ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যশোরে কর্মসংস্থান প্রকল্পে লুটপাট

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ২৯ মার্চ ২০১৭

যশোরে কর্মসংস্থান প্রকল্পে লুটপাট

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ মণিরামপুরে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচী প্রকল্পের ৪০ দিনের কাজ ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। কাজ শুরুর আগে থেকেই এই প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতিতে জড়িত আছেন ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বরসহ পিআইও অফিসের কর্মীরাও। ফলে এ প্রকল্পের প্রায় এক কোটি টাকা স্ফীত করছে সংশ্লিষ্টদের পকেট। এদিকে, অনিয়মের অভিযোগে উপজেলা প্রশাসনের হাতে এ পর্যন্ত আটটি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ উঠেছে খেদাপাড়া ইউনিয়নের ইউপি সদস্য তাইজুল ইসলামের বিরুদ্ধে। তিনি এ প্রকল্পে দরিদ্র ১১ জনের নাম ভাঙিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ৮০ হাজার টাকা। তাছাড়া বিভিন্ন এলাকা থেকে এ কাজে মৌখিকভাবে অভিযোগ এসেছে অনেক। তবে এসব অভিযোগের তদন্ত হলেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে যৎসামান্য। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রায় তিন কোটি ১৪ লাখ ২৪ হাজার টাকা ব্যয়ে উপজেলার ১৭ ইউনিয়নে ১৩৩টি কর্মসংস্থান কর্মসূচী প্রকল্পে তিন হাজার ৯২৮ শ্রমিকের তালিকা নিয়ে কাজ শুরু হয় চলতি বছরের ৪ মার্চ। তার আগে প্রণয়ন করা হয়েছে শ্রমিকদের নামের তালিকা, যাদের কাজে নিয়োগ করা হবে। এই তালিকায় রয়েছে সীমাহীন অনিয়ম। অভিযোগ রয়েছে, পিআইও অফিসের যোগসাজশে আগের কার্ডধারী অনেক লোককে বাদ দিয়ে টাকার বিনিময়ে নতুন লোক ঢুকিয়েছেন স্থানীয় মেম্বর-চেয়ারম্যানরা। তাছাড়া নীতিমালা উপেক্ষা করে তালিকায় স্থান পেয়েছে মেম্বরদের স্ত্রী, সন্তান এমনকি স্বামীর নামও। কোন কোন ইউনিয়নে তালিকায় নাম রয়েছে গ্রামপুলিশ সদস্যদের স্বজনদের। তালিকায় রয়েছে নামে-বেনামে পিআইও অফিসের স্বজনদের নামও। আবার নাম রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদেরও। যাদের কেউ কোন দিন কাজে যোগ দেননি। শুরু থেকেই এরা কাজে অনুপস্থিত থাকলেও মেয়াদান্তে টাকা তুলেছেন। এই জালিয়াতির সবটাই রয়েছে পিআইও অফিসের গোচরে। অভিযোগ রয়েছে, ১৩৩টি প্রকল্পের প্রতিটিতে এক-তৃতীয়াংশ শ্রমিক কাজে অনুপস্থিত থাকছেন। আবার কোথাও কোথাও অনুপস্থিতির সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। এদিকে খেদাপাড়া ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর তাইজুল ইসলাম মিলনের বিরুদ্ধে কাজে যান না এমন ১১ শ্রমিকের নাম তালিকায় বসিয়ে তাদের সই জাল করে টাকা উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগে ওয়ার্ডের আব্দুস সাত্তার নামের এক ব্যক্তি লিখিত অভিযোগ করেছেন। আব্দুস সাত্তারের পক্ষে সোমবার দুপুরে রবিউল ইসলাম নামের এক যুবক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগটি জমা দেন। ওই ওয়ার্ডে ৩৬ জনের তালিকার মধ্যে কাজে আসেন মাত্র ২০-২২ জন। বাকি ১৬ জন সব