ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লে. কর্নেল মহিউদ্দিন সেরনিয়াবাত (অব)

মিথ্যাচারের কবলে স্বাধীনতার ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৩:১৬, ২৭ মার্চ ২০১৭

মিথ্যাচারের কবলে স্বাধীনতার ইতিহাস

১৯৭১ সালে ভয়াবহ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। গৌরবোজ্জ্বল এই স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে ১৯৯০-এর পূর্বে অর্থাৎ বিশ বছর কোন প্রশ্ন ওঠেনি। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার স্থপতিকে সপরিবারে হত্যার ৮১ দিন পর তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান গ্রহণ ও ছয় বছর দোর্দ- প্রতাপে দেশ শাসন করেন। এই ছয় বছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটি এদেশের মানুষের মুখে নেয়াও ছিল কার্যত নিষিদ্ধ ও বিপদ উভয়ই। রাষ্ট্রীয় সকল আচার-অনুষ্ঠান এবং পাঠ্যপুস্তক থেকে তাঁর নামটি মুছে ফেলা হয়। সভ্যতার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে খুনীদের বাংলাদেশ মিশনে পুনর্বাসন ও পদোন্নতি দেয়া হয়। এই সময়ে আইনের হাত থেকে খুনীদের রক্ষার উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধন করে কুখ্যাত ইনডেমনিটি বিল সংযোজন করা হয়েছিল। এমনকি দেশে এলে ওই হত্যাকারীরা জেনারেল জিয়ার সেনানিবাসের মইনুল রোডের বাসায় নিয়মিত আতিথেয়তা গ্রহণ করত। কিন্তু শহীদ জিয়া কর্তৃক নিয়োগ ও আনুকূল্যপ্রাপ্ত ইতিহাসবিদদের দ্বারা রচিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিল সমুজ্জ্বল এবং তিনিই ছিলেন স্বাধীনতার মহানায়ক। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে মৃদু কণ্ঠে এবং এখন অত্যন্ত আত্মবিশ^াসের সঙ্গে তাদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি শুরু করেছে। ফলে নতুন প্রজন্ম বিরক্ত, বিভ্রান্ত, তদপেক্ষা বিভক্ত। এই প্রজন্মের জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা পর্বটি খোলাশা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব- যারা স্বচক্ষে মুক্তিযুদ্ধের পুর্বাপর ঘটনা দেখেছি। ১৯৬৯ সালে আগরতলা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা থেকে বাঙালীরা শেখ মুজিবকে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ছাড়িয়ে আনলে তিনিই পাকিস্তানের বিশেষত পূর্বাঞ্চলের রাজনীতির অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক হয়ে যান। এই মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ভারতের সহযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিলেন। এরপর ১৯৭০-এর নির্বাচনে তিনিই এই দেশের মানুষের সাংবিধানিক ম্যান্ডেট লাভ করেন। নির্বাচনে বিজয় লাভের পরও ক্ষমতা হস্তান্তরে শাসকগোষ্ঠীর টালবাহানা শুরু হলে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৭ মার্চ ’৭১ তিনি সমগ্র জাতিকে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুকে মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতির আহ্বান জানান। ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পেছনে পূর্বাঞ্চলের সকল ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবা, সকল পেশা ও শ্রেণী, এমনকি সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও ইবিআরের লোকেরা ঐক্যবদ্ধ থাকে। ২৫ মার্চ তারিখে পাক-বাহিনী কর্তৃক বাঙালীরা আক্রান্ত হলে পূর্বে ধারণকৃত বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথমে বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে ঢাকায় প্রচার করা হয়। ওই রাতেই গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণা পিলখানায় ইপিআর ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জানিয়ে দেয়া হয়। উপরোক্ত দুটি মাধ্যম কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার এই খবর ২৬ ও ২৭ মার্চ ’৭১ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গণ-মাধ্যমসমূহে ফলাও করে প্রচার হয়। ২৬ মার্চ দুপুরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিব কর্তৃক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের কঠোর অবস্থান এবং সেজন্য তাঁকে কঠিন শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে প্রত্যয় ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এই ভাষণটি দীর্ঘ ৪৩/৪৪ বছর বিভিন্ন আর্কাইভে সংরক্ষিত থাকলেও গত প্রায় দুই বছর পূর্বে তা সরিয়ে নেয়া হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। এই প্রসঙ্গে ২৫ থেকে ৩০ মার্চ ১৯৭১-এ চট্টগ্রাম শহর ও সেনানিবাসে সংঘটিত ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ও সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তর না করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। বাঙালী নিরস্ত্র জনতাকে ধ্বংস করলে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালী সদস্যরা যে বসে থাকবে না সে ব্যাপারে শাসকগোষ্ঠী নিশ্চিত ছিল। ফলে ওই বাহিনীসমূহের বাঙালী সদস্যদের প্রথমে নিষ্ক্রিয় ও পরে নিশ্চিহ্ন করার মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটসমূহকে বিভিন্ন অজুহাতে সেনানিবাসের বাইরে পাঠান হয়। ২৫ মার্চ রাতে ৮ ইবিআরের পাঞ্জাবী অধিনায়ক লে. কর্নেল আঃ রশিদ জানজুয়ার নির্দেশে একই ইউনিটের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ অফিসার তৎকালীন মেজর