ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গণহত্যা দিবস পালন করে না, পাকিস্তানই ওদের আপন

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৮ মার্চ ২০১৭

গণহত্যা দিবস পালন করে না, পাকিস্তানই ওদের আপন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালন না করায় বিএনপি-জামায়াত জোটের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, এই রাজনৈতিক গোষ্ঠী দেশের মুক্তিকামী ও স্বাধীনতাকামী জনগণ নয়, একাত্তরের ঘাতক-যুদ্ধাপরাধী-আলবদর ও পরাজিত পাকিস্তানকেই আপন মনে করে। এরা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। প্রমাণ করেছে তারা একাত্তরের ঘাতক রাজাকার-আলবদরদের দোসর। যারা পরাজিত শক্তির পদলেহন করে, খুনিদের মদদ দেয়, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানায়, গণহত্যা দিবস পালন করে না তারা কখনই দেশের উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণ করতে পারে না- এ কথাটি দেশের জনগণকে অনুধাবন করতে হবে। আর জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশের মাটিতে কোন জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের স্থান হবে না। এদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে যা যা করার তা সবই করা হবে। জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানও চলবে, দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির চাকাও সচল রাখা হবে। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে সোমবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অভিযানেই গেলেই কাদের মনে কষ্ট লাগে, মনবেদনার সৃষ্টি হয় তা দেশবাসীর সামনে স্পষ্ট। দেশ এগিয়ে গেলে, দেশের মানুষ শান্তিতে থাকলেই এদের অন্তর্জ্বালা শুরু হয়। কীভাবে জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের রক্ষা করবে, তাদের অপকর্ম কীভাবে ঢাকবে সে জন্য একই ভাঙ্গা রেকর্ড তারা বাজিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। আমরা চাই না দেশে কোন জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি হোক। বিএনপি-জামায়াত জোটের অগ্নিসন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও যেভাবে দেশের মানুষ মোকাবেলা করেছে, এখন সময় এসেছে এসব জঙ্গী-সন্ত্রাসীদেরও ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা ও প্রতিহত করার। ধর্মের নামে জঙ্গীবাদ ও আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী পুরো মুসলমানদেরই বিশ্বের সামনে হেয় করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইসলাম শান্তি ও পবিত্র ধর্ম। ইসলামে আত্মহনন মহাপাপ। কিন্তু ইসলাম ধর্মের নাম ব্যবহার করে কিছু বিপথগামী এসব অপকর্ম করে বিশ্বের সব মুসলমানদেরই হেয় করছে। আত্মহনন করে মানুষ মারতে পারলেই নাকি জান্নাতে যাবে, সঙ্গে আরও ৭০ জনকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে! এ পর্যন্ত যারা আত্মঘাতী হয়েছে তারা কী জান্নাতে গেছে নাকি দোজখে গেছে? কেউ (আত্মঘাতী) কি এ ব্যাপারে কোন ম্যাসেজ পাঠিয়েছে, কেউ কী সেই ম্যাসেজ পেয়েছে? আসলে এরা পবিত্র ও শান্তির ধর্ম ইসলামকেই হেয় করছে। এসব মুষ্টিমেয় কিছু লোক পুরো মুসলমানদের জীবনই অতিষ্ঠ করে তুলেছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেনÑ সভাপতিম-লীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিম-লীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, কেন্দ্রীয় নেতা ও ডাকসুর সাবেক ভিপি আকতারুজ্জামান, কেন্দ্রীয় নেত্রী ড. শাম্মী আহমেদ, ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান, দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ প্রমুখ। সভা পরিচালনা করেন প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মঞ্চে উপস্থিত থাকলেও বক্তৃতা করেননি। আওয়ামী লীগ আয়োজিত এই আলোচনা সভা বিকেল তিনটায় শুরু হয়। এর আগে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে নেতাকর্মীরা সমবেত হন কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন অডিটরিয়াম এলাকায়। বেলা দুইটার মধ্যে নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয় হলরুম। মিলনায়তনে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় বাইরে দাঁড়িয়েই হাজার হাজার মানুষকে মাইকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শুনতে দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ ৩৪ মিনিট বক্তৃতায় দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদান, সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ে, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত রাখা এবং বিএনপির অপরাজনীতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী বাড়ি ভাড়া দেয়ার সময় বাড়িওয়ালাদের আরও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, যাকে বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন তারা কী করে, কোথায় থেকে এসেছে তা ভাল করেই জেনেই ভাড়া দেবেন। নইলে ক্ষতি আপনাদেরই হবে। আর দেশবাসীর কাছেও আমার অনুরোধ, যে যেখানেই আছেন খোঁজ নিয়ে যারা জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করুন। জঙ্গীদের কোন ঠাঁই এ দেশে হবে না। এদের বিরুদ্ধে যা যা করার তা সবই করা হবে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের টাইগারদের শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টেস্ট