সময় অনুপস্থিত। তারপরও কাজের ২০ দিনের মাথায় এরা হাজিরার টাকা তুলেছেন পুরোটাই। অভিযোগ করা হয়, মেম্বর মিলন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজের ছেলে, ভাই ও বেয়াইয়ের নাম তালিকায় দিয়েছেন। বিষয়টি পিআইও অফিসের সহকারী প্রকৌশলী গোলাম সরোয়ারকে জানিয়েও কোন ফল পাননি বলে অভিযোগ রবিউলের। তবে অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন মেম্বর মিলন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছে জানতে পেরে মেম্বরকে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা গেছে। কর্মসংস্থান কর্মসূচীতে অনিয়ম হয়েছে রোহিতা ইউনিয়নে খোলাখুলিভাবে। এখানে প্রতিটি ওয়ার্ডে গ্রামপুলিশের সদস্যরা একজন ভুয়া সদস্যের নাম দিয়ে টাকা তুলেছেন। তাছাড়া ইউনিয়নের সব ওয়ার্ডে কাজে অনুপস্থিত থাকছেন কোথাও অর্ধেক বা তিনভাগের একভাগ জনবল। ইউনিয়নের কোদলাপাড়া ওয়ার্ডে ২৬ জনের মধ্যে কাজে আসেন ১৩ জন। যদিও ওই ওয়ার্ডের মেম্বর মনিরুল ১৯ জন হাজির হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘কী করব ভাই। পিআইও অফিসের কবির ইউনিয়নের অপর ওয়ার্ডের লোক। সে চেয়ারম্যানের কাছে তার একটি লোকের নাম দেয়ার দাবি করে। তখন চেয়ারম্যান তাকে আমার ওয়ার্ডে এনে ঢুকিয়েছেন।’ তাছাড়া পিআইও অফিসের গোলাম সরোয়ার ইউনিয়ন পরিষদে বসে এসব তালিকা দেখে তার বৈধতা দিয়েছেন বলে দাবি করেন মেম্বর মনিরুল। একই ইউনিয়নের রোহিতা ওয়ার্ডের মেম্বর মোহিতুলও কাজে শ্রমিক অনুপস্থিতির কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে ৩০ জনের মধ্যে ২০ জন কাজ করে।’ ‘যারা কাজে আসে না তাদের মধ্যে ওয়ার্ডের সভাপতি-সেক্রেটারি ও চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি রয়েছেন,’ অকপট স্বীকারোক্তি মেম্বরের। কাশিমনগর ইউনিয়নের ইত্যা ওয়ার্ডের মেম্বর শহিদুল তার স্ত্রীর নাম তালিকায় দিয়ে টাকা তুলেছেন বলে অভিযোগ। হরিদাসকাটি ইউনিয়নের চান্দুয়ায় ২৯ জনের মধ্যে নয়জন অনুপস্থিতের অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে সত্যতা নিশ্চিত করতে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের সহকারী প্রকৌশলী গোলাম সরোয়ারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব কাজে অনিয়মতো টুকটাক হবেই। সব ওয়ার্ডে লোক দুই-একজন করে অনুপস্থিত থাকতে পারে; তবে অত বেশি না।’ তাকে জড়িয়ে আনীত অভিযোগগুলো সত্য নয় বলে গোলাম সরোয়ার দাবি করেছেন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইয়ারুল হকের কাছে কাজের নিয়মনীতি ও শ্রমিক তালিকা চাইতে গেলে তিনি বলেন, ‘তালিকা নিতে হলে ইউএনও স্যারের কাছে লিখিত আবেদন করতে হবে।’ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ অতুল ম-ল বলেন, ‘কর্মসূচীর কাজের ব্যাপারে অনেক মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। তাছাড়া লিখিত অভিযোগ পেয়েছি আটটি। সব ব্যাপারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আর তাইজুল ইসলাম মিলন মেম্বরের অভিযোগের ব্যাপারে সহকারী কমিশনার (ভূমি) লিংকন বিশ্বাসকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’
×