ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পাবনার বেড়ায় সদ্য নির্মিত দৃষ্টিনন্দন তিনটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য

বিজয় বাংলা, জ্যোতির্ময় আর ‘শেকড় থেকে শিখরে’

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ২৫ মার্চ ২০১৭

বিজয় বাংলা, জ্যোতির্ময় আর ‘শেকড় থেকে শিখরে’

আলাউল হোসেন, বেড়া, পাবনা, ২৪ মার্চ ॥ দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা পেলাম মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশ আর পেলাম এক মহানায়ককে। যিনি তার প্রজ্ঞা, চিন্তা-চেতনা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালী জাতিকে তুলে আনলেন ‘শেকড় থেকে শিখরে’। একাত্তরের মহান বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছেÑ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিভাস্কর্য। তেমনি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাবনার বেড়ায় তৈরি হয়েছে ‘শেকড় থেকে শিখরে’, ‘বিজয় বাংলা’ ও ‘জ্যোতির্ময়’ নামে তিনটি দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য ও শিল্পকর্ম। বেড়ার কৃতী সন্তান তরুণ চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর বিপ্লব দত্ত ভাস্কর্যগুলোর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন। শেকড় থেকে শিখরে ॥ বঙ্গবন্ধু ও বাংলার ইতিহাস কেন্দ্র করে পাবনার বেড়ায় ধোবাখোলা করোনেশন স্কুল এ্যান্ড কলেজের প্রধান ফটকের পাশে পাবনা-২ আসনের (বেড়া-সুজানগর) সংসদ সদস্য খন্দকার আজিজুল হক আরজুর পৃষ্ঠপোষকতায় সম্প্রতি নির্মিত ‘শেকড় থেকে শিখরে’ ভাস্কর্যটি অতীতের সব ভাস্কর্যের চেয়ে বৃহৎ ও ব্যতিক্রম। ১০ ফুট উচ্চতার কংক্রিটের স্তম্ভের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে ১৮ ফুট উচ্চতার বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য। এটি স্টেনলেস স্টিলের তৈরি। বাংলাদেশে স্টেনলেস স্টিলের তৈরি এটিই বঙ্গবন্ধুর সর্ববৃহৎ আবক্ষ ভাস্কর্য। এই আবক্ষ ভাস্কর্যের দু’পাশে রয়েছে তিনটি করে অতিরিক্ত স্তম্ভ। যাতে সিমেন্ট কেটে অঙ্কিত হয়েছে ’৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির উত্থান-পতন এবং উন্নয়নের ধারা। এছাড়া এ ভাস্কর্যের আরও একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য হলোÑ মূল ভাস্কর্যের এক পাশে ২৬টি কলামের একটি সীমানা বেষ্টনী, যার প্রত্যেকটি কলামে টাইলসে এনগ্রেভিং করা হয়েছে বাংলার ইতিহাস। সংক্ষিপ্ত আকারে এখানে লিপিবদ্ধ হয়েছেÑ সিরাজউদ্দৌলা থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও পঁচাত্তরে জাতির জনকের পরিবারের ঘৃণ্যতম হত্যাকা- পর্যন্ত সচিত্র ইতিহাস। বিজয় বাংলা ॥ বেড়ায় শহীদ আব্দুল খালেকের কবরের সামনে সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে আরেকটি দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিস্তম্ভ ‘বিজয় বাংলা’। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের স্মরণে বেড়া বিবি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে ব্যতিক্রমধর্মী এ স্মৃতিস্তম্ভটি বেড়া পৌর মেয়র আব্দুল বাতেনের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মাণ করেছেন তরুণ চিত্রশিল্পী বিপ্লব দত্ত। বেড়া ছাড়াও পার্শ্ববর্তী উপজেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা স্মৃতিস্তম্ভটি দেখতে প্রায় প্রতিদিন বিকেলে ভিড় জমায়। স্মৃতিস্তম্ভটিতে নান্দনিক সৌন্দর্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দেশের ইতিহাস। দেশের সব আন্দোলন-সংগ্রাম ও সাধারণ মানুষের উজ্জ্বল অংশগ্রহণের কথা তুলে ধরা হয়েছে এখানে। ’৫২ ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বাঙালীর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক এবং সর্বশেষে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে এখানে। সুন্দর এই স্মৃতিস্তম্ভটি দেখে শহীদদের অবদানের কথা স্মরণ করে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। এখানে শায়িত আছেন উপজেলার শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক। ২০১৫ সালে এ ভাস্কর্যের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ২০১৬ সালে এটি উদ্বোধন করা হয়। জ্যোতির্ময় ॥ বেড়া পৌরসভার সামনে নির্মিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি আবক্ষ ভাস্কর্য ‘জ্যোতির্ময়’। সাতকোনার ৫ ফুট উচ্চতার বেদির ওপরে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। এটির উচ্চতা আড়াই ফুট। ভাস্কর্যটি ব্রোঞ্জের তৈরি। বেদির সাতকোণে সাত বীরশ্রেষ্ঠর ছবি টাইলসের ওপর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে। ২০১২ সালের শেষদিকে এ ভাস্কর্যের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয় এবং ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এটি উদ্বোধন করা হয়। প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেড়া পৌর মেয়র আলহাজ আব্দুল বাতেন জানান, একাত্তরের মহান বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে আমি আমার নিজ খরচে শিল্পী বিপ্লব দত্তকে দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করেছি। নতুন প্রজন্ম এ সংগ্রাম দেখেনি। বই পড়ে, বড়দের কাছে গল্প শুনে মনের ভেতরে একটা আবছা ছবি তৈরি করেছে স্বাধীনতা নিয়ে। তাই বাংলার সঠিক ইতিহাস ও সংগ্রামের বিভিন্ন দিক বিশেষভাবে তুলে ধরতেই, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার চেতনাকে প্রবাহিত করতে আমি আমার সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে নিজের জন্মস্থান বেড়া এলাকায় তিনটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেছি। নিজের এলাকায় এ রকম কাজ করতে পেরে আমি নিজেও গর্ববোধ করি। স্থানীয়দের মতে, সুবিশাল পরিসরে নির্মিত ভাস্কর্যগুলো একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণ করিয়ে দেয়, তেমনি বাড়িয়ে দেয় ঐতিহ্যবাহী বেড়ার গৌরব। প্রতিদিন স্থানীয় বাসিন্দা, পথচারী ও হাজারো যাত্রী মুক্তিযুদ্ধের এ ভাস্কর্যগুলোর সামনে দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে বিস্ময়মুগ্ধ হয়ে দেখেন। শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও জাগরণের মধ্য দিয়ে মানুষ ভাস্কর্যগুলোর মাঝে বাংলাদেশকেই দেখতে পায়। যে দেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। বহুদূর থেকে দৃশ্যমান এ ভাস্কর্যগুলোর আবেদনও তাই বহুমাত্রিক।
×