ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

পোশাক শিল্প ॥ আবারও শঙ্কা?

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ২৯ মার্চ ২০১৭

পোশাক শিল্প ॥ আবারও শঙ্কা?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির বেশ কয়েকটি পোশাক প্রতিষ্ঠান তাদের আউটলেট গুটিয়ে নিচ্ছে। সিয়ার্স বিয়াল্লিশটি, কেমার্ট এক শ’ আটটি, জে সি পেনি এক শ’ আটত্রিশটি, আমেরিকান এ্যাপারেল এক শ’ দশটি এবং মেসি’স আটষট্টিটি আউটলেট এ বছরের মধ্যেই বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। বছরে এক শ’ কোটি ডলার বাঁচাতে সিয়ার্স হোল্ডিংস কর্পোরেশন তাদের এমন পরিকল্পনার কথা ফেব্রুয়ারিতেই জানিয়েছিল। সিয়ার্স এ ঘোষণা দিয়েছিল খুচরা বিক্রির চ্যালেঞ্জে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে। আর আমেরিকান এ্যাপারেল ঋণে জর্জড়িত হয়ে বাধ্য হচ্ছে এমন পদক্ষেপ নিতে। এ প্রতিষ্ঠানের স্বত্ব ও কিছু সম্পদ এর মধ্যেই কানাডার একটি প্রতিষ্ঠান কিনে নিয়েছে। পোশাক ও নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য বিক্রির প্রতিষ্ঠান জে সি পেনি বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় পনেরো কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক কেনে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে এক হাজার বিক্রয় কেন্দ্রের মধ্যে এক শ’ আটত্রিশটি আগামী জুনের মধ্যে বন্ধ করে দেয়ার প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছে তারা। এসব প্রতিষ্ঠানের আউটলেট বন্ধ হলে তার নেচিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমই এরসহ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান পত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এভাবে- দুই বছর ধরে বিশ্বব্যাপী পোশাকের ব্যবসা কমেছে। তারই ধারাবাহিকতায় বড় ব্র্যান্ডের বিক্রয় কেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা আসছে। কারণ একেকটি বিক্রয় কেন্দ্রে কর্মচারীদের বেতন-ভাতার পেছনে ব্র্যান্ডগুলোকে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়। আর যেহেতু বিক্রয় কেন্দ্রের সঙ্গে পোশাক উৎপাদনের বিষয়টি সরাসরি যুক্ত তাই বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ হলে পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের প্রতিক্রিয়ায় উদ্বেগ চাপা থাকে না- যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা এতদিন পোশাকের দাম কম দিচ্ছিলেন। তারপরেও ক্রয়াদেশ পাওয়া যাচ্ছিল। এখন ক্রয়াদেশই কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছি আমরা। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রফতানি এমনিতেই কমের দিকে ছিল। এখন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের স্টোর বন্ধের ঘোষণা আমাদের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়েই আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের বড় ব্র্যান্ডের এসব আউটলেট বন্ধ হলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে নিশ্চিতভাবে এর প্রভাব পড়বে। কারণ বাংলাদেশের বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র। তারচেয়েও বড় যা লক্ষ্যণীয় তা হলো উৎপাদনশীল অর্থনীতিতে আমেরিকা শুধু নয় বিশ্ব পুঁজিবাদই সঙ্কটে। সামাজিক ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসা, ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের ওপর বীমা, রিয়েল এস্টেট ব্যবসাকে উৎসাহিত করা ইত্যাদি অনুৎপাদনশীল খাতকে গত দু’দশকের বেশি সময় ধরে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ। সেদিক থেকে বলা যায়, পুঁজিবাদের চরিত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। বিশেষ করে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর আর্থিক খাত উৎপাদন খাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উৎপাদনশীল খাতের চেয়ে অনুৎপাদনশীল খাতে পুঁজির লগ্নি বহুগুণ বেড়েছে। পঞ্চাশের দশকে মার্কিন অর্থনীতিতে মোট কর্পোরেট মুনাফার শতকরা আট ভাগ এসেছে অনুৎপাদনশীল খাত থেকে। দু’হাজার সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা একত্রিশ ভাগে। সে বছর অনুৎপাদনশীল আর্থিক খাতে মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা সাড়ে তিনগুণ ঋণ দেয়া হয়েছিল। পুঁজির এ অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান