ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

মেড ইন বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:১৯, ২৭ মার্চ ২০১৭

মেড ইন বাংলাদেশ

মার্চকে আমরা বলি স্বাধীনতার মাস। কেন বলি? এই মাসে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। স্বাধীনতার সংগ্রাম সাত মার্চে ঘোষণার পর আরও কিছুদিন ধৈর্য ধরতে হয়েছিল আমাদের। ছাব্বিশে মার্চ তিনি সে ঘোষণার লিখিত নির্দেশ দেয়ার পরও রাজনীতির এক কালো অধ্যায় এক মেজরকে সামনে নিয়ে আসে। সেক্টর কমান্ডার হওয়ার পরও যিনি পর্যায়ক্রমে এ দেশের ইতিহাস ও চেতনার বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। তার হাত ধরে উঠে আসা স্বাধীনতাবিরোধী ও এদেশের শত্রুরা বহু বছর ধরে বিভ্রান্ত করে এই দেশের জনগণকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন যেখান থেকে আর ফেরার পথ ছিল বলে মনে হতো না। আজ এই মাটি এই দেশ ও ইতিহাস আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আজ আমরা গর্বিত ও প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশী। যত রাজনৈতিক গোলযোগ থাকুক না কেন আজকের বাংলাদেশ আর পেছনে ফিরবে না এবং এই না ফেরার কাজটা করতে হবে তারুণ্যকে। আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় কোন বিষয়টি আমার জীবনকে গৌরবান্বিত করেছে? বলব, আমি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা দেখেছিলাম। যদি প্রশ্ন করা হয় কোন্টি আমার জন্য বেদনার? বলব, আমার শরীরে আছে পরাধীনতার রক্ত। আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মাতে পারিনি। আজ চল্লিশোর্ধ স্বাধীনতা দিবসে যারা এ দেশে জন্মে প্রায় মধ্য বয়সী তাদের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, একবারও কি এই স্বাধীন জন্মের জন্য মাতৃভূমিকে সালাম বা কুর্নিশ জানিয়েছেন? ভেবেছেন কখনও দেশ স্বাধীন না হলে আপনি যে জাতীয় সঙ্গীতটি গাইতে বাধ্য হতেন যার কোন অর্থ আপনি বুঝতেন না। একবারও কি ভেবেছেন বিদেশে আপনার দেশের নামের জন্য, পরিচয়ের জন্য, ভাবমূর্তি বা ইমেজের জন্য আপনার লজ্জার অন্ত থাকত না? আপনি নিরীহ ভদ্র বা শান্ত যাই হোন না কেন দুনিয়া আপনার পাসপোর্টটি দেখলেই চোখ কপালে তুলে ভাবত আপনি একজন সন্ত্রাসী। আপনার পাসপোর্টটি দাখিল করার পরপরই সভ্য দেশের এয়ারপোর্টের মানুষের ভেতর কানাঘুষা শুরু হয়ে যেত। তারা পরস্পর এমনভাবে ফিসফিস করে কথা বলা শুরু করতেন তখন ভাবতে বাধ্য হতেন আপনি একজন দাগি আসামি বা ডাকাত টাইপের কেউ। আপনার দেশের আকাশসীমা দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় বিদেশী বিমান মাটি থেকে গুলি বা রকেট লঞ্চারের ভয়ে রাতে আলো নিভিয়ে দিলে আপনার মনে কি খুব খুশির বাতাস বয়ে যেত? যে ক্রিকেট আপনার প্রাণ সে খেলাটি খেলতে যদি কেউ না আসত কেমন লাগত আপনার? আপনি যে দেশে জন্মেছেন বা আমরা যারা যে দেশের নাগরিক হয়ে আজ একটি সুমধুর ভাষার মালিকানা পেয়েছি সেটি কি আমাদের হাতে থাকত? আপনার কি একবারও মনে হয় না আমাদের পাশের বাংলা রাজ্যটিও বাঙালীর? তাদের ভাষা, পোশাক, খাবার, সংস্কৃতি হুবহু আমাদের মতো হওয়ার পরও তাদের কপালে আজ হিন্দীর তকমা। তাদের কথাও এখন বোঝা মুশকিল। যত অন্যায় অপশাসন আর ভেদাভেদ থাকুক না কেন আমাদের সমাজ বাংলাকে কখনও অমর্যাদা করেনি। একবার ভাবুন কত মায়া আর ভালবাসা আমাদের। এখনও একজন মানুষের জীবন বা মৃত্যুই এ দেশের প্রধান আলোচিত বিষয়। স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় সুফল আপনি বাদ-প্রতিবাদ কিংবা আনন্দ-বেদনা যখন যাই করেন না কেন সে আপনার নিজস্ব। এমন কেউ নেই যে, আপনাকে বলতে পারে তোমার ভাবার বা প্রতিক্রিয়ার অধিকার নেই। সরকার আপনার বিরোধী কিংবা নিজের হতে পারে। রাষ্ট্র কখনও আপনাকে তার ছায়ার বাইরে রাখেনি। এমন একটি দেশ যাদের যারা রক্তে সংগ্রামে এমন একটি ভূখ-, পতাকা আর সঙ্গীত পেয়েছিল তাদের কি দেশপ্রেমহীনতা মানায়? কে আপনাকে বলেছে সবটাই খালি নেগেটিভ? আপনি অপপ্রচারে কিংবা ষড়যন্ত্রে বুঁদ থাকলে ভিন্ন কথা। তা না হলে আপনি দেখতে পাবেন তরতর করে এগিয়েছে অনেক কিছু। এমন সমাজ বা এমন শক্ত জায়গা আমাদের যৌবনে ছিল না। আমরা কবে বিদেশ থেকে জাহাজে করে জন, মাইকেল, কেলি-শেলীদের ফেলে দেয়া কাপড় আসবে, তারপর সেকেন্ডহ্যান্ড মার্কেট থেকে কিনে পরব সে আশায় দিন গুনতাম। তখন জিন্স, কড বা সুতিÑ সবকিছু ছিল অনুদানের মাল। আমাদের জীবনের এক বিরাট অংশে আমরা জানতাম চাল না এলে ভাত জুটবে না এ দেশে। শুধু কি তাই? বিদেশের চাল সময়মতো আসেনি বলে জাতির জনকের শাসনের সময় তাঁকে হত্যার চক্রান্ত পোক্ত হতে পেরেছিল। আর আজ? কাপড় আমরা বানাই। দুনিয়ার দেশে দেশে বড়লোকদের বাজারে শপিং মলে মেইড ইন বাংলাদেশ এখন ইজ্জতের মালামাল। আমাদের আর খাদ্যের জন্য অন্য কারও দয়ার ওপর নির্ভর করতে হয় না। আমাদের ওষুধ একদা কবিরাজি আর হোমিওপ্যাথি হলেও এখন আমরা এলোপ্যাথিক ওষুধ রফতানি করি। আমাদের যত টিভি চ্যানেল, যত সংবাদপত্র, যত অনলাইন পোর্টাল অনেক দেশে তার এক শ’ ভাগের এক ভাগও দেখা যায় না। নেই নেই আর হতাশ হওয়ার ভাবটা আমাদের মজ্জাগত। তা না হলে আপনি ঠিকই দেখতে পাবেন কতদূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। অনেক পাপও সাফ হয়েছে এই দেশে। যেসব মানুষ রাজনীতির নামে এ দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করত, তারা তাদের প্রভু পাকিস্তানকে ভুলতে পারেনি। যারা ছলে বলে কৌশলে দেশকে আফগানিস্তান বানাতে চেয়েছিল, আজ তারা হতদ্যোম। তাদের অগ্রজেরা যারা আমাদের ভাই-বোন-মা-বাবাদের প্রাণ নিয়েছিল, ইজ্জত লুটেছিল, তাদের অনেকেই ঝুলে গেছে। এটা ইতিহাসের দায়। সময় মিটিয়েছে। এই দেশ তা এমনই, যখনই মনে হয় তার আর বোধ করি সময় নেই বা সে আর পারবে না তখনই রুখে দাঁড়ায়। এই মাটিও এমন, সহ্য করতে করতে এক সময় উঠে দাঁড়ায়। এমন আঘাত করে দুশমনের বাবারও সাধ্য নেই পাল্লা দেয় তার সঙ্গে। আজ যেসব তরুণ-তরুণী বা যৌবনের মানুষ এ দেশ নিয়ে নেগেটিভ ভাবেন তাদের কাছে বলি, প্রণত হও। আনত হও। নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখো তোমরা দেশকে কি দিচ্ছ? সে সব মানুষও তাদের কর্মের কাছে যাও যারা নিজেদের জীবন-যৌবন তুচ্ছ করে আমাদের একটি পরিচয় ভূমি দিয়ে গেছে। স্বাধীনতা কোন পুস্তকে, ইতিহাসে বা আকৃতিতে ধরে না। কোন দিবসেও তাকে বাঁধা যায় না। তার একটাই পরিচয়Ñ সে মুক্ত। সে অর্থে আমাদের আরও বহুদূর যেতে হবে। সে কারণে বাংলাদেশের ভেতরে-বাইরে বিশ্বাস, অবিশ্বাস আর বিভেদের জঞ্জাল সাফ করে যেদিন আমরা মুক্তকণ্ঠে জয় বাংলার জয় বলতে শিখব স্বাধীনতা সেদিনই তার জীবনকে নিরাপদ মনে করবে। জয় হোক বাংলাদেশের। তার অস্তিত্ব হোক অবিনাশী। হীনম্মন্যতার দিন শেষ। যা কিছু অর্জন তাকে সামনে নিয়ে এগুনো এখন অবশ্যই সম্ভব। আমরা পারিনি। পরাধীনতার রক্ত পারেনি। যারা মুক্ত দেশের প্রজন্ম তারা নিশ্চয়ই নিজেদের বড় ভাবতে শিখছে। কারণ এই ভাবনাটার নামই স্বাধীনতা। আর যারা বড় তারা সেভাবেই বড় হয়ে উঠেছে বিশ্বে। আজ আমরা বাংলাদেশের নামে গর্ব করে বাঁচতে পারি। আমরা সারা বিশ্বে বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, উই আর প্রাউড বাংলাদেশী। আমরাই মেড ইন বাংলাদেশ। [email protected]
×