জিয়া সৈন্যদল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র খালাশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। এর কিছুক্ষণ পরই সেনানিবাসের ইবিআরসিতে ঘুমন্ত অবস্থায় অন্তত এক হাজার বাঙালী তরুণকে (সবেমাত্র সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া) হত্যা করা হয়। ষোলো শহরে অবস্থানরত ৮ ইবিআরের প্রায় তিন শ’ বাঙালী সেনা এই সংবাদ জানতে পেরে উত্তেজিত হয়ে কোন নিয়ম-শৃঙ্খলার তোয়াক্কা না করে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে দেয় এবং তখনি সেনানিবাস আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। এমতাবস্থায় তৎকালীন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান নিজের জীবনের চিন্তা না করে জিপ নিয়ে বন্দর অভিমুখে ছুটতে থাকেন এবং আগ্রাবাদে মেজর জিয়ার সাক্ষাত পান। সম্পূর্ণ ঘটনা জেনে তিনি সদলবলে ইউনিটে ফেরত আসেন। ইতোমধ্যে বাঙালী সৈন্যরা ক্যাম্পে অবস্থানরত গুটিকয়েক অবাঙালী অফিসার, জওয়ানকেও আটক করে ফেলে। অফিসার জেসিওদের সঙ্গে পরামর্শ করে উত্তেজিত সৈন্যদলের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে ওই রাতেই মেজর জিয়া বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত জানালে বাঙালী সেনা ও অফিসাররা ‘জয় বাংলা’ সেøাগান তুলে উল্লাস প্রকাশ শুরু করে। ২৬ মার্চ ভোরে ৮ ইবিআর নিজেদের নিরাপত্তার জন্য প্রথমে কালুরঘাট ও পরে পটিয়ায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। ২৬ মার্চ সূর্যোদয়ের পূর্বে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান সর্বপ্রথম ঢাকা থেকে প্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার সংবাদটি চট্টগ্রাম বেতার/স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচার করেন। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে সারাদিন আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, বেলাল মোহাম্মদ, আব্দুল্লাহ ফারুক ও অন্যরা ওই ঘোষণা পাঠ করেন। ২৭ মার্চ আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ও বেতারকর্মী নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে পটিয়ায় ৮ ইবিআর ক্যাম্পে হাজির এবং একজন সেনা অফিসারকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করার অনুরোধ জানান। তাদের যুক্তি ছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাঙালী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের এই জনযুদ্ধে সম্পৃক্ত করা। তাদের অনুরোধে বাঙালী অফিসাররা রাজি এবং কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে উপস্থিত হন। জ্যেষ্ঠ অফিসার মেজর জিয়া সবাইকে অবাক করে দিয়ে অস্তিত্ব না থাকা সত্ত্বে প্রথমে নিজেকে বিপ্লবী সরকারের প্রধান হিসেবে দু’বার ঘোষণা দেয়া মাত্র সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়। সেখানে তখন উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতারা, বেতার কর্মচারী, এমনকি সেনা সহকর্মীরা এই মর্মে তাকে প্রশ্ন করেন যে, সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য, তার আত্মীয়স্বজন এবং সীমিত কিছু পরিচিত ব্যক্তি ব্যতীত মেজর জিয়াকে কে চেনে? তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজনৈতিক কিংবা জাতীয় সশস্ত্র যুদ্ধে বিজয়ী বিপ্লবী কোন নেতা নন। অতএব তার এই ঘোষণা জাতির মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াবে। যে জাতীয় ঐক্য বঙ্গবন্ধু সৃষ্টি করেছেন সেখানে ফাটল ধরতে পারে। এতক্ষণে মেজর জিয়া নিজের ভুল বুঝতে পেরে বিব্রতবোধ করেন। এরপর তিনি পুনরায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলে তা রেকর্ড এবং ৩০ মার্চ ’৭১ পর্যন্ত কয়েকবার প্রচার করা হয়। ৩০ মার্চ পাকবাহিনী বেতারকেন্দ্রে হামলা চালালে স্বাধীন বাংলা বেতারের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। মেজর জিয়ার এই ঘোষণা পাঠ নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিশাল ইতিহাসের পাতায় ক্ষুদ্র অংশ হলেও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু তার স্থলে ক্যাপ্টেন রফিক কিংবা ক্যাপ্টেন অলি অথবা তরুণ লে. মাহফুজ পাঠ করলেও একই ফলাফল হতো। এমনকি চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র সৃষ্টি না হলেও মুক্তিযুদ্ধকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারত না। কেননা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক ২৫ মার্চ রাতেই দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতা ঘোষণার এটিই সত্যিকারের ইতিহাস। মেজর জিয়ার ইমেজ বা তার অবদানকে খাটো করার কোন যোগ্যতা বা ধৃষ্টতা আমার নেই। বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত মেজর জিয়া মৃত্যু অবধি কখনও কোন লেখা বা বক্তব্যে নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। এমনকি ১৯৯১-এর পূর্বে বিএনপির নেতৃত্বও এমন বক্তব্য দেয়নি। যেহেতু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেই দলের প্রধান নেতা ছিলেন, তাই বিএনপি নেতৃত্ব তাদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানকে একটি নকল তকমা পরিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়। একটি রাজনৈতিক দলের দর্শন হওয়া উচিত জাতিকে সত্য ও সৎ পথে পরিচালনা করা। সেখানে বিএনপির মতো একটি বড় দলের কাছে মিথ্যা ইতিহাস কোনমতেই কাম্য নয়।
×