ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীর সাংস্কৃতিক বাতিঘর

প্রকাশিত: ০৩:১৮, ২৭ মার্চ ২০১৭

বাঙালীর সাংস্কৃতিক বাতিঘর

একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন সাহস, সৃষ্টিশীলতা ও অঙ্গীকার পালনের ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে কিভাবে জাতির জীবনে আলোকবর্তিকা হয়ে উঠতে পারে তার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত ছায়ানট। প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত ও সাহিত্যচর্চায় ব্রতী থাকলেও কালে কালে সংগঠনটি হয়ে ওঠে বাঙালিত্বের চেতনা ও স্বপ্ন লালনকারী এক উজ্জীবনী অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। আমরা সদ্য পেরিয়ে এলাম মহান স্বাধীনতা দিবস। পক্ষকাল পেলেই বাঙালী পৌঁছে যাবে তার নববর্ষ উদ্যাপনের বর্ণিল উৎসবে। বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ বরণে নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয়ের মুহূর্তে রমনায় ছায়ানটের আকর্ষণীয় আয়োজন এখন ঐতিহ্যে পরিণত। এ বছর তার অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য এক আশাজাগানিয়া গৌরবের মাহেন্দ্রক্ষণ। পঞ্চাশ-পূর্তির আয়োজনটিও হবে বিশেষ বর্ণচ্ছটায় রঙিন। এ লক্ষ্যে পরিকল্পিত হয়েছে মাসব্যাপী নানা আয়োজন। ছায়ানটের ধারাবাহিক পথ পরিক্রমাটি ফিরে দেখা, সংস্কৃতির সঙ্কট ও সম্ভাবনা শীর্ষক আলোকপাতসহ বিবিধ আয়োজনের ভেতর দিয়ে সমকালীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিম-লটিকে বুঝে নেয়ার প্রয়াস থাকবে। আর পয়লা বৈশাখের বিশেষ আয়োজনে এবারের মূল থিম বা বিষয় : আনন্দ, বাঙালীর আত্মপরিচয়ের সন্ধান ও অসাম্প্রদায়িকতা। সব মিলিয়ে দেশের মানুষের মনে একটি ইতিবাচক সাংস্কৃতিক অভিঘাত জাগানোরই পরিকল্পনা। বহমান সংস্কৃতির স্রোতধারায় সংগঠন হলো প্রাণবন্ত গতিময় সাম্পানের মতো, যার পালে নব নব হাওয়ার পরশ লাগানোর জন্য চাই তার নবায়ন ও নবজাগরণ। ছায়ানট সে সম্পর্কে সচেতন বলেই কালে কালে এটি হয়ে উঠেছে জাতির সাংস্কৃতিক বাতিঘর। নতুন বছরের প্রথম প্রভাতে ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বর্তমান সভাপতি ড. সন্জীদা খাতুনের জাতির অভিভাবকসুলভ দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য আমাদের জন্য এক পরম প্রাপ্তি। সংস্কৃতিচর্চায় দেশীয় ঐতিহ্য ও প্রকৃতিমুখী হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৬১ সালে ছায়ানট প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়ে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালন করার ঐকান্তিক ইচ্ছায় পাকিস্তানী শাসনের প্রতিকূল পরিবেশে কিছু বাঙালী একত্র হয়েছিলেন নিজেদের সংস্কৃতির প্রধান ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবর্ষপূর্তির উৎসব করার জন্যে। তমসাচ্ছন্ন পাকিস্তানী যুগে কঠোর সামরিক শাসনের মধ্যেই স্বদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রভাবনা অবলম্বন করে ছায়ানট যাত্রা শুরু করে। চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্র সংসদকর্মী, বিজ্ঞানী, সমাজব্রতী নানা ক্ষেত্রের মানুষের সৃজনচর্চার মিলনমঞ্চ হয়ে ওঠে ছায়ানট এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় ব্যাপ্তি ও গভীরতা সাধনে পালন করে বিশিষ্ট ভূমিকা। সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা ও সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং সাংস্কৃতিক বিকৃতি ও সংস্কৃতিহীনতা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ছায়ানট বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে চলেছে। রমনায় ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির নৃশংস আঘাত হানার বিষয়টি বাঙালী স্মরণে রাখবে চিরকাল। ওই অপশক্তি যথার্থভাবেই সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র তথা প্রগতিবাদী মহাশক্তিকে শনাক্ত করতে পেরেছিল বলে তারা তাদের মোক্ষম আঘাতটি হেনেছিল বর্ষবরণের ওই আয়োজনে। এখনও সেই অপশক্তি অত্যন্ত সক্রিয়। একাত্তরে পরাজয়ের কষ্ট তাদের কিছুতেই ঘুচছে না। আবার একই সঙ্গে তাদের নেতাদের একে একে ফাঁসির মঞ্চে হারাতে হয়েছে বলে প্রতিশোধ গ্রহণে তারা মরিয়া। এই পরিস্থিতিতে ছায়ানটের মতো হৃদয়সংবেদী বুদ্ধিদীপ্ত সংগঠন আমাদের প্রয়োজন যার সাংগঠনিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে পড়বে; নতুন দিনের আশাবাদ জাগাবে এবং অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তির জোগান দেবে।
×