ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ধীরেনদার স্মৃতি এবং আমাদের লজ্জা

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২৯ মার্চ ২০১৭

 ধীরেনদার স্মৃতি এবং আমাদের লজ্জা

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন বসে। কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে নয়, কোন দলের পক্ষ থেকে নয় বাঙালী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ব্যক্তি হিসেবে গণপরিষদ অধিবেশনের প্রথম দিনেই প্রস্তাব উত্থাপন করলেন; উর্দু এবং ইংরেজীর সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা করা হোক। সেদিন পূর্ব বাংলার কোন মুসলমান গণপরিষদ সদস্য ধীরেনদার এই প্রস্তাবকে সমর্থন তো করেনইনি বরং সরাসরি বিরোধিতা করেছিলেন মুসলিম লীগের খাজা নাজিমুদ্দিন। তীব্র কটাক্ষ এবং বিদ্রƒপাত্মক মন্তব্য করেছিলেন প্রভাবশালী মন্ত্রী রাজা গজনফর আলী এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। পূর্ব বাংলার অন্যান্য মুসলমান সদস্য মুখে তালাচাবি এঁটে দিয়ে অকুতোভয় ধীরেনদার এই হেনস্থা দেখছিলেন। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং এমন সময়ের একটি ঘটনা যেটা ঘটেছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পৈশাচিক দৃশ্যপট তখনও এদেশের মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। স্মৃতিতে ম্লান হয়নি, মাত্র দেড়/দু’বছর আগেকার কলকাতা, বিহার, পাঞ্জাব, নোয়াখালীর ভয়াবহ দাঙ্গার কথা। সাম্প্রদায়িকতার বাঘনখ অস্ত্র তখনও সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতিয়ার। ধীরেনদার হৃৎপি-টাকে যেন খুবলে খাবে। রাজনৈতিক পরিবেশটা সত্যিই ভয়াবহ ছিল। ভারতে সাম্প্রদায়িক শান্তি এবং মৈত্রীর আহ্বান জানানোর অপরাধে ৩০ জানুয়ারি গান্ধীজীকে হত্যা করেছে নাথুরাম গডসে। পাকিস্তানে তখন গণপরিষদের মুসলিম লীগ সদস্য থেকে শুরু করে কয়েকদিন আগেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হুকুম বঁরদার প্রভুভক্ত সেনাবাহিনী, পাকিস্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে যাদের পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে রূপান্তর ঘটেছিল তারা এবং তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক জনশক্তি, পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক সেøাগান-মাতাল পাকিস্তানী শাসকশ্রেণীর তাঁবেদার পূর্ববঙ্গে অনুগ্রহপুষ্ট মুসলিম নেতৃবৃন্দ এবং তাদের সমর্থকরা পর্যন্ত একটা জিহাদী মনোভাব নিয়ে অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে শূন্যে কল্পিত তলোয়ার ঘোরাচ্ছে। ঠিক এমন রাজনৈতিক পরিবেশেই গণপরিষদে উচ্চকণ্ঠে বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবি তুলেছিলেন ধীরেদা। ভাষার দাবিতে রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রথম কাতারের সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবটি গণপরিষদে অগ্রাহ্য হলো ২৫ ফেব্রুয়ারি। সাম্প্রদায়িক সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে গণপরিষদে বাংলা ভাষার অধিকারের প্রস্তাবটির গলা কাটা হলো, আর তার সঙ্গে পাকিস্তানী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেদের অজান্তেই পাকিস্তানের জন্মের সাড়ে ছয় মাসের মধ্যে সদ্যোজাত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির অঙ্গচ্ছেদের জন্য খাঁড়ার প্রথম আঘাত করল। প্রস্তাবের জন্য ধীরেনদাকে গণপরিষদের মুসলিম সদস্যদের কটূক্তির শিকার হতে হয়েছিল। কিন্তু পূর্ব বঙ্গের ছাত্র যুবক শিক্ষক