ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যবসায়ীদের কারসাজি ॥ ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থির

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৫ মার্চ ২০১৭

ব্যবসায়ীদের কারসাজি ॥ ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থির

এম শাহজাহান ॥ রোজা সামনে রেখে ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠছে। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরও ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে সেই সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা। গত কয়েক মাসে প্রতিকেজি মোটা চালের দাম বেড়েছে ৮-১০ টাকা। সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, মাছ উৎপাদনে চতুর্থ এবং চাহিদা মতো দেশে পোলট্রি মুরগি ও গরু উৎপাদন হলেও ভোক্তাকে এসব পণ্য অতিরিক্ত দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় গড়ে ৬০-৬৫ টাকার নিচে কোন সবজি পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিকেজি চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৬০০-১২০০ টাকায়। বৈশাখ সামনে রেখে ইতোমধ্যে নাগালের বাইরে চলে গেছে ইলিশ মাছের দাম। প্রতিকেজি গরু ৫০০-৫৫০ এবং খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৭৫০ টাকায়। আমিষের শেষ ভরসা ব্রয়লার মুরগি পেতে ১৬০-১৬৫ টাকা গুনতে হচ্ছে ভোক্তাকে। গরুর মাংসের দাম না কমলে অদূর ভবিষ্যতে ব্রয়লার মুরগির বাজারে অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই বাস্তবতায় ভোক্তাদের স্বস্তি নেই বাজারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের ত্রুটির কারণে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরও ভোক্তাদের পণ্যমূল্য নিয়ে কষ্ট করতে হচ্ছে। এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অনিয়মিত বাজার মনিটরিং, বাজার সিন্ডিকেট ও কারসাজিকারকদের চিহ্নিত করাসহ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় দিন দিন ভোগ্যপণ্যের বাজারে সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। এর মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। আর পকেট ভারি হচ্ছে সিন্ডিকেট চক্রের। বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে যেসব আইন-কানুন দেশে রয়েছে তাও কার্যকর হচ্ছে না। টিসিবির তথ্যমতে গত এক বছরে চালের দাম বেড়েছে ১৬ শতাংশ, ভোজ্যতেল ১৩, গরু ২৬, খাসি ৩২, ছোলা ১৮, চিনি, ৩১, লবণ ১৭, ব্রয়লার মুরগি ১০, এবং রসুন দেশী ২১ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে। শুধু পেঁয়াজে ১২ শতাংশ পর্যন্ত দাম কমেছে। এছাড়া একই পণ্য রাজধানীর বাজার ভেদে বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। যেন দেখার কেউ নেই। গত এক বছরে ভোগ্যপণ্যের বাজারে যেসব জিনিসের দাম সবেচেয়ে বেশি বেড়েছে তা হলো মোটা চাল, গরু ও খাসির মাংস। পাইজাম, স্বর্ণা, লতা ও ইরি জাতীয় প্রতিকেজি মোটা চাল এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩৮-৪০ টাকায়। অথচ গত এক বছর আগে এসব চাল ৩০-৩২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এরপর সবচেয়ে বেশি বেড়ে গেছে গরু ও খাসির মাংসের দাম। ২০১৬ সালের প্রথমদিকে প্রতিকেজি গরুর মাংস ৩৮০-৪০০ এবং ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। সেখানে সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও কৃষি বিপণন অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাজারভেদে বর্তমানে প্রতিকেজি গরুর মাংস ৪৮০-৫০০ এবং প্রতিকেজি খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৭৫০ টাকায়। শুধু তাই নয়, গরু ও খাসির মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ ভোক্তারা ব্রয়লার মুরগি খাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছে। এই কারণে বাজারে বেড়ে যাচ্ছে ব্রয়লার মুরগির দাম। এসব পণ্যের বাইরেও ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল এবং ছোলা বিক্রি হচ্ছে অতিরিক্ত দামে। দাম কমাতে দু’দফায় আড়াই লাখ টন লবণ আমদানি হলেও ভোক্তারা দাম কমার কোন সুফল পায়নি। প্রতিকেজি প্যাকেট লবণ এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪২ টাকায়। রোজা সামনে রেখে আবার তৎপরতা শুরু হয়েছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চক্রের। যিনি ভোজ্যতেল ও চিনি কারবার করছেন, তিনি এখন থেকেই এসব পণ্যের দাম বাড়াতে কারসাজি শুরু করেছেন। একইভাবে চাল, মাছ, মাংস, মসলা ও সবজি বিক্রেতা যে যার মতো দাম বাড়িয়ে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াতে বাজারে কোন নজরদারি নেই। গত কয়েক মাসের আমদানি পরিস্থিতি ও এলসি খোলার পরিসংখ্যান বলছে দেশে কোন পণ্যের ঘাটতি নেই। রোজায় কোন পণ্যের সঙ্কট থাকবে না। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শুভাশিষ বোস দাম বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করে জনকণ্ঠকে বলেন, কিছু পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। তবে রোজায় যেসব আইটেম ব্যবহার হয়, সেদিকে সরকারের নজর রয়েছে। তিনি বলেন, চাল কৃষি মন্ত্রণালয়, চিনি শিল্পমন্ত্রণালয় আবার মাছ ও মাংস নিয়ে মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। তবে চিনির দাম বেশি বেড়ে গেলে আমদানির উপর যে শুল্ক ধার্য করা হয়েছে তা প্রত্যাহার করা হতে পারে। রোজার সময় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। চালের দাম কিছুটা বাড়লেও আর বাড়বে না। এছাড়া অন্যান্য পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন, ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়া নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম কমছে। এছাড়া দেশীয় উৎপাদন ভাল হওয়ার পাশাপাশি আমদানির পরিমাণও বেড়েছে। অস্থির চালের বাজার ॥ কোনভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না চালের মূল্য বৃদ্ধির লাগাম। প্রতিকেজি সরু চাল ৪৬-৫৬, মাঝারি মানের ৪৪-৪৬ এবং মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৮-৪০ টাকা। গত বছরের পুরো সময় দেশের মানুষকে চড়া দামেই চাল কিনে খেতে হয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকেও সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। মাঝে আমন ধান ওঠার সময় চালের দাম কিছুটা কমলেও আবারও বেড়েছে। এখন একেবারে চালকল বা খামার পর্যায়ে থেকে শুরু করে পাইকারি-খুচরা সব পর্যায়েই বেড়েছে চালের দাম। মিল পর্যায়ে বেড়েছে বস্তাপ্রতি ৫০ টাকা। পাইকারী পর্যায়ে বেড়েছে ১০০ টাকা, আর খুচরা পর্যায়ে কেজিপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ৩ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত। এভাবে চালের দাম বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। কিন্তু চালের দাম কেন বাড়ছে, তার সঠিক কোন কারণ বলতে পারছেন না কেউ। তবে অনুসন্ধানে যানা গেছে, চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে মূল কলকাঠি নাড়েন চালকল মালিকরা। কারণ কৃষকের ঘর থেকে ধান চলে যাওয়ার পর ফড়িয়াদের মাধ্যমে সেগুলো যায় মিল মালিকদের হাতে। বাজারের অধিকাংশ ধান মিল মালিকদের হাতে যাওয়ার পর মিল মালিকরা সেগুলো গুদামজাত করে রেখে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে। এতে ধানের দাম বেড়ে যায়। আর ধানের দাম বাড়ানোর পর তারা চালের দামও বাড়ায়। মিল পর্যায়ে দাম বাড়ার পর পাইকারী থেকে খুচরা পর্যায়ে আসতে যত হাত বদল হয় ততবার দাম বাড়ে। মূলত এভাবেই চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে। কাওরান বাজারের চাল বিক্রেতা হানিফ জানালেন, পাইকারী বেশি হওয়ার কারণে খুচরা বাজারে দাম বেড়ে যাচ্ছে। রাজধানীর পাইকারী ও খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পাইকারী বাজারে নিম্নমানের নাজিরশাইল চালের বস্তা ২৪৫০ টাকার বদলে ২৫৫০ টাকা হয়েছে। আর খুচরা বাজারে ৫০ টাকার নিম্নমানের নাজিরশাইল ৫৩ টাকা হয়েছে। এছাড়া খুচরা বাজারে স্বর্ণা চাল ৪৩-৪৪ টাকা, পারিজা চাল ৪৪-৪৫ টাকা, উন্নত মানের মিনিকেট ভাল ৫৪-৫৬ টাকা, বিআর আটাশ চাল ৪২-৪৪ টাকা, উন্নতমানের নাজিরশাইল চাল ৫৫-৫৬ টাকা, বাসমতি চাল ৫৮-৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ রাজধানীর পাইকারী বাজারে গত এক মাসের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি গড়ে চালের দাম বেড়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। আর খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি বেড়েছে ৩ থেকে ৪ টাকা। সবজিসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে ॥ শীত মৌসুম শেষ না হতেই রাজধানীর বাজারে বেড়েছে সব ধরনের সবজির দাম। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত। সবজির দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে তার সঠিক কোন জবাবও নেই সবজি বিক্রেতাদের। বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শীত মৌসুমের শুরুর দিকে নিত্য প্রয়োজনীয় কাঁচা পণ্যের দাম কিছুটা বেড়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, শীতের নতুন সবজি, তাই দাম বাড়ছে। এরপর শীতের মাঝামাঝিতে প্রায় সব ধরনের শীতকালীন সবজির দাম বাড়ানো হয়েছিল। সে সময়ে পরিবহন ব্যয় এবং যোগান স্বল্পতার কথা বলেছিলেন ব্যবসায়ীরা। আর শীতের শেষ দিকে আবার দাম বাড়ানো হয়েছিল। সে সময়ে বলা হয়েছে, শীত মৌসুম শেষের দিকে হওয়ায় সব সবজির যোগান কিছুটা কমেছে, তাই বেড়েছে দাম। শীতের শুরু, মাঝামাঝি এবং শেষদিকে বিভিন্ন অজুহাতে তিন দফায় সবজির দাম বাড়ানো হলেও পরবর্তীতে সে দাম আর কমানো হয়নি। গত সপ্তাহেও বাড়তি দামেই বিক্রি হয়েছে প্রায় সব ধরনের সবজি। এরপর সপ্তাহের ব্যবধানে গতকাল শুক্রবারের বাজারে সবজির দাম আবারও বাড়ানো হয়েছে। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল বাজারসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, সব ধরনের সবজির দাম ৫ টাকা থেকে ২০ টাকা হারে বেড়েছে। এছাড়া কেজিপ্রতি কাঁচা মরিচের দাম বেড়েছে ২০ টাকা। গত সপ্তাহে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হওয়া কাঁচা মরিচ আজকের বাজারে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
×