ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ব্যাংকিং সিস্টেমের মধ্য দিয়ে বিপুল অর্থ যাচ্ছে জঙ্গীদের কাছে

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৭ মার্চ ২০১৭

ব্যাংকিং সিস্টেমের মধ্য দিয়ে বিপুল অর্থ যাচ্ছে জঙ্গীদের কাছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ব্যাংকিং সিস্টেমের মাধ্যমেই জঙ্গীদের কাছে বিপুল অর্থ যাচ্ছে; তাই শুধুমাত্র দুর্নীতি টেনে ধরতে পারলে জঙ্গীবাদ টেনে ধরা সম্ভব বলে দাবি করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। একই সঙ্গে নিয়মনীতি অনুযায়ী আর্থিক লেনদেন হলে জঙ্গী অর্থায়ন বন্ধ হবে। এজন্য দুদকের পক্ষ থেকে ব্যাংককে নীতিমালা ও বিধিমালা মেনে পরিচালনা করতে বার্তা দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। রবিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ের সামনে ‘দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ-২০১৭’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় দুদক কমিশনার ড. নাসিরউদ্দীন আহমেদ, এএফএম আমিনুল ইসলাম এবং কমিশনের সচিব আবু মোঃ মোস্তফা কামাল, মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) ড. শামসুল আরেফিন, মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মোঃ মঈদুল ইসলাম, মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) আসাদুজ্জামান, মহাপরিচালক (তদন্ত) ফরিদ উদ্দীন ভুইয়া, মহাপরিচালক (মানি লন্ডারিং) আতিকুর রহমান খানসহ উর্ধতন কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ উপস্থিত ছিলেন। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, দেশজুড়ে চলমান জঙ্গীবিরোধী অভিযানের সময় বিভিন্ন জঙ্গী আস্তানায় পুলিশ বিগত সময়ে অভিযান চালিয়েছে, সেখানে প্রচুর অর্থ পাওয়া গেছে। এই অর্থ তো ব্যাংকিং সিস্টেম থেকেই আসে। টাকা তো হাওয়া থেকে আসে না। আর উদ্ধার হওয়া বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই জঙ্গীদের হাতে যাচ্ছে। জঙ্গীবাদের অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আসে। আর আসে হয়ত হুন্ডির মাধ্যমে। হুন্ডির মাধ্যমে ব্যাপক অর্থ আসে বলে মনে হয় না। হুন্ডি বন্ধ করার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদক যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি। ইকবাল মাহমুদ বলেন, এখন ঋণ বা অর্থ আদান-প্রদানে যথেষ্ট নিয়ম মানা হচ্ছে। আমি মনে করি, ব্যাংকিং সিস্টেম যদি আমরা সঠিকভাবে চালাতে পারি, জঙ্গী অর্থায়ন বন্ধ হবে। প্রত্যেকের কাছে গিয়ে জঙ্গী অর্থায়ন বন্ধ করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেনÑ একটা সিস্টেমে যেতে হবে, আমরা সেই সিস্টেমেই কাজ করছি। জঙ্গীর বিষয়টা দুদকের কাজের মধ্যে সরাসরি পড়ে না জানিয়ে তিনি বলেন, এটা (জঙ্গীবাদ) ঘুরিয়ে আসে। দুর্নীতির সংজ্ঞা করতে গেলে জঙ্গীবাদ একটি উদাহরণ। দুর্নীতিকে টেনে ধরতে পারলে জঙ্গীবাদও টানা সম্ভব হবে। দুর্নীতির লাগাম যদি টানা যায়, ছেলেমেয়েদের যদি সঠিকভাবে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করাতে পারি, শিশুদের সঠিকভাবে মানুষ করতে পারলে তারা জঙ্গীবাদের সম্পৃক্ত হবে না। রবিবার থেকে শুরু হওয়া ‘দুর্নীতি হলে শেষ Ñনিজে বাঁচব, বাঁচবে দেশ’ সেøাগানে দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ ২০১৭ পহেলা এপ্রিল পর্যন্ত দুদক বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির প্রধান বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহ পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ যেমন ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিসেবী যারা আছেন সবাই মিলে দুর্নীতির করালগ্রাস থেকে দেশকে মুক্ত করা। সবাই এক সুতোয় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে দুর্নীতি দূর করা সম্ভব। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগে কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দুই কমিশারকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় পতাকা ও কমিশনের পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় গার্ল গাইডস ও গণযোগাযোগ অধিদফতরের শিল্পীরা জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন। এরপর শান্তির প্রতীক পায়রা ও বেলুন-ফেস্টুন উড়িয়ে প্রতিরোধ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী বক্তব্যে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি এবং বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহের উদ্দেশ্য হলো দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে সচেতন করে দুর্নীতি প্রতিরোধে সম্মিলিতভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। তাই আজ থেকে দেশের প্রতিটি জেলা,উপজেলা,নগর ও মহানগরে দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহের কর্মসূচী শুরু হলো। দুর্নীতিবিরোধী সংগ্রামে সকলকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দুর্নীতিই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপির ২ থেকে ৩ ভাগ গ্রাস করে ফেলছে। তাই দেশের স্বার্থে আমরা সম্মিলিতভাবে দুর্নীতির মাত্রা কমিয়ে আনতে চাই। আজ শপথ নেয়ার সময় এসেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছি, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক মুক্তি তথা স্বাধীনতা, ভূখ-, পতাকা পেলেও আমরা অর্থনৈতিক মুক্তি পুরোপুরি পাইনি। এই অর্থনৈতিক মুক্তির প্রধান অন্তরায় হচ্ছে দুর্নীতি। তাই সম্মিলিতভাবেই দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে কারো কোন বিরোধ নেই। সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে। তাই আসুন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী অহিংস প্রতিবাদ করি। দৃঢ়কণ্ঠে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর উচ্চারণ করি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণকে আরও সচেতন করার বার্তা দেই। এক্ষেত্রে তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। সাংবাদিকগণের প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ক্ষমতা কিংবা বিত্তবৈভবের জোরে কেউ ছাড় পাবেন, সে সংস্কৃতি সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনে আমরা ইতোমধ্যেই ভেঙ্গে দিয়েছি। আমরা কেউ-ই আইনের উর্ধে নই। দুর্নীতি করলে কেউ-ই ছাড় পাবেন না কিংবা ছাড় দেয়া হবে না। বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুর দুর্নীতি সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে ইকবাল মাহমুদ বলেন, ৫৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রতিটি মামলাই অত্যন্ত জটিল। দুর্নীতির এই অর্থ ধারাবাহিকভাবে লেয়ারিং হয়েছে। তাই আমাদের গভীরভাবে প্রতিটি লেয়ারে সম্পূর্ণ এবং বিশ^াসযোগ্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তদন্ত করতে হচ্ছে। আমরা এমনভাবে তদন্ত সম্পন্ন করতে চাই যাতে প্রকৃত অপরাধী শাস্তি পায়। ব্যক্তি আমাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়। তিনি বলেন, সাধারণভাবে ধরে নেয়া যায় যে, দুর্নীতিই জঙ্গীবাদসহ অন্য অনেক অপরাধের জন্ম দেয়। তাই আমাদের সন্তানদের দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে এবং তাদের মূল্যবোধকে জাগিয়ে তুলতে পারলে জঙ্গীবাদসহ অনেক অপরাধ সহজেই নির্মূল করা যাবে। উদ্বোধন শেষে দুদকের মিডিয়া সেন্টারে ‘দুর্নীতি বিরোধী আলাকচিত্র ও পোস্টার প্রদর্শনী’ উদ্বোধন করেন ইকবাল মাহমুদ। সপ্তাহব্যাপী এ প্রদর্শনী সর্বসাধারণের জন্য প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকবে। এতে ১শ’ ২২ টি ব্যঙ্গাত্মক ও নানা সেøাগান সংবলিত আলোকচিত্র স্থান পায়। এরপর কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বে কমিশনের সকল স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন এবং মহান শহীদদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন।
×