প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সমাজ তাঁর সাহসী ভূমিকার জন্য বীরের মর্যাদা দান করলেন তাঁকে। ধীরেনদার প্রস্তাব বাতিল করার এবং গণপরিষদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ঢাকার স্কুলের ছাত্ররা ক্লাস ছেড়ে বাংলা ভাষার সপক্ষে সেøাগান দিয়ে মিছিল করল রমনা এলাকায়Ñবর্ধমান হাউসের (বর্তমানে বাংলা একাডেমি, তখন পূর্ব বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের অফিসীয় বাড়ি) চারপাশে। ঐক্যবদ্ধ ছাত্র সমাজ ধিক্কার দিলো খাজা নাজিমুদ্দিন, তমিজউদ্দিন খান এবং তাদের সহযোগীদের; গণপরিষদে যারা ধীরেনদার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। ধীরেনদার প্রস্তাবের যৌক্তিকতার পেছনে সেদিন দাঁড়িয়েছিল সেদিনকার পূর্ব বঙ্গের ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী সমাজ। দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত হয়েছিল আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে। বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা, রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ মার্চ সারা প্রদেশে ছাত্র ধর্মঘট হয়েছিল। সে ধর্মঘটে শিক্ষকরা যোগ দিয়েছিলেন। বগুড়ায় মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মনীষী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ঢাকায় তদানীন্তন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, যুবনেতা শামসুল হক, মোগলটুলীর শওকত আলী, রণেশ দাশগুপ্তসহ সারা প্রদেশের অসংখ্য কর্মী কারাবরণ করেছিলেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে। ধীরেনদার সাফল্য এখানেই। একটিমাত্র প্রস্তাবে বারুদের স্তূপে তিনি যে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন সে আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ’৫২ সালের ২৭ জানুয়ারির বক্তৃতার পর সেই বারুদের স্তূপে প্রচ- বিস্ফোরণ ঘটেছিল ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে। সহস্র ফাটল ধরিয়ে দিয়েছিল পূর্ব বঙ্গে মুসলিম লীগ শাসনের বেদিতে। ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে মুসলিম লীগ শাসনের সহস্রধা বিদীর্ণ বেদিমূল ধসিয়ে দিয়েছিল। ২১ ফেব্রুয়ারিতে ধীরেনদা দু’বার এসেছিলেন মেডিক্যাল কলেজের ব্যারাকে। প্রথমবার বেলা ১টা থেকে ১-৩০ টার দিকে। তখন আমি ওখানে ছিলাম না। আমার সঙ্গে ধীরেনদার দেখা হয়নি। তখন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় লাঠি চার্জ, মেডিক্যাল কলেজ গেটের সামনে বেধড়ক লাঠি চার্জের পর কাঁদানে গ্যাসে সব প্রায় অন্ধকার। রিক্সায় পরিষদ ভবনের দিকে যাচ্ছিলেন ধীরেনদা এবং প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী বাবু। হোস্টেলের ছাত্রদের আহ্বানে তাঁরা হোস্টেলে গিয়ে কাঁদানে গ্যাস এবং লাঠিচার্জে আহতদের দেখেন। ধীরেনদা আবেগময় কণ্ঠে বলেছিলেন, পরিষদে প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীনের নিকট তিনি এই অত্যাচারের কৈফিয়ত চাইবেন। ধীরেনদা তাঁর কথা রেখেছিলেন। পরিষদের কার্যক্রম শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রদ্ধেয় মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ জানিয়ে পরিষদ সভা স্থগিত রেখে তদন্তের দাবি করলেন। তাঁকে সমর্থন জানালেন কংগ্রেসের ডেপুটি লিডার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। স্বভাবসিদ্ধ আবেগময় কণ্ঠে গুলিবর্ষণের পূর্বে তাঁর স্বচক্ষে দেখা দৃশ্য বর্ণনা করে নুরুল আমীনকে গুলির পর সৃষ্ট অবস্থা স্বচক্ষে পরিদর্শন করে