ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শেখ হাসিনাই কি উপমহাদেশীয় ঐক্য গড়ার পথ দেখাবেন?

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২৯ মার্চ ২০১৭

শেখ হাসিনাই কি উপমহাদেশীয় ঐক্য গড়ার পথ দেখাবেন?

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘কেবল স্বাধীনতাই বাংলাদেশের শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে না। এই শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য গোটা উপমহাদেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত হতে হবে, আঞ্চলিক সহযোগিতা দরকার হবে।’ কলকাতার বিখ্যাত ‘কম্পাস’ কাগজের সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন বঙ্গবন্ধু। কম্পাস সম্পাদক বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তোলার উপায় কি? বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, উপমহাদেশীয় দেশগুলো নিয়ে একটা কমনওয়েলথ গড়ে তোলা। কম্পাস কাগজটি এখন নেই। তখন বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতকারটি তারা ফলাও করে প্রকাশ করেছিলেন। এটা ইন্দিরা-ভুট্টো সিমলা চুক্তি হওয়ার পরের কথা। কম্পাস-সম্পাদক বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনি কি এই উপমহাদেশভিত্তিক কমনওয়েলথ গড়ে তোলার জন্য দিল্লীকে কোনো প্রস্তাব দেবেন? বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দিতে চাই, কিন্তু দেয়ার সময় এখনও আসেনি। সিমলা চুক্তিতে কাশ্মীরে স্থিতাবস্থা রক্ষার সমঝোতা মাত্র হয়েছে। দেখা যাক ভুট্টো কথা রাখেন কিনা! ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই বড় সমস্যাটির সমাধান ছাড়া উপমহাদেশে আঞ্চলিক উন্নয়ন ও সহযোগিতার জোট গঠন সহজ হবে না।’ এটা বহু বছর আগের কথা। ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের অভিশপ্ত রাজনীতি সারা উপমহাদেশে যে বিভাগ, বিবাদ, সংঘর্ষ ও রক্তপাতের জন্ম দিয়েছিল, সেই ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বকে কবর দিয়ে গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় গোটা উপমহাদেশেই তখন শান্তি ও সহযোগিতার সুবাতাস বইছিল। কাশ্মীরেও শেখ আবদুল্লা কারামুক্ত হয়ে আবার মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসেছেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি হয়ে গেছে। মনে হয়েছিল, দীর্ঘকালের আঞ্চলিক বিবাদ ও সংঘাত শেষ হয়ে উপমহাদেশে ঐক্য ও সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে উঠবে। ইউরোপীয় ঐক্যের মতো একটা উপমহাদেশীয় ঐক্যও গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তব হবে। বাংলাদেশে ’৭৫ সালের নির্মম হত্যাকা- তা ঘটতে দেয়নি। তবে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ায় ছোটবড় কয়েকটি দেশ নিয়ে সার্ক গঠিত হয়েছিল। সার্ক নামেমাত্র এখনও আছে। কিন্তু ব্রিটেনের নেতৃত্বাধীন কমনওয়েলথের মতো তা এখন একটি চ্যাটারিং ক্লাব। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোরÑ বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের বিবাদ সার্ক মেটাতে পারেনি। পারেনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো এক মুদ্রা, ভিসাবিহীন যাতায়াত, অবাধ ও ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি গড়ে তুলতে। তবু এই কার্যাকারিতাশূন্য সার্কের উদাহরণ দেখিয়ে বাংলাদেশের কেউ কেউ গর্ব প্রকাশ করেন এবং বলেন, সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান এই সার্কের উদ্ভাবক এবং প্রধান উদ্যোক্তা। কথাটা একটু বাড়িয়ে বলা হয় এবং আসল সত্য প্রকাশ করা হয় না। সার্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অল্পদিনের মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, জিয়াউর রহমানের উদ্দেশ্য ছিল, উপমহাদেশে প্রকৃত আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা নয়, বরং সবচাইতে বড় দেশ ভারতকে রোখার জন্য তাকেসহ এমন একটি সংস্থা গঠন, যার ছোট ছোট সদস্যগুলোর সঙ্গে একজোট হওয়া যায় এবং ভারতকে সকল কাজে কোণঠাসা করে রাখা যায়। এই উদ্দেশ্য সাধনে পাকিস্তান ছিল জিয়াউর রহমানের নেপথ্যের পরামর্শ ও উৎসাহদাতা। এই উদ্দেশ্যটি ধরা পড়তেই সার্ক তার কার্যকারিতা হারায়। বঙ্গবন্ধু যে উপমহাদেশীয় কমনওয়েলথ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সার্ক কখনোই তার স্থান গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে উপমহাদেশীয় দেশগুলোর মধ্যে নানা স্বার্থ ও অধিকার সংক্রান্ত বিবাদ বিসম্বাদ লেগেই আছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে সংঘর্ষ মাঝে মাঝেই ঘটে। সিমলা-চুক্তি বহুকাল আগে মৃত। আর এই আঞ্চলিক বিবাদ বিসম্বাদগুলোর সুবাদে উগ্র মৌলবাদী সন্ত্রাস গোট উপমহাদেশে মাথা তুলছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগামী ৭ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ভারত সফর এবং ভারতের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও কয়েকটি ভারতীয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সম্ভাব্য বৈঠক খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই বৈঠক হলে এবং তিস্তা ও অন্যান্য নদীর পানিবণ্টনের সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যার সন্তোষজনক মীমাংসা হলে এটা হবে উপমহাদেশকে প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর জোন অব পিস বা শান্তির অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে প্রাথমিক এবং সফল পদক্ষেপ। তিস্তার পানি চুক্তি সম্পাদনে মোদি সরকারের আগ্রহ নেই এবং এ ব্যাপারে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তিকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে মোদি সরকার টালবাহানার আশ্রয় নিয়েছেন বলে বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক মহল এবং একটি তথাকথিত নিরপেক্ষ বাংলা দৈনিক প্রচারণা চালাচ্ছে। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর পথে কাঁটা বিছানো এবং হাসিনা সরকারের ক্রেডিবিলিটি নষ্ট করা। এই উদ্দেশ্যে বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল যেমন বলছেন, তিস্তার পানি নিয়ে কোনো চুক্তি না হলে আর সব চুক্তি (ছিট মহল ও স্থল সীমান্ত চুক্তিও কি?) ব্যর্থ হয়ে যাবে; তেমনি ‘নিরপেক্ষ’ দৈনিকটির এক উপসম্পাদকীয় লেখকও যুক্তি তুলেছেন, ভারতের সংবিধানে নদীর পানি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভ্যন্তরীণভাবে রাজ্য সরকারের এখতিয়ার আছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনে নেই। সুতরাং মমতা ব্যানার্জির আপত্তির ধুয়া তুলে তিস্তা চুক্তি না করা মোদি সরকারের একটা চাতুরি। অর্থাৎ এই চুক্তি মোদি সরকার ঝুলিয়ে রাখতে চায়। সংবিধানে কেন্দ্রকে অধিকার দেয়া হলেও কেন্দ্র অনেক সময় ফেডারেল শাসন ব্যবস্থায় রাজ্যের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চায় না। এটা আমেরিকার মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাতেও দেখা গেছে। তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে ভারতের সাবেক কংগ্রেস সরকার পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি অগ্রাহ্য করতে চায়নি, মোদি সরকারও চাচ্ছে না। কিন্তু এই চুক্তি সম্পাদনে প্রধানমন্ত্রী মোদি যে আগ্রহী, তার বড় প্রমাণ, তিনিও এবার হাসিনার দিল্লী সফরের সময় মমতা ব্যানার্জিসহ ভারতের কয়েকটি রাজ্যের বিভিন্ন দলীয় সরকারের মুখ্যমন্ত্রীদের সমাবেশ ঘটাবেন বলে জানা গেছে। এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ব্যক্তিগত উদ্যোগও এ ব্যাপারে যুক্ত থাকবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ফারাক্কা চুক্তি (হাসিনা সরকারের আমলেই) সম্পাদনের সময় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু যেমন একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, বর্তমানেও তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা ব্যানার্জি তেমন একটা ভূমিকা নেন, এটা সম্ভবত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদিরও ইচ্ছা। সংবিধানের ধারা মেনে তিনি অনিচ্ছুক পশ্চিমবঙ্গের মাথায় তিস্তা চুক্তি চাপিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু তা কতটা ফলপ্রসূ হবে তা বলা মুশকিল। তার চাইতে শুধু পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে নয়, সংশ্লিষ্ট সবগুলো ভারতীয় রাজ্যের সঙ্গে সমঝোতাক্রমে এই চুক্তি সম্পাদন কী তার স্থায়ী সাফল্য ডেকে আনবে না? ভারতের কয়েকটি রাজ্যে সাম্প্রতিক নির্বাচনে, বিশেষ করে ইউপি, গোয়া ও মনিপুরে বিজেপির সাফল্য ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রী মোদির অবস্থান আরও শক্ত করেছে। তিনি এই শক্ত অবস্থান থেকে বাংলাদেশসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নে আরও দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারবেন। তিনি যে তা চান, আসন্ন হাসিনা-মোদি দিল্লী বৈঠক তার প্রমাণ। যতদূর জানা যায়, এই বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও শক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টা হবে। তিস্তা নদীর পানি নিয়ে আনুষ্ঠানিক চুক্তি এই বৈঠকে না হলেও তার প্রাথমিক সমঝোতা হয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে সমঝোতা করেই অদূর ভবিষ্যতে সকলের সম্মতিক্রমে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবে। ‘নিরপেক্ষ’ দৈনিকটির সম্পাদককে বলি, তিষ্ঠ ক্ষণকাল, একটু ধৈর্য ধরুন। তারপর কী হয় দেখুন। আগেই লিখেছি, বাংলাদেশের শান্তি সমৃদ্ধি নির্ভর করে উপমহাদেশের সার্বিক শান্তি ও সমৃদ্ধির ওপর। আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর। এই সত্যটি অনুধাবন করে হাসিনা সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সঙ্গে আগের সরকারগুলো কর্তৃক জিইয়ে রাখা ছোট বড় বিবাদগুলো মীমাংসায় অগ্রসর হয় এবং বহু বিবাদ মেটাতে সক্ষম হয়। একমাত্র হাসিনা সরকারই ক্ষমতায় থাকলে যে তিস্তা চুক্তিও সম্পাদন করতে পারবে সে সম্পর্কে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই। বিএনপির প্রচারণার মূল কথা, বড় প্রতিবেশীর সঙ্গেও ঝগড়া করে সকল দাবি আদায় করা যায়। এটা বিপজ্জনক ধারণা। আমেরিকার সঙ্গে তাইওয়ান ও ফরমোজা নিয়ে চীনের বড় রকমের বিবাদ এখনও থাকা সত্ত্বেও দু’দেশের মধ্যে এক সময় গভীর সামরিক ও অর্থনৈতিক মৈত্রী গড়ে উঠেছিল। বর্তমানে রাজনৈতিক বিরোধ সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক টিকে আছে। ভারতের সঙ্গেও পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে বাংলাদেশ কোন বিরোধের সমাধান তো দূরের কথা, নিজের অর্থনৈতিক উন্নয়নও অব্যাহত রাখতে পারবে না। তাই নিজস্ব শক্তির অবস্থানে দৃঢ় থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনার পথে বিরোধ মীমাংসাই হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে এবং তা রক্ষায় হাসিনা সরকার সেপথেই এগুচ্ছে। কে বলতে পারে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মৈত্রীই একদিন বৃহত্তর উপমহাদেশীয় ঐক্য ও একটি কমনওয়েলথ প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দেবে না? লন্ডন ২৮ মার্চ, মঙ্গলবার, ২০১৭।
×