ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

একাত্তরে গণনির্যাতনের জীবন্ত সাক্ষী রংপুর টাউন হল

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৭ মার্চ ২০১৭

একাত্তরে গণনির্যাতনের জীবন্ত সাক্ষী রংপুর  টাউন হল

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর, ২৬ মার্চ ॥ জেলার সকল সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কর্মকা- ও মুক্ত বুদ্ধি চর্চার প্রাণকেন্দ্র ঐতিহ্যবাহী রংপুর টাউন হল। প্রায় এক শতাব্দীর ঐতিহ্য ও স্মৃতি জড়িয়ে আছে টাউন হলের শরীরজুড়ে। এটি শুধু একটি অডিটরিয়াম বা হল নয়, বরং সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক গঠনমূলক কর্মকা-ের সূতিকাগার। এ চত্বর একদা মুখরিত ছিল অবিভক্ত ভারতের অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, কবি-সাহিত্যিকের পদচারণায়। এখান থেকেই অনেক ক্ষণজন্মা পুরোধা ব্যক্তিত্ব বাঙালী সংস্কৃতির মুক্ত চিন্তার পথ দেখিয়েছেন। বহু সামাজিক, রাজনৈতিক সংস্কারের সাক্ষী হয়ে অনেক আনন্দ- বেদনার কাব্য ধারণ করে রংপুর শহরের ঠিক মধ্যস্থানে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে টাউন হল। যার প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল ‘রংপুর নাট্য সমাজ গৃহ’। রংপুরের অনেক স্থাপনার সঙ্গে মিশে আছে কাকিনার রাজা মহিমা রঞ্জন রায়ের নাম। তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব। শিক্ষার প্রতি অগাধ ভালবাসা থেকে অনগ্রসর বাঙালীকে সুশিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরির জন্য জমি দান করেন তিনি। এখনও রংপুর টাউন হল, কৈলাশরঞ্জন স্কুল, রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি তারই মহিমার গৌরবগাথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই অঞ্চলের নাট্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক কর্মকা- বিকাশের জন্য ১৮৮৫ সালে তৎকালীন রঙ্গপুর নাট্য সমাজ (রংপুর ড্রাম্যাটিক এ্যাসোসিয়েশন বা আর.ডি.এ) একটি রঙ্গমঞ্চ বানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রেও এগিয়ে আসেন কাকিনার রাজা মহিমা রঞ্জন রায়। ১৮৯১ সালে রংপুরের উৎসাহিত নাট্য সমাজকে একটি রঙ্গশালা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ১০ বিঘা ৩ কাঠা জমি দান করেন। নির্মিত হয় রংপুর টাউন হল। নিশ্চয়ই তিনি কখনও ভাবেননি নট-নটীদের শিল্পকলা প্রদর্শনের রঙ্গমঞ্চটি একদিন মানব সভ্যতার বর্বরতম গণনির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত হবে। ১৯৭১ এ যুদ্ধের বিভীষিকায় অসংখ্য মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়েছে। সেই বিভীষিকাময় দিনের স্মৃতি ধারণ করে চলেছে এখনও রংপুর টাউন হল, যেন জীবন্ত ইতিহাস। একদিন যে রঙ্গমঞ্চে দর্শক নন্দিত হয়েছিল দত্তা, শর্মিষ্ঠা, কুলীনকুলসর্বস্ব, নীল দর্পণ, সীতা, ছেঁড়া তার, সিরাজুদ্দৌলা, ইডিপাস, মানময়ী গার্লস স্কুলের মতো নাটক, আলো ঝলমল এ রঙ্গমঞ্চে নূপুরের ঝঙ্কারে মানুষের হৃদয়ে জাগিয়েছিল সুরের ঢেউ। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই রঙ্গমঞ্চে রচিত হলো পৈশাচিকতা, নৃশংসতা আর বর্বরতার এক নির্মম ইতিহাস। রংপুর নাট্য সমাজ গৃহের রঙ্গমঞ্চ রঞ্জিত হলো জানা-অজানা অজস্র শহীদের রক্তে। অনেক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক গঠনমূলক কর্মকা-ের জীবন্ত সাক্ষী রংপুর টাউন হলের সঙ্গে মিশে আছে অনেক বেদনা ও কষ্টের ইতিহাস। হলের ইট- পাথরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে ’৭১-এর স্মৃতিগাথা, বীরাঙ্গনাদের আর্তচিৎকার, চাপাকান্না। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই টাউন হলকে পাক হানাদার বাহিনী বানিয়েছিল ‘গণনির্যাতন কেন্দ্র’। বৃহত্তর রংপুরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে আনা হতো নিরপরাধ মুক্তিকামী বাঙালীদের। যাদের একটি বড় অংশ ছিল কম বয়সী নারী। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ধরে আনা নারীর ওপর দিনের পর দিন চলত পাশবিক নির্যাতন। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস এই টাউন হলে চলেছে মানুষরূপী হায়েনাদের নজিরবিহীন গণধর্ষণ, গণনির্যাতন আর গণহত্যা। যে হলে একদা মানুষ ছুটে আসত সুরের মূর্ছনায় সেই হলের গ্রীন রুম, রিহার্সাল রুম আর মঞ্চে ধর্ষিতার ক্রন্দন আর বুকফাটা আর্তনাদে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল পুরো শহরের মানুষ। একাত্তরের নয় মাসে পাক হানাদাররা তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, শান্তি কমিটির সহায়তায় এই গণনির্যাতন কেন্দ্রে ঠিক কত মুক্তিকামী-নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, কত নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন দেশমাতৃকার স্বাধীনতা অর্জনে, সে ইতিহাস এখনও লেখা হলো না। নির্মিত হলো না রংপুর অঞ্চলের অন্যতম বধ্যভূমিতে শতসহস্র শহীদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কোন ‘স্মৃতিস্তম্ভ’। অথচ, হাঁটি হাঁটি পা পা করে পার হয়ে গেলো ৪৬ বছর। এই লজ্জায় আরও কতদিন লজ্জিত হবে মাওলানা কেরামত আলী, নুরুলদিন, শহীদ প্রফুল্ল চাকী, হেয়াত মাহমুদ, শহীদ জররেজ ভাই, শহীদ মুখতার ইলাহির স্মৃতিধন্য রংপুর, কবে রচিত হবে একাত্তরের শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস, এই প্রশ্ন বর্তমান প্রজন্মের। অথচ, প্রতিটি জাতীয় দিবসে এই টাউন হল ক্যাম্পাসেই অবস্থিত রংপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদি ভরে ওঠে ফুলে ফুলে। আজ ৪৬ তম বিজয় বার্ষিকীতেও অনেকে এসেছেন শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে। বিনম্রচিত্তে স্মরণ করেছেন আমাদের জন্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মাহুতি দেয়া অজস্র শহীদের। কিন্তু শহীদ মিনারের ২০০ গজের মধ্যে যে বধ্যভূমি, যেখানে এখনও শোনা যায় জাতির জন্য উৎসর্গীত শত শহীদের আহাজারি, আমরা কেউ তাদের স্মরণ করি না। রংপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন টাউন হল বধ্যভূমির প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তিনি ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে টাউন হলের পেছনে শিখা সংসদে গিয়ে পাকবাহিনীর নৃশংসতা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। তখনও হলের ভেতর থেকে ভেসে আসছিল অসংখ্য নারীর করুণ আর্তনাদ। রঙ্গমঞ্চের গ্রীন রুমের সামনে থেকে কে যেন একজন ‘পানি পানি’ বলে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। শিখা সংসদের পিয়ন নির্মল এগিয়ে যান পানিভর্তি গ্লাস হাতে। এক ঢোকে পানি পান করে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারালেন সেই যুবতী। তার জ্ঞান আর ফিরে আসেনি। জানা যায়নি তার পরিচয়। সেদিন ৫০ বিবস্ত্র নারীকে উদ্ধার করা হয় হলের ভেতর থেকে। কম বয়সী একটি মেয়ে নিজের আঙ্গুল কামড়ে রক্তাক্ত করে সেই রক্তে দেয়ালে লিখেছিলেন ‘আমি বাঁচতে চাই’। নরপশুরা তাকে বাঁচতে দেয়নি। তার মতো অনেক নির্যাতিতা নারী টাউন হলের দেয়ালে দেয়ালে নিজের রক্ত দিয়ে লিখে রেখেছিলেন পাকবাহিনীর রোমহর্ষক নির্যাতনের কাহিনী। