ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কামরুল আলম খান খসরু

স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলো

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২৯ মার্চ ২০১৭

স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলো

(গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যে আমাকে বেছে নিয়েছিল। যার কথা ভাবলে আমি ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠি। প্রাচীন গ্রিক পুরাণ অনুসারে ‘ফিনিক্স’ হলো এক পবিত্র ‘অগ্নিপাখি’। পৌরাণিক কাহিনীর পাখি ‘ফিনিক্স’ যেমন জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েও আবার নিজের ভস্ম থেকে জন্ম নেয়, সৃষ্টি হয় নতুন প্রাণ, শুরু হয় নতুন জীবন, এই হচ্ছে ‘ফিনিক্স’-এর জীবন। আমিও ঠিক তেমনই আগুনে ভস্মীভূত হয়ে আবার জেগে উঠি বৃষ্টির জলে। বার বার নতুন করে হয় আমার জীবনের অভ্যুদয়। আমি বঙ্গবন্ধুর জীবন ও আদর্শিক কর্মে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত হই। ভাবি, যিনি গৃহী হয়েও ঘরে থাকেন না। সংসারী হয়েও সংসার করেন না। আজকে মন্ত্রী তো কালকে আম-জনতা। কী বিশাল তাঁর হৃদয়। কত বড় সাহসিকতাপূর্ণ তাঁর কাজ। তাঁর মধ্যে কত বড় ত্যাগী মনোভাবের প্রদর্শন। এদেশের মানুষের মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু দিনের পর দিন ছুটে চলেছেন। খাওয়া নেই, ঘুম নেই। দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত চষে বেড়াচ্ছেন। বাঙালী জাগরণের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। গ্রেফতার হচ্ছেন। কিন্তু মুক্তি পেয়ে আবার দ্বিগুণ উৎসাহে নিজ লক্ষ্য অর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। এ মানুষটির জন্য আজ আমার মতো কত যুবক-তরুণের শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটছে। তাঁর ইশারায় দেশমাতৃকার জন্য জীবন দিতে দ্বিধা করছে না। এসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি। যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন দেখি লঞ্চ খুলনা জেটিতে ভেড়ানোর জন্য ভেঁপু বাজাচ্ছে। আমি লঞ্চের পাটাতন থেকে তাকিয়ে দেখি ঘাটে যাত্রীদের পুলিশ এবং আনসার তল্লাশি করছে। নামধাম জিজ্ঞেস করছে। লঞ্চ থেকে নেমে আসলে আমাকেও তারা একইভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমি আগেই জানতাম খুলনায় বহু অবাঙালী থাকে। অবাঙালীরা দেখতে লম্বা-চওড়া, সুঠামদেহী ও সুন্দর হয়। তাই আমি উর্দু ভাষায় বলি, ‘বিজনেস কে লিয়ে ম্যায় সাতক্ষীরা গায়া থা (আমি সাতক্ষীরা ব্যবসার কাজে গিয়েছিলাম)। ম্যায় খুলনা টুটপাড়া মে র‌্যাহতা হু (আমি খুলনার টুটপাড়ায় থাকি)।’ তারা আমাকে বিশ্বাস করে ছেড়ে দেয়। আমার মেজ বোন থাকে খুলনায়। তার বাড়ি টুটপাড়ায়। তার বর সরকারী কর্মচারী। তিনি খুলনায় বদলি হয়ে এসেছেন। অসময়ে আমি বোনের বাড়ি এসেছি। তারপরও মেজ আপা আমাকে দেখে খুব খুশি হয়। আমি তাকে কাপড় দিতে বলি পরার জন্য। কারণ তখনও আমার পরনের কাপড় থেকে গন্ধ বের হচ্ছিল। কাপড় বদলের সময় তিনি আমার পিঠ দেখতে পান। আমার পিঠে লাল লাল দাগ দেখে তিনি কেঁদে ফেলেন। আমাকে বলেন, এভাবে দেশের জন্য জীবন দিয়ে দিস না। দেশের মানুষ তোর এ ত্যাগের কথা মনে রাখবে না। রংপুরে আমার এক বন্ধু ছিল। তার নাম পারভেজ। তার বাবা ক্যাপ্টেন মকবুল আলী এবং আমার ছোটবেলার টিচার ফণীদা একই কথা বলতেন। কারণ তাঁরা স্বদেশী ছিলেন। তাঁরা বলতেন, এদেশের মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সন্ত্রাসী বলে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় যারা এদেশের মানুষের মুক্তির জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে, তাঁদেরও কেউ ভাল চোখে দেখত না। তাঁদের সন্ত্রাসী বলত। তোরা আজকে যে ত্যাগ স্বীকার করছিস, জানি না ওরা তোদের সে ত্যাগের যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারবে কি-না! বোনের বাড়ি দু’দিন বেড়িয়ে তারপর আমি একদিন রকেট স্টিমারে (বাংলাদেশের পরিবহন জগতে রকেট স্টিমারের ভূমিকা বিশাল। প্রায় শত বছর ধরে রকেট স্টিমার নদীপথে চলাচল করছে। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে ঢাকা/খুলনা, ঢাকা/বরিশাল, বরিশাল/গোয়ালন্দ ইত্যাদি অঞ্চলে যোগাযোগ রক্ষা করত রকেট স্টিমার। তখনকার মানুষ এ স্টিমারে করে গোয়ালন্দ গিয়ে পরে ট্রেনে কলকাতা যেত।) চড়ে ঢাকা রওনা হই। ইচ্ছে করেই ট্রেনে কিংবা বাসে রওনা হইনি। আমি জানি, আমাকে ধরার জন্য ওরা জাল বিছিয়ে রেখেছে। আমি সাবধানে চলাচল করে তাদের সব কৌশল ব্যর্থ করে দিতাম। স্টিমার ঢাকা এসে পৌঁছে। ঢাকা থেকে স্টিমারযোগে খুলনা আসা-যাওয়া করতে দীর্ঘ সময় লাগে। সব সময় নিজেকে লুকিয়ে রাখা যায় না। তবে আপন প্রতিভায় আমি তাও করেছি। স্টিমারে একেক সময় একেক জায়গায় লুকিয়ে থেকেছি। একটু আগে যে আমাকে দেখে গেছে কয়েক মিনিট পরে এসে পুরো স্টিমার তল্লাশি করেও সে কোথাও আমাকে খুঁজে পায়নি। আমি স্টিমারে করে ঢাকা এসে সদরঘাট নামী। তারপর লঞ্চের সঙ্গে ভেড়ানো নৌকায় করে কেরানীগঞ্জের আলিম হাজির বাড়ি আসি। পরদিন সোয়ারীঘাট পার হয়ে রিক্সায় চড়ে ইকবাল হলে আসি। হলে এসে সিরাজ ভাই, এ্যাডভোকেট এন্তাজ ভাই, মুস্তাফিজসহ আরও কয়েকজন ছাত্রকে করিডোরে দাঁড়ানো দেখতে পাই। এন্তাজ ভাই দৌড়ে এসে বলে তুমি পালিয়ে চলে আসার পর আমরা যারা তোমার জামিনের জন্য মুভ করতে দাঁড়িয়েছিলাম পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে মুখ রক্ষার চেষ্টা চালায়। আমরাও অতি কষ্টে কোর্ট থেকে পালিয়ে ঢাকা চলে এসেছি। জীবনে এমন বিপদে পড়িনি। তুমি ভাই বড় ভয়ঙ্কর ব্যক্তি। এদিকে বেশ কিছুদিন পর ছাত্রলীগ এবং নিউক্লিয়াস কর্মীরা আমাকে হলে দেখতে পেয়ে উল্লাস প্রকাশ করে। তারা আমাকে ঘিরে ধরে এত সব অদ্ভুত কার্যকীর্তির রহস্য জানতে চায়। কারণ আমি হঠাৎ করে পার্টির কাজে উধাও হয়ে যেতাম। কাজ শেষে এসে আবার ছাত্রলীগের কর্মীদের কৌতূহল মিটাতাম। তাদের এসব কৌতূহল ও জিজ্ঞাসায় আমি একটুও বিরক্ত না হয়ে বরং আনন্দ পেতাম। তারা সবাই আমার কার্যকলাপ দেখে হো হো করে হেসে গড়াগড়ি খেত। তাই এবারও আমি সাতক্ষীরা দিয়ে অস্ত্র আনার ঘটনাটি বেশ মজা করে তাদের বলি। তারা আমার কাহিনী শুনে ভয়ে ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত। আবার কখনও কখনও হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ত একজন আরেকজনের গায়ে। তারা অনেকটা গর্ব করেই বলত খসরু ভাইকে গ্রেফতার করে এমন সাহস আর বুদ্ধি পাকিস্তানীদের নেই। এ একজনই ওদের সর্বনাশ করে ছাড়বে। পরিশেষে, জাতীর কাছে আমার কিছু জিজ্ঞাসা। তা হলো, পৃথিবীর সমগ্র আন্দোলনের সশস্ত্র সংগ্রামী নেতারা, এমনকি ভারত উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাঁদের অবদানের জন্য মূল্যায়িত হয়েছেন। শুধুমাত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামী নেতাদের বেলায় কেন এ বৈষম্য? যদি সত্যিকার অর্থে কোন বৈষম্য না হয়ে থাকে তবে স্বাধীনতা-সশস্ত্র যুদ্ধের প্রতিটি সেক্টর এবং বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর চার সেক্টরের ‘অপারেশন’-এর ঘটনার সঠিক তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করা হোক কারা সে সময়ের আসল বীর মুক্তিযোদ্ধা। (সমাপ্ত) লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা সিটি গেরিলা কমান্ডার, নিউক্লিয়াস এবং বিএলএফের অন্যতম সদস্য
×