ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কলকাঠি নাড়ছে দেশী-বিদেশী চক্র

স্বাধীনতার মাসে জঙ্গীরা হঠাৎ মরিয়া

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৬ মার্চ ২০১৭

স্বাধীনতার মাসে জঙ্গীরা হঠাৎ মরিয়া

শংকর কুমার দে ॥ হঠাৎ করেই এবারের স্বাধীনতার মাসে জঙ্গীরা মরিয়া হয়ে একের পর এক আত্মঘাতী হামলা চালানোর চেষ্টা করছে। হামলার ধরন সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে জঙ্গীরা মরণ কামড় দেয়ার চেষ্টা করছে। গত ৬ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ১৯ দিনে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেটে অভিযানে ৭ আত্মঘাতী জঙ্গী নিহত ও ৬ আত্মঘাতী জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে। যার মধ্যে ২ জন নারী জঙ্গীও রয়েছে। আত্মঘাতী হামলার চেষ্টার পর পরই আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএসের নামে দায় স্বীকার করে বিবৃতি প্রকাশিত হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, এর সঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত। তারা বাংলাদেশকে জঙ্গী ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের কাছে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। উদ্দেশ্য ২০১৯ সালের ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাতে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আসতে না পারে। এমন নীল নক্সার অংশ হিসেবে দেশে একের পর জঙ্গী হামলা ও আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেশবাসীকে ভীত করার চেষ্টা চলছে। বিশ্বের অন্যতম একটি প্রভাবশালী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের চিরশত্রু দেশটি নেপথ্যে থেকে জামায়াত-শিবির ও যুদ্ধাপরাধীদের মাধ্যমে কলকাঠি নাড়ছে। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রায় ৩১ বছর ধরে দেশে জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের দোসরবিদেশী শক্তিগুলো। ১৯৯৯ সালে যশোরের উদীচী গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গী সংগঠন হুজি আত্মপ্রকাশ করে। এরপর ২০০৫ সালে দেশের ৬৩ জেলায় সিরিজ বোমা হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গী সংগঠনের তৎপরতা সামনে আসে। গত বছরের গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দায় স্বীকার করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে জঙ্গী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করার চক্রান্ত চলছে। পুলিশ সদর দফতর বলছে, গত ৩১ বছরে জঙ্গী হামলায় পাঁচ শতাধিক নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে সহস্রাধিক। হামলার মধ্যে ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা ছিল অন্যতম। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মামলাটির তদন্তে বেরিয়ে আসে মুফতি হান্নান, বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, বিএনপি নেতা তারেক রহমান, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার নাম। মুফতি হান্নানের সংগঠন হুজি পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ও পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবার ঘনিষ্ঠ হয়ে দেশে জঙ্গী তৎপরতা শুরু করে। আর এ ক্ষেত্রে বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ছিলেন সমন্বয়ক। এ পর্যন্ত জঙ্গী হামলার ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার। হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে দেশে জঙ্গীবাদ এক ভয়ঙ্কর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জঙ্গী হামলার ধরন, কৌশল, লক্ষ্যবস্তু, অস্ত্রের ধরন, প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটানো, আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটানোর মধ্য দিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনার সৃষ্টি করানো হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় একের পর এক ব্লগার, প্রকাশক, লেখক, পীর, সেবায়েত, ধর্মগুরু, পুরোহিতসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ হত্যা এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আত্মঘাতী হামলার চেষ্টা হয়। সর্বশেষ ২০১০ সালে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শুরা কমিটির সাবেক সদস্য জেএমবি আমীর মাওলানা সাইদুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর জেএমবির পুরনো ধারা ছেড়ে নব্য জেএমবি নামে সংগঠিত হয়। ২০১৪ সালে ভারতের বর্ধমানে জেএমবির বোমা তৈরির আস্তানায় বিস্ফোরণের পর বাংলাদেশ ও ভারতে আবার আলোচনায় আসে নব্য জেএমবি। নব্য জেএমবি আইএসের অনুসারী। সংগঠনটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের লক্ষ্যবস্তু করে কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর জঙ্গীবাদ দুই ধারায় ভাগ হয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। মুফতি মাওলানা জসিম উদ্দীন রাহমানী ও পলাতক মেজর জিয়ার অনসারীরা একের পর এক ব্লগার, লেখক, প্রকাশক হত্যা শুরু করে। নব্য জেএমবির গ্রুপটি হলি আর্টিজানসহ বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালায়। নব্য জেএমবির সদস্যরাই নিজেদের আইএসের লোক বলে দাবি করছে। আর তাদের মাধ্যমে সংঘটিত বিভিন্ন হামলার পরেই আইএসের নামে দায় স্বীকার করে বিবৃতি প্রকাশিত হচ্ছে। মূলত এর সবই হচ্ছে বাংলাদেশ থেকেই। আত্মগোপনে থাকা নব্য জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের জঙ্গীরাই এসব কর্মকা- চালাচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, সারাদেশে জঙ্গীবিরোধী অভিযান জোরদার হওয়ার মুখে যখন জঙ্গী সংগঠনগুলোর মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে জঙ্গীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সীমান্ত পথে দেশত্যাগ করছে। এমন পরিস্থিতি দেশের ভেতরে থাকা জঙ্গীরা আত্মঘাতী হামলা করে পলাতক জঙ্গীদের মনোবল চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করছে। তারই অংশ হিসেবে মুুফতি আবদুল হান্নানকে প্রিজনভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা হয়। ওই সময় ধরা পড়া এক জঙ্গী গ্রেফতার হয়। তারা আত্মঘাতী বলে পুলিশ জানায়। এমন ঘটনার পর পরই বান্দরবন থেকে ঢাকায় আসার পথে কুমিল্লায় পুলিশ চেকপোস্টে পুলিশের ওপর জঙ্গীরা হামলা চালায়। গ্রেফতার হয় দুই জঙ্গী। তারাও আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য। দুই জঙ্গীর তথ্যমতে চট্টগ্রামের সীতাকু-ে পর পর দুটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মিলে। সেখান থেকে গ্রেফতার হওয়া আত্মঘাতী জঙ্গী দম্পতির স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সীতাকু-ের ছায়া নীড়ে পুলিশের অভিযানে নিহত হয় চার জঙ্গী ও এক শিশু। যার মধ্যে একজন নারী জঙ্গীও রয়েছে। যারা সবাই আত্মঘাতী। এ ঘটনার পরের দিনই আশকোনায় র‌্যাবের অস্থায়ী ক্যাম্পে এক আত্মঘাতী জঙ্গী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। তারপরের দিন রাজধানীর খিলগাঁও র‌্যাবের চেকপোস্টে এক আত্মঘাতী জঙ্গীর হামলাকালে র‌্যাবের গুলিতে মারা যায়। গত শুক্রবার রাতে হযরত শাহ্জালাল বিমানবন্দরের সামনের রাস্তায় আরেক আত্মঘাতী জঙ্গী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিহত হয়। এরই মধ্যে সিলেটের শিববাড়ির আতিয়া মহল নামের এক জঙ্গী আস্তানায় ৩০ ঘণ্টা ধরে সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডোদের নেতৃত্বে অভিযান চলছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে রয়েছে পুলিশের সোয়াত, র‌্যাব, কাউন্টার টেররিজম ইউনিটসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
×