রে ফার্নেস অয়েল মজুদ বাড়ানো যাচ্ছে না। পর্যাপ্ত ফার্নেস অয়েল মজুদ থাকা সত্ত্বেও সরবরাহ সঙ্কটের কারণে হাটহাজারী ও দোহাজারী বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুত পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়। বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানায়, চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে যে কোন পরিস্থিতিতে ২৪ ঘণ্টা (পিক আওয়ার ছাড়াও) ফার্নেস অয়েল নির্ভর বিদ্যুত কেন্দ্র চালানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেলপথে হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুত কেন্দ্রে ফার্নেস অয়েল সরবরাহ করা হয়। দোহাজারী বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতাও ১০০ মেগাওয়াট। ফার্নেস তেলভিত্তিক একটি বিদ্যুত কেন্দ্রের ৫ ঘণ্টা উৎপাদনে ১০০ মেট্রিক টন ফার্নেস তেল প্রয়োজন হয়। ২৪ ঘণ্টা উৎপাদন করলে প্রয়োজন হয় ২৫০ মেট্রিক টন। আগে বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোতে কয়েকদিন পর পর ফার্নেস অয়েল পরিবহন করা হতো। এখন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত উৎপাদন করতে একদিন পর পর ফার্নেস অয়েল পরিবহনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ বিদ্যুত বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি পরিবহন করতে পারছে না। এতে আসন্ন চাহিদা মৌসুমে বিদ্যুত উৎপাদন নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন কর্তৃপক্ষ। একই অবস্থা দোহাজারী ফার্নেস অয়েল নির্ভর ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্রেও। এরই মধ্যে হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্টের ব্যবস্থাপক লিখিত চিঠিতে রেল কর্তৃপক্ষকে সরকারী নির্দেশনা বাস্তবায়নে নিয়মিত ফার্নেস অয়েল পরিবহনের অনুরোধ জানায়। গত ১৯ মার্চ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান পরিবহন কর্মকর্তাকে দেয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘বিদ্যুত বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে ২৪ ঘণ্টার জন্য বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখতে হবে। কিন্তু সে অনুপাতে ফার্নেস অয়েল মজুদ না থাকায় ১ দিন অন্তর ৮ থেকে ১০টি ওয়াগনে (জ্বালানি পরিবহনে রেলের বিশেষ ট্যাংকার) জ্বালানি তেল পরিবহন করা প্রয়োজন। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ পূর্বের মতো অনিয়মিতভাবে ফার্নেস অয়েল পরিবহন করছে। এতে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুত কেন্দ্র পরিচালনা সম্ভব হবে না।’ তাই যে কোনভাবে চাহিদা অনুযায়ী ফার্নেস অয়েল সরবরাহ করা জরুরী বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। হাটহাজারী বিদ্যুত কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক জসিম উদ্দীন ভূঁইয়া জানান, চাহিদা বেশি তাই রেলওয়েকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। এখন আলোচনা হচ্ছে কিভাবে জ্বালানি সরবরাহ বাড়ানো যায়। চাহিদা অনুযায়ী ফার্নেস তেল পাওয়া না গেলে চলতি মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত উৎপাদন ব্যাহত হবে। রেল সূত্র জানিয়েছে, পর্যাপ্ত ট্যাংক ওয়াগন না থাকায় বিদ্যুত কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বল্প পরিসরে ফার্নেস অয়েল পরিবহন শুরু করা হয়। রেলের প্রায় এক হাজারের বেশি জ্বালানি তেলবাহী ওয়াগন থাকলেও ফার্নেস অয়েলের জন্য বিশেষায়িত ওয়াগনের স্বল্পতা রয়েছে। ট্যাংক ওয়াগন স্বল্পতায় সারাদেশে ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ মার্চ ট্রিপে ১০ হাজার ৪০০ টন ফার্নেস অয়েল সরবরাহ করতে পেরেছে রেলওয়ের পরিবহন বিভাগ। ৭০ থেকে ৮০টি ওয়াগন দিয়ে সারাদেশে ফার্নেস অয়েল পরিবহন করলেও ১৪৫টি ওয়াগন মেরামতের অপেক্ষায় রয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্রে হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়া দ্রুত সময়ের মধ্যে নষ্ট ওয়াগন মেরামত করে পরিবহন বিভাগকে প্রেরণের জন্য রেলের প্রকৌশল বিভাগকে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু নির্দেশনার দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও নষ্ট ওয়াগন মেরামত করা হয়নি বলে জানিয়েছেন রেল কর্মকর্তারা। রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ওয়াগন রয়েছে। জেট ফুয়েলের জন্য বিশেষায়িত ট্যাংক ওয়াগন ছাড়াও কেরোসিন, পেট্রোল, অকটেনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ট্যাংক ওয়াগন রয়েছে। ফার্নেস অয়েলের জন্য ট্যাংকের নিচের দিকে সরবরাহ পাইপলাইন সংযুক্ত করা প্রয়োজন থাকায় অন্যান্য ট্যাংক দিয়ে ফার্নেস অয়েল সরবরাহ করা সম্ভব নয়। এর আগে রেলওয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের ঋণে ২০১৩ সালে ৮১টি জেট ফুয়েল পরিবহনের ট্যাংকার ক্রয় করা হয়। ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় এসব ট্যাংকার দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে ফেলে রাখে রেলওয়ে। বিপিসির বিভিন্ন কোম্পানির ডিপোতে লোডিং-আনলোডিং সমস্যায় দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জটিলতা তৈরি হয়। পরবর্তীতে এসব ট্যাংকার রেলের ওয়ার্কশপে মেরামতের মাধ্যমে ভিন্ন ধরনের জ্বালানি পরিবহন করছে রেল কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে রেলওয়ের বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (কারখানা) মিজানুর রহমান বলেন, রেলের ফার্নেস অয়েলের জন্য বিশেষায়িত ট্যাংক ওয়াগনের স্বল্পতা রয়েছে। কারখানা থেকে বেশ কিছু ওয়াগনকে পরিবর্তন করে ফার্নেস অয়েলের উপযোগী করা হয়েছে। এরপরও চিঠির প্রেক্ষিতে আমরা বেশ কিছু ওয়াগন মেরামত করে দিয়েছি। আশা করি আগামী কিছুদিনের মধ্যে বাকি ট্যাংকও মেরামত করে দেয়া সম্ভব হবে। জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে ১০২ মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রে নৌপথে, নাটোরে ৫২ দশমিক ২০ মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক কেন্দ্রে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে জ্বালানি সরবরাহ করে। এছাড়াও সম্প্রতি চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও পটিয়ায় ৫০০ মেগাওয়াটের তিনটি ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয়েছে। অন্যদিকে পটিয়ায় ২২৫ মেগাওয়াটের একটি দ্বৈত জ্বালানির (ফার্নেস অয়েল ও গ্যাস) বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদন চলতি বছরের মাঝামাঝিতে শুরু হতে পারে।
×