ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আজ সাত বছর পূর্তি

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ এ পর্যন্ত ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, ১৭ আপীল নিষ্পত্তির অপেক্ষায়

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৫ মার্চ ২০১৭

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ এ পর্যন্ত ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, ১৭ আপীল নিষ্পত্তির অপেক্ষায়

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাত বছরপূর্তি আজ। এ সাত বছরে তদন্ত সংস্থা ৫৯৪টি অভিযোগের মধ্যে মাত্র ২১০ জনের বিরুদ্ধে ৭৬টি মামলা করেছে। এর মধ্যে ৪৯টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। আরও ২৬টি মামলার তদন্ত করছে। বর্তমানে তদন্ত সংস্থায় আরও ৩৫০২ জনের বিরুদ্ধে ৬৪৩টি অভিযোগ পড়ে আছে। এ সময়ে তদন্ত ধীরগতিতে চললেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সাফল্য বেশি। তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটররা বলেছেন, এ সাত বছরে বলতে গেলে অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো সাফল্য অর্জন করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে প্রমাণ করতে পেরেছি যে, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অদম্য সাহসী ও আপোসহীন। তবে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মৃত্যুদ-, আমৃত্যু কারাদ- ও তদন্তাধীন এমন মামলায় ৭৫ জন আসামি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিচারপ্রার্থী ও ভিকটিমরা এ ব্যাপারে হতাশ। আইন প্রয়োগকারী বাহিনী এ বিষয়ে আরও সতর্ক হলে সন্তুষ্ট হওয়া যেত। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। মামলার সংখ্যা বাড়াতে এবং দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ২০১২ সালের ২২ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। তারকাখচিত আসামিদের বিচার শেষে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা দুটি থেকে একটিতে রাখা হয়েছে। মামলার সংখ্যা পরবর্তীতে বাড়লে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানো হবে। সাত বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বানচাল করার দেশী-বিদেশী প্রপাগান্ডা সত্ত্বেও দেশীয় আইনে বিচারের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ২৭টি মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এসব মামলায় ৫৩ জন আসামি ছিল। দ- দেয়া হয়েছে ৫১ জনকে। দুজন আসামি সোলায়মান মোল্লা ও আব্দুল লতিফ রায় ঘোষণার আগেই মারা যায়। এ ৫১ জনের মধ্যে ২৮ জনকে মৃত্যুদ-, ২০ জনকে আমৃত্যু কারাদ-, একজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান ও একজনকে ৯০ বছরের দ- প্রদান করা হয়। দ-প্রাপ্ত ও তদন্তাধীন মোট ৭৫ জন আসামি পলাতক রয়েছে। অন্যদিকে কিশোরগঞ্জের দুই রাজাকার সৈয়দ মোঃ হোসাইন (৫৪) ও মোঃ মোসলেম প্রধানের (৬৬) মামলার উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার জন্য সিএভি ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ যে কোন দিন এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে আরও ২৯টি মামলায় ১৩২ জন রাজাকারের অপরাধ বিভিন্ন পর্যায়ে বিচারাধীন। এর মধ্যে একটি রায় ঘোষণার অপেক্ষায় ও অন্যগুলো সাক্ষ্যগ্রহণ ও চার্জ গঠনের জন্য রয়েছে। তদন্ত সংস্থা প্রথম থেকে এ পর্যন্ত (তদন্তাধীন ২৭টিসহ) ৭৬টি মামলায় ২১০ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা এখন পর্যন্ত ৪৯টি মামলার তদন্ত সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে ৬৪৩টি অভিযোগে মোট ৩৫০২ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত মুলতবি রয়েছে। তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, এ ৬৪৩টি অভিযোগ থেকে পর্যায়ক্রমে মামলা তদন্ত করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদ-প্রাপ্তরা ওই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করেছে। আর যারা পলাতক তারা আপীল করেনি। তাদের দ- বহালই রয়েছে। বিচারাধীন ও তদন্তাধীন মামলায় বর্তমানে ৭৫ জন আসামি পলাতক রয়েছে। আপীল বিভাগে সাতটি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। আর আপীলে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে ১৭টি মামলা। এর সাতটি রায়ের মধ্যে ছয়টিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ও জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপীল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদ- দেয়া হয়েছে। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর দুই পক্ষেই রিভিউ আবেদন করেছে। শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াতের আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপীলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। অন্যদিকে আপীল বিভাগে আরও ১৭ জনের মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা, প্রসিকিউশন ও সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। এদিকে প্রায় অর্ধশতাব্দী আগের ঘটনার মামলার বাদী, আসামি ও সাক্ষীরা স্বাভাবিক মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাই দ্রুত এসব অভিযোগ বা মামলা নিষ্পত্তি করা না গেলে অনেকেই বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। তাই যত দ্রুত সম্ভব এসব অভিযোগ নিষ্পত্তি করে অভিযুক্ত আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা সাত বছরে মোট ৭৬টি মামলা করেছি। এর মধ্যে ৪৯টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছি। আরও ২৬টি মামলার তদন্ত চলছে। পৃথিবীর অন্যান্য ট্রাইব্যুনালের চেয়ে আমাদের তদন্তকে সফল বলে মনে করি। এছাড়া যেসব অভিযোগ জমা পড়ে আছে তা গুরুত্ব অনুসারে যাচাই-বাছাই করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করতে চাই। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা যায় না। একটি ট্রাইব্যুনালে বিচার দ্রুত শেষ করা যায় না। ট্রাইব্যুনাল ছিল দুটো। যেটা নিষ্ক্রিয় রয়েছে সেটা সচল করা হোক। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক জনকণ্ঠকে বলেছেন, সাত বছরে আমাদের অর্জন বলতে হলে প্রথমেই বলতে হয়, পুরনো মামলা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। এতে সাকসেসফুল হয়েছি। সেজন্য সন্তুষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের পর এ বিশাল কর্মকা-টি পালন করতে পেরেছি। অন্যদিকে আবার আক্ষেপও হয়। ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ-, আমৃত্যু কারাদ- ও তদন্তাধীন মামলার প্রায় ৭৫ জন আসামি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিচারপ্রার্থী ও ভিকটিমগণ এ ব্যাপারে হতাশ। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তামিল করার দায়িত্ব। তারা যদি আরও সচেতন হয় তাহলে আরও খুশি হব। উল্লেখ্য, মৃত্যুদ-, আমৃত্যু কারাদ- ও তদন্তাধীন এমন মামলায় ৭৫ জন আসামি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ১২ জন, আমৃত্যু দ-প্রাপ্ত নয়জন, বিচারাধীন ৫১ জন ও তদন্তাধীন তিনজন।
×