ও ওয়ানডে জয়ের কথা তুলে ধরে বলেন, একদিকে খেলা অন্যদিকে জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অভিযানÑ এই দুই টেনশন নিয়েই আমাদের চলতে হচ্ছে। একদিকে আমাদের আনন্দের খবর, অন্যদিকে জঙ্গীদের তৎপরতা। আমরা দেশে কোন জঙ্গী বা সন্ত্রাস দেখতে চাই না। যে কোন মূল্যে আমরা দেশের মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো। প্রধানমন্ত্রী এ সময় দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে দেশবাসীকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ঘরের শত্রু বিভীষণ রয়েছে। এই বিভীষণদের জ্বালা নিয়েই আমাদের চলতে হবে। এরা নিজের স্বার্থ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর দেশের দুর্নাম করে বেড়ায়। নিজেদের স্বার্থেই জঙ্গীদের মদদ দেয়, রক্ষা করার চেষ্টা করে। দেশকে বিশ্বের সামনে হেয় করার চক্রান্ত করে। এ সময় বঙ্গবন্ধুর একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন, এ দেশের মাটি এতই উর্বর যে বীজ ফেললে ফসলও জন্মায়, সঙ্গে আগাছা-পরগাছাও জন্মায়। বাস্তবে দেশের মধ্যে থাকা এসব আগাছা-পরগাছা (ষড়যন্ত্রকারী) উপড়ে ফেলতে পারলে দেশের আরও উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি আসবে। জিয়াউর রহমানকে যারা স্বাধীনতার ঘোষক বলে তাদের ‘অর্বাচীন’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন একজনের বাঁশির ফুঁ-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ২৪ বছরের সংগ্রাম ও সঠিক নেতৃত্বের ফসলই হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা। তাই এখন স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কে কী বলে তা নিয়ে আলোচনা করার কোন দরকার নেই। আর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়েই বিতর্কের অবসান হয়ে গেছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়েই রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন স্বাধীনতার ঘোষক। আদালতের রায় অমান্য করে যেসব অর্বাচীন ঘোষক নিয়ে মিথ্যাচার করবে তখন বুঝবেনÑ ‘পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়।’ আসলে যারা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, পরাজিত শক্তির পদহেলন করে তারাই এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চায়। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘদিন পরে হলেও এবারই প্রথম সরকারীভাবে গণহত্যা দিবস পালিত হয়েছে। ৯ ডিসেম্বরকে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করেছে। এর ফলে যেসব দেশে গণহত্যা হয়েছে, সেসব দেশের গণহত্যা দিবসটি পালনের সুযোগ হয়েছে। তিনি বলেন, পুরো দেশের মানুষ গণহত্যা দিবস পালন করলেও একটিমাত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী বিএনপি-জামায়াত জোট দিবসটি পালন করেনি। এর মাধ্যমে দেশবাসীর সামনে তাদের চরিত্র আরও স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, এই অপশক্তি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের পুরস্কৃত করেছে, একাত্তরের গণহত্যাকারী, মা-বোনের সম্ভ্রম যারা কেড়ে নিয়েছে, যারা যুদ্ধাপরাধী-রাজাকার-আলবদর তাদের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-উপদেষ্টা বানিয়ে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। যারা খুনিদের মদদ দেয়, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়ে পুরস্কৃত করে, যারা ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালন করে না, তারা কখনই দেশের মানুষের কল্যাণ চাইতে পারে না। আসলে এরা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, ১ হাজার ২০০ মাইল দূরের পরাজিত রাষ্ট্রের পদলেহন, তোষামোদি-খোষামোদি করে। এসব কথা দেশবাসীকে অনুধাবন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ ২১টি বছর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। দেশের একটি প্রজন্মই আছে যারা মিথ্যা ইতিহাস পড়ে বড় হয়েছে। এরা বাংলাদেশের মানুষের যে মর্যাদা রয়েছে তা ভুলে দিতে চেয়েছিল। এরা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি চায় না, বরং বাধা দিতে চায়। ক্ষমতায় থাকতে এরা দেশের মানুষকে ভিক্ষুক রেখে বিদেশ থেকে ভিক্ষা এনে নিজেরা বিলাসব্যাসন করেছে, দেশের মানুষ গরিব থেকে আরও গরিব হয়েছে। একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেই দেশের উন্নয়ন হয়, তা আমরা প্রমাণ করেছি। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ নিজেদের ভাগ্য গড়তে নয়, জনগণের ভাগ্য গড়তে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের মানুষের মুখে দু’বেলা খাদ্য নিশ্চিত, পরনে কাপড়, উন্নত জীবন নিশ্চিত করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। আমরা মানুষের কল্যাণের জন্য আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করছি বলেই দেশে এত দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে। পৃথিবীর কোন দেশ এত স্বল্প সময়ে দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করতে পারেনি। তিনি বলেন, আমরা ক্ষমতা ভোগ করার জন্য আসিনি। আমরা শাসক নয়, দেশের প্রকৃত সেবক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা রক্ত দিয়ে গেছেন, তাদের রক্ত আমরা কোনক্রমেই বৃথা যেতে দেব না। বাংলাদেশকে আমরা অবশ্যই ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবোই।
×