ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মিরপুর থেকে গ্রেফতার চার জঙ্গীকে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য

জামায়াত নেতার মদদে জঙ্গীবাদে জড়িয়েছে চার পরিবার

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৯ মার্চ ২০১৭

জামায়াত নেতার মদদে জঙ্গীবাদে জড়িয়েছে চার পরিবার

গাফফার খান চৌধুরী ॥ জামায়াতে ইসলামীর এক নেতার প্রত্যক্ষ মদদে তারই তিন ছেলে নব্য জেএমবির আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য হয়েছে। তিন ছেলের মধ্যে এক ছেলে সীতাকু-ে এবং আরেক ছেলে বিমানবন্দরে সামনে পুলিশ চেকপোস্টে আত্মঘাতী হামলার চেষ্টাকালে নিহত হন। বেঁচে থাকা একমাত্র ছেলে আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য খালাত ভাই আরিফিনকে সঙ্গে নিয়ে দেশে বড় ধরনের হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছিল। এই জামায়াত নেতার কারণে তার পরিবার ছাড়াও তার শ্বশুর ও দুই ভায়রার পরিবার পুরোপুরি জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েছে। বাসায়ই কওমি মাদ্রাসা স্থাপন করে তার আড়ালে তৎপরতা চালছিল বলে পুলিশ ও স্থানীয়দের ধারণা। যদিও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করেছেন। সোমবার রাজধানীর মিরপুর থেকে গ্রেফতারকৃত চার জঙ্গীকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাদের প্রত্যেককে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন ঢাকার সিএমএম আদালত। সোমবার বিকেলে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর মিরপুর মডেল থানাধীন পূর্ব মনিপুরী পাড়ার ১২৭০ নম্বর খালেদা মঞ্জিল নামের বাড়িটিতে অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানে তৌফিক হাসান (৫৪), শামসুল হক খান (৫৫), রাকিব আল হাসান (২১) ও আরেফিন হাসানকে (২৪) গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে মোট ৪৪টি ককটেল ও বোমা এবং ৩৩টি নিষিদ্ধ বই উদ্ধার হয়। মঙ্গলবার গ্রেফতারকৃতদের সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মিরপুর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক মোঃ রাশেদুজ্জামান বেগ। আদালত শুনানি শেষে আসামিদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন পুলিশকে। মিরপুর মডেল থানার ওসি মোঃ নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, অভিযানকালে গ্রেফতারকৃতরা বাড়িতে গোপন বৈঠক করছিল। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক আইনে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে তৌফিক হাসান জামায়াতের রোকন। আর শামসুল হক খানও জামায়াত নেতা। রাকিব আল হাসান ডেলটা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। তিনি জামায়াতের রোকন তৌফিক হাসানের ছোট ছেলে। আর আরেফিন হাসান গ্রেফতারকৃত তৌফিক হাসানের আরেক ভায়রা রফিকুল ইসলামের ছেলে। অর্থাৎ আরেফিন ও রাকিব সম্পর্কে খালাত ভাই। মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার জসীম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, তারা নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা করছিল। ওই বাড়ির প্রতিটি পরিবারের বিরুদ্ধেই জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, গ্রেফতারকৃত তৌফিক হাসান জামায়াতে ইসলামীর রোকন। আর আরেফিন হাসান রাজধানীর মহাখালী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্র। এরা সবাই জঙ্গীবাদে জড়িত। তৌফিকের মাধ্যমেই তার পরিবার ছাড়াও তার শ্বশুর ও দুই ভায়রার পরিবারের সদস্যরা প্রথমে জামায়াত-শিবির এবং পরে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, পরিবারটির ওপর অনেক দিন ধরেই নজরদারি চলে আসছে। বিশেষ করে গত ১৫ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকু-ে দুইটি জঙ্গী আস্তানা আবিষ্কৃত হওয়ার পর নজরদারি আরও বাড়ানো হয়। কারণ সীতাকু-ের দুইটি জঙ্গী আস্তানায় ৫ জঙ্গী নিহত হয়। পুলিশের গুলিতে এবং নিজেদের শরীরের লাগিয়ে রাখা আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণে ওই পাঁচ জঙ্গীর মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে মৃত্যু হওয়া জঙ্গীদের পরিচয় প্রকাশ হয়। নাম পরিচয় প্রকাশ পাওয়াদের মধ্যে রাশিত হাসান নামে একজন রয়েছে। রাশিদ হাসান নব্য জেএমবির আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য ছিলেন। গত বছরের ৯ আগস্ট থেকে রাশিত হাসান নিখোঁজ ছিলেন বলে মিরপুর মডেল থানার ওসি নজরুল ইসলাম জানান। পরবর্তীতে তদন্তে জানা যায়, রাশিত হাসান গ্রেফতারকৃত জামায়াত নেতা তৌফিক হাসানের ছেলে ছিলেন। এরপর থেকেই আরও নজরদারি বাড়ানো হয়। আর সর্বশেষ গত ২৪ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে পুলিশ চেকপোস্টে আত্মঘাতী হামলার চেষ্টাকালে নিজের বুকে বেঁধে রাখা বোমায় এক আত্মঘাতী জঙ্গী নিহত হন। শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণে ওই জঙ্গীর কোমর থেকে উপরের অংশ আর নিচের অংশ আলাদা হয়ে যায়। ওই জঙ্গীর নাম আয়াত হাসান বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেলেও দায়িত্বশীল কোন সূত্রই বিষয়টি নিশ্চিত করেননি। নিহত ওই জঙ্গী মনিপুরী পাড়া থেকে গ্রেফতারকৃত জামায়াত নেতা তৌফিক হাসানের ছেলে ছিলেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। আয়াত হাসান ও রাশিত হাসান দুইজনই দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। আয়াত হাসানের সঙ্গে থাকা ট্রলি ব্যাগেও বেশ কয়েকটি শক্তিশালী বোমা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে তা নিষ্ক্রিয় করা হয়। মিরপুরের পূর্ব মনিপুরী পাড়ার ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় দশ কাঠা জমির ওপর পাশাপাশি দুইটি বাড়ি। একটি বাড়ি তিন তলা। আরেকটি পাঁচ তলা। দুইটি বাড়ির মালিক হাজী আইনুদ্দিন। স্থানীয়ভাবে তিনি হাজী নামেই পরিচিত। তিন তলা বাড়িতে জামিয়া ইসলামিয়া দারুল-নুর মাদ্রাসা নামের একটি কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। মাদ্রাসায় নূরানী (জেনারেল সাবজেক্ট), হিফজ বিভাগ (আন্তর্জাতিকমানের), কিতাব বিভাগ ও নৈশ মাদ্রাসা (বয়স্কদের জন্য) বিভাগ চালু আছে। সব মিলিয়ে প্রায় শতাধিক ছাত্র-শিক্ষক রয়েছে। মাদ্রাসাটি হাজী পরিবার পরিচালনা করে আসছেন। মাদ্রাসাটি নতুন বলে সেখানকার শিক্ষার্থীরা জানান। পুলিশ ও স্থানীয়রা বলছে, বাড়ির মূল মালিক হাজী আইনুদ্দিন জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী। তার কোন ছেলে নেই। তিন মেয়ে। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তিন মেয়ের পরিবারের সবাই আইনুদ্দিন হাজীর পাঁচতলা বাড়ির তিনটি তলায় বসবাস করে। আইনুদ্দিন হাজীর এক মেয়ের জামাতা গ্রেফতারকৃত তৌফিক হাসান। তার বাড়ি ঢাকা জেলার দোহারে। হাজী আইনুদ্দিন জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী থাকলেও, অতটা কট্টর ছিলেন না। মেয়ের জামাতা তৌফিক হাসানের প্রত্যক্ষ মদদে এক সময় পুরো পরিবার জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। শুধু তাই নয়, তার প্ররোচনা এবং প্রত্যক্ষ মদদে চারটি পরিবারই আস্তে আস্তে জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, গ্রেফতারকৃত জামায়াতের রোকন তৌফিক তার ভায়রা রফিকুল ইসলামের ছেলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরেফিন হাসানকে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করেন। এরপর আরেফিনের মাধ্যমেই তারই তিন খালাত ভাই তৌফিক হাসানের ছেলে সীতাকু-ের জঙ্গী আস্তানায় সোয়াটের চালানো অভিযানে নিহত নব্য জেএমবির আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য রাশিত হাসান ও বিমানবন্দরে আত্মঘাতী হামলায় নিহত আয়াত হাসান এবং ডেলটা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র নিহত দুই জঙ্গীর ছোট ভাই রাকিব আল হাসানকে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করে। চার খালাত ভাই জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার পর তারা তাদের পরিবারকে আস্তে আস্তে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করে। আর তাতে প্রত্যক্ষ মদদ দেয় গ্রেফতারকৃত তৌফিক হাসান।
×