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে নিজ শহরে আসা মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন এগিয়ে যান হলের পেছনের দিকের ইঁদারার কাছে। বাতাসে লাশের গন্ধে তার শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়। তার মধ্যেই তিনি এগিয়ে উঁকি দিলেন ইঁদারার ভেতরে। কিন্তু যা দেখলেন তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। স্বপ্নেও ভাবেননি মানুষ এতটা নৃশংস হতে পারে। ইঁদারার ভেতরে পড়েছিল অগণিত মানুষের মৃত দেহ। সরে এলেন তিনি, এগিয়ে গেলেন কৃষি ফার্মের (বর্তমান শিল্পকলা একাডেমি হলের পেছনে চিড়িয়াখানায়) ঝোপজঙ্গলের দিকে। সেখানে তখন ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে অজ্ঞাত পরিচয়ের কয়েকজনের দেহাবশেষ নিয়ে টানাহেঁচড়া করছিল কুকুর-শেয়াল। পুরো কৃষি ফার্মে ছড়িয়ে-ছিটিয়েছিল নাম না-জানা শহীদের মাথার খুলি। এতটুকু দেখার পর আর পারেননি তিনি। সরে এসেছেন ক্যাম্পাস থেকে। পরদিন আরও কয়েক মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আবারও যান টাউন হলে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গলিত-অর্ধগলিত-ছিন্নভিন্ন দেহাবশেষ মাটিচাপা দিলেন তারা। ১৯ ডিসেম্বর সেখান থেকে সংগ্রহ করেছিলেন ১৬৭টি মাথার খুলি। খুলিগুলো পরে টাউন হলের পাশে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির ভবনে ‘রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষদ’র একটি কক্ষে স্থাপিত হয় ‘মুক্তি সেনানী সংস্থা’র অফিসে। অত্যন্ত লজ্জাজনক যে, একদিন সে সব চুরি হয়ে গেলো। যা হতে পারত মুক্তিযুদ্ধের স্মারক। পরবর্তীতে বন্ধ করে দেয়া হয় সেই ঐতিহাসিক ইঁদারা। বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠনকে জায়গা দেয়া হলো ব্যবহারের জন্য। এখনও সেখানে সংস্কৃতির চর্চা হয়, মহড়া হয় নাটকের। কিন্তু এ প্রজন্মের তরুণরা জানে না তারা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। তারা জানে না তাদের বিচরণক্ষেত্রের মাটির নিচে রয়েছে নাম না-জানা অসংখ্য শহীদের দেহাবশেষ। ভরাট করা ইঁদারায় রয়েছে নিরপরাধ মানুষের কঙ্কাল। উৎসাহী সাংস্কৃতিক কর্মীরা টাউন হলের পেছনে বৃক্ষের অনেক চারা রোপণ করেছেন। হয়ত একদিন সেখানে ফুলও ফুটবে। কিন্তু সেই ফুলের সুবাস কি আমাদের অন্তরে নাড়া দিতে পারবে? নরকঙ্কালের ওপর বেড়ে উঠে ফুল গাছের ফুল কি তার সুবাস ছড়াতে পারবে? দীর্ঘ ৪৬ বছরেও টাউন হল হত্যাযজ্ঞের কোন অনুসন্ধান হয়নি। হয়নি শহীদদের স্মরণে কোন স্মৃতিস্তম্ভ। যদিও বছরখানেক আগে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম বন্ধ হয়ে যাওয়া ইঁদারার জায়গায় একটি অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে। শুধু টাউন হলই নয়, রংপুরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এমন অনেক বধ্যভূমি। বিজয়ের ৪৬ বছর পূর্তিতে রংপুর অঞ্চলের মানুষের সামান্যই চাওয়া, টাউন হল বধ্যভূমিসহ অন্যান্য বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হোক আগামী প্রজন্মের জন্য। যেসব বধ্যভূমিতে এখনও কান পাতলে শোনা যায় অজস্র শহিদী আত্মার করুণ আকুতি - ‘আমরা বাঁচতে চাই! আমরা বাঁচতে চাই’!
×