বিশ্ব পুঁজিবাদের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। গত শতকের সত্তর দশক পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের শতকরা নব্বইভাগ ছিল বাণিজ্য ও উৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে জড়িত। এই পুরো অংশ এখন চলে গেছে অনুৎপাদনশীল খাতে। এর আন্তর্জাতিক প্রভাব থেকে মুক্ত নয় বাংলাদেশও। আটাত্তর সাল থেকে শুরু করে এগিয়ে চলা উৎপাদনশীল তৈরি পোশাক খাত সম্ভবত অনুৎপাদনশীলতার ধাক্কায় টলে উঠছে। শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্বের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার জায়গা দখল করছে পুঁজিবাদী নৈরাজ্য? শঙ্কা হয়। একটা দেশের কলকারখানা চালু থাকা মানে তার অর্থনৈতিক প্রবাহে স্বাভাবিক গতি থাকা, যা সামাজিক সম্পর্কের ভারসাম্য ধরে রাখার পূর্বশর্ত। উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকের বেকার হয়ে অনিশ্চিত পথ পাড়ি দেয়ার প্রভাব শুধু তার একার জীবনে নয়, সমাজের সার্বিক জীবনযাত্রাতেই পড়ে। কারখানায় কাজ করা শ্রমিকের আত্মবিশ্বাস যে সংস্কৃতি তৈরি করে বেকার ভবঘুরে জীবন তা পারে না। ক্ষুুদ্র ঋণে যাদের জীবন চলে তাদের পক্ষেও তা সম্ভব নয়। কারণ ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতার বিচরণের গতি তার গ্রাম বড়জোর ইউনিয়ন পর্যন্ত আর কারখানা শ্রমিককে সমাজের সঙ্গে অনেক বেশি আন্তঃসম্পর্কে (ওহঃবৎধপঃরড়হ) যেতে হয়। শ্রমিকের সঙ্গে সম্পর্কের প্রয়োজনে অন্যান্য শিল্পায়ন জরুরী হয়ে পড়ে। যেমন দেশীয় প্রসাধনের বাজার ধরে রাখতে পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকদের অবদান সবচেয়ে বেশি। পোশাক শ্রমিকদের প্রয়োজনে আরেকটা শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও বহুজাতিক কোম্পানির দেশীয় দালালদের জন্য দেশীয় প্রোডাক্ট মার খাচ্ছে। এই মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে দেশীয় পণ্য যেমন বিপর্যস্ত তেমনি বিপর্যস্ত শ্রমিক-কৃষক। গরিব কৃষক আরও গরিব হতে হতে রাজপথে ছিন্নমূল। শ্রমিকও কারখানা থেকে উৎখাত হয়ে কৃষকের পরিণতি মেনেছে। একজন দক্ষ শ্রমিক দেশের অমূল্য সম্পদ। হাজার হাজার দক্ষ শ্রমিকের হাত নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিচরণ অবাধ করতে মূল ভূমিকায় ছিল জেনারেল শাসকরা। বিশ্বব্যাংকের কাঠামোগত সংস্কারের অংশ হিসেবে সে সময় সরকারী মালিকানার ছয় শ’ পঞ্চাশটি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমালিকানায় দেয়া হয়েছিল। উনিশ শ’ বিরাশি সালের নবেম্বর থেকে উনিশ শ’ পঁচাশির জুলাই পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত পঁয়ত্রিশটি পাটকল ঢালাওভাবে ব্যক্তিমালিকানায় দেয়া হয়েছিল। প্রতিবাদে সে সময় সারাদেশে শ্রমিক-কর্মচারীরা ব্যাপক আন্দোলনে নামে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের কড়া নির্দেশ মেনে শ্রমিক আন্দোলন উপেক্ষা করে বিরাশি সালের তিরিশ নবেম্বর একদিনেই সরকার দশটি এবং পরের মাসে আরও তেরোটি পাটকল বেসরকারী খাতে ছেড়ে দিয়েছিল। উনিশ শ’ পঁচানব্বই সাল পর্যন্ত এ ধারাবাহিকতা। এমন সব মালিকের কাছে কলগুলো দেয়া হয়েছিল যাদের অনেকের শিল্প প্রতিষ্ঠান চালানোর কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। এক সঙ্গে এতবড় বেসরকারীকরণ পৃথিবীতে এর আগে হয়নি। ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসা এবং তাদের উত্তরাধিকারী সরকারের পক্ষে এমন আত্মঘাতী কাজ করা সহজ। কারখানা বন্ধ করে দেশী-বিদেশী বাণিজ্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের লুটেপুটে খাওয়ার অবাধ সুযোগ সরকারীভাবেই করা হয়েছিল। এখন আন্তর্জাতিক পুঁজির চরিত্র বদলানোয় গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষ্যেও কলকারখানার আগেরকার গতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কারখানা বন্ধ থাকা মানে শুধু ওই কারখানাই বন্ধ থাকা নয়। অসংখ্য শ্রমিকের জীবনোপাখ্যানের ভিত রয়েছে ওখানে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছোটখাটো অনেক উৎপাদনশীল খাত। নারী শ্রমিকরা বাঁচিয়ে রেখেছেন দেশী-বিদেশী প্রসাধন কোম্পানি থেকে শুরু করে দেশী টেক্সটাইল স্যান্ডেল-জুতো উৎপাদনকারী বহু প্রতিষ্ঠান। তাদের আয়ের উৎস বন্ধ হওয়া মানে এসব কিছুতে নেতিবাচক প্রভাব পড়া। আমেরিকান ব্রান্ডেড আউটলেট বন্ধ হওয়া দেশীয় অর্থনীতি ও শ্রমিকদের জন্য কঠিন বাস্তবতা বয়ে আনতে পারে।
×