না আসা পর্যন্ত এবং গুলিবর্ষণের তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁর পক্ষে পরিষদের কার্যে অংশগ্রহণ অসম্ভব বলে জানালেন। তাঁর এবং অন্যদের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও পরিষদের কাজ চালাতে চেষ্টা করেন নুরুল আমীন। হট্টগোলের মধ্যে স্পীকার কিছুক্ষণের জন্য পরিষদ মুলতবি ঘোষণা করলে, অন্যদের সঙ্গে ধীরেনদাও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসেছিলেন; ওই সময়েই ধীরেনদার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাত। তাঁর সঙ্গে মনোরঞ্জন ধর, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, বগুড়ার মোবারক আলীসহ আরও কয়েক পরিষদ সদস্য এসেছিলেন । ধীরেনদার চোখের কোণে পানি। ধুতির খুঁটে চোখ মুছে বলেছিলেন, “এটা নারকীয় হত্যাকা-। আর একটি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাযজ্ঞ হয়ে গেল।” তারপর মাটিতে শোয়ানো কয়েকজন আহত ছাত্রের পাশে দাঁড়িয়ে যুক্তকর কপালে ঠেকিয়ে বলেছিলেন,‘তোমরা সকলে আমার প্রণাম গ্রহণ কর।’ ধীরেনদা বেরিয়ে গেলেন। আবু নছর ওয়াহেদ, মুকুল মতিন, মাহবুব জামাল জাহেদী, রফিকুল ইসলাম আবু (রংপুর-যিনি ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত ২১ শে ফেব্রুয়ারি সংকলনের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করেছিলেন)সহ কয়েকজন পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিলাম। ধীরেনদার সঙ্গে এর পর দেখা হয়েছিল বেশ কিছুদিন পর। ’৫৩ সালের শেষার্ধেই হবে বোধহয়। সতীনদা (বরিশালের বিপ্লবী সতীন সেন) বগুড়া জেল থেকে ছাড়া পাবেন। খবরটা দিয়েছিল বন্ধু জালাল উদ্দীন আকবর। দলবল নিয়ে হাজির হলাম বগুড়া জেল গেটে সতীনদাকে অভ্যর্থনা জানাতে। ভাষা আন্দোলনের বন্দী সতীনদাকে মালা দিয়ে সংবর্ধনা জানালাম, মিছিল করে জেল গেট থেকে অন্তিম বাবুর বাসায় সতীনদাকে পৌঁছে দিয়ে ফেরারপথে গ্রেফতার হয়ে বগুড়া জেলে সতীনদার ছেড়ে আসা স্থানেই স্থান পেলাম। সেটা মে মাসের শেষদিকের ঘটনা। কয়েক মাস পরই ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে ছাড়া পেলাম। ছাড়া পাবার কয়েকদিন পর যুবলীগের সাংগঠনিক কাজে যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ইমাদউল্লাহসহ বেরিয়ে পড়েছিলাম চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা সফরে। (ইমাদুল্লাহকে এখন আর কেউ স্মরণ করেন না। ইমাদুল্লাহ এখন এক হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি। অথচ এখনকার প্রজন্মের জানার কথা বাদই দিলাম, তার সাথীরাও বোধহয় ভুলে গেছে যে ’৫২-এর ২২শে ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের প্রতিবাদ সভায় ইমাদুল্লাহই সভাপতিত্ব করেছিলেন। তারপর নিরলস কয়েকটি বছর যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, পরে সম্পাদক হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠকের কাজ করে গেছেন। ভুলে গেছে মুসলিম লীগ বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে তাঁর অবদানের কথা)। সফরের সমাপ্তি স্থান কুমিল্লা। সন্ধ্যায় পৌঁছে কুমিল্লা কলেজের অধ্যাপক আবুল খায়ের সালেহ উদ্দীন, অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম এবং অধ্যাপক আসহাব উদ্দিনের (যাঁরা ১৯৫২ সালের কুমিল্লায় পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলনের প্রধান সংগঠক ছিলেন) সঙ্গে বৈঠক। বৈঠকে শেষে আবুল খায়ের সাহেব বললেন, ‘চলো বুড়োর সঙ্গে কথা বলে আসি।’ হেসে বললেন, ‘বুড়া মানে ধীরেন বাবু।’ ইমাদুল্লাহ এবং আমি দুজনই ক্লান্ত ছিলাম। তার ওপর রাত দশটার পর একজনের সঙ্গে আগে কোন খবর না দিয়ে হঠাৎ দেখা করতে যাওয়া ঠিক হবে কিনা, এ বিষয়ে ইতস্তত করছিলাম। অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন বললেন, ঘাবড়াবার কিছু নেই, ধীরেন বাবু ‘রাতজাগা পাখী।’ ধীরেনদার বাড়ি পৌঁছতে রাত সাড়ে দশটা বেজে গেল। সঙ্কোচ বোধ হচ্ছিল। কিন্তু কড়া নাড়তেই বেরিয়ে এলেন ধীরেনদা, কী প্রফেসর, খবর কি? এত রাতে? আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এদের তো চিনলাম না। তারপর আমাকে একটুখানি খুঁটিয়ে দেখে বললেনÑ একে কোথায় যেন দেখেছি মনে হচ্ছে। ইমাদুল্লাহর পরিচয় দিয়ে আমার নাম বলতেই হা হা করে উঠলেন। দেখো, কী ভোলা মন। বরিশালের সতীন সেনের কাছে তোমার অনেক কথাই শুনেছি। আর তাছাড়া মনে হচ্ছে মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতালে ২১শে ফেব্রুয়ারির বিকেলে তোমাকে বোধহয় দেখেছি, দু’একটা কথাও বোধহয় হয়ছিল। ধীরেনদার স্মরণশক্তি অবাক করে দিয়েছিল। মাত্র কয়েক মিনিটের দেখা, দু-একটি কথা সবই মনে রেখেছেন। অনেক আলোচনার পর শেষ কথাটা বললেন, আমরা বুঝি আমাদের রাজনীতি এই দেশ আর গ্রহণ করবে না। তবু আমরা বলে যাব আমাদের দেশমাতৃকার জন্য। কারণ, এই দেশ আমার জন্মভূমি, আমার মা। আমাদের শক্তি সামান্য। তোমরা চেষ্টা কর ফজলুল হক, সোহ্্রাওয়ার্দী, ভাসানীকে একমঞ্চে দাঁড় করাতে পার কিনা? আমাদের অস্তিত্বের জন্যই আমাদের তোমাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ, এদেশ আমাদেরও দেশ। ধীরেনদার সঙ্গে পরে আরও অনেকবার দেখা হয়েছিল, কথাও হয়েছিল। তার অনেক কথাই মন থেকে হারিয়ে গেছে। শুধু হারিয়ে যায়নি সেই কয়েকটি কথা ‘আমাদের অস্তিত্বের জন্যই আমাদের তোমাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ, এদেশ আমাদেরও দেশ। এদেশেই আমাদের জন্ম হয়েছে, এদেশেই আমাদের দেহাবশেষ রক্ষিত থাকবে।’ সত্যাশ্রয়ী ধীরেন দত্তের কথা তাঁর বেলাতে সত্যিই প্রমাণিত। এ এক মর্মান্তিক সত্যি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে হানাদার পাকিস্তানী সেনারা তাঁকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেছে। আর বাড়িতে ফেরেননি তিনি। বর্বর পাকিস্তানী সেনারা তাঁকে তাঁর জন্মভূমি তাঁর মায়ের বুকেই হত্যা করেছে। তাঁর দেহাবশেষ এদেশেই রক্ষিত আছে। উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের দ্বারা বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় এখানে যখন হিন্দু দেবালয়গুলো ধ্বংস করছিল, লুণ্ঠন করছিল এখানকার দুর্বৃত্তরা এবং প্রশাসন ছিল অধিকাংশক্ষেত্রে নিশ্চুপ! আমরাও কিন্তু তখন আমাদের সাধ্যমতো প্রতিরোধের জন্য তাদের পাশে দাঁড়াতে পারিনি, জন্মাষ্টমীর উৎসব মিছিলে যখন মাত্র কতিপয় সন্ত্রাসী দুর্বৃত্ত হামলা করল, আমরা শুধু অসহায় নারী-শিশুর আর্তনাদ শুনে সমবেদনা অনুভব করেছি, তাদের রক্ষার জন্য তাদের পাশে দাঁড়াতে যাইনি। কি লজ্জা! কি অপরিসীম লজ্জা! আজ পূজা পরিষদ সাম্প্রদায়িক শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে নিরাপত্তার কারণে দুর্গাপূজা উৎসব পালনে দ্বিধাগ্রস্ত। বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা আমাদের মতো ধীরেনদাদের রক্তেও অর্জিত স্বাধীনতা। অথচ এই স্বাধীন দেশের সরকার দৃঢ়কণ্ঠে বলছে না, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী দুর্বৃত্তদের আমরা উৎখাত করব, তোমাদের পূজা উৎসব বন্ধ কর না। তোমাদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে আমরাও আছি। অক্ষমতার লজ্জার চাইতে বড় লজ্জা আর কি হতে পারে? লেখক : ভাষাসৈনিক
×