ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৫০ বছরে পা দিচ্ছে এবার রমনা বটমূলে বর্ষবরণ

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৫ মার্চ ২০১৭

৫০ বছরে পা দিচ্ছে এবার রমনা বটমূলে বর্ষবরণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শুরুটা সেই ১৯৬৭ সালে। বৈরী পরিবেশে পাকি সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রমনা বটমূলে বাংলা নববর্ষ উদ্্যাপন করেছিল ছায়ানট। আপন সংস্কৃতির আশ্রয়ে ঘটেছিল বাঙালী স্বতন্ত্র জাতিসত্তার প্রকাশ। ১৯৬১ সালে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানটির এ বছরের বর্ষবরণের প্রভাতী সঙ্গীতানুষ্ঠানটি পদার্পণ করবে ৫০ বছরে। নববর্ষ উদ্্যাপনের ৫০ বছর উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে ছায়ানট। আগামী চৌদ্দই এপ্রিল পহেলা বৈশাখে রমনার আয়োজন ছাড়াও ছায়ানট ভবনে থাকবে একাধিক অনুষ্ঠান। দেশব্যাপী জেগে ওঠা উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী প্রকাশে ১৪২৪ বঙ্গাব্দ উদ্যাপনের নির্ধারিত বিষয় হচ্ছে ‘আনন্দ, বাঙালীর আত্মপরিচয়ের সন্ধান ও অসাম্প্রদায়িকতা’। এবারের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের বিশেষ সংযোজন হিসেবে পরিবেশিত হবে পালাগান। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ আয়োজনের ৫০ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে শুক্রবার বিকেলে প্রতিষ্ঠানটির ধানম-ির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা। এতে ছায়ানটের বর্ষবরণের ৫০ বছরের বিশেষ অনুষ্ঠানমালার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা। ছায়ানট সভাপতি সন্্জীদা খাতুনের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী ও সহ-সভাপতি খায়রুল আনাম শাকিল। পঞ্চাশ বছরের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্পর্কে জানানো হয়, বাংলা নতুন বছর ১৪২৪ বঙ্গাব্দের প্রভাতী অনুষ্ঠানের সূচনা হবে ভোর ৬টা ১০ মিনিটে। সরোদে ভোরের রাগালাপ দিয়ে নতুন বাংলা বছরের আবাহন শুরু হবে। এবারের আয়োজনের বিষয় হচ্ছে ‘আনন্দ, বাঙালীর আত্মপরিচয়ের সন্ধান ও অসাম্প্রদায়িকতা’। সব মিলিয়ে চলবে দুই ঘণ্টার গান ও পাঠাবৃত্তির আয়োজন। এ পর্ব শেষে থাকবে ছায়ানট সভাপতি সন্্জীদা খাতুনের শুভেচ্ছা কথন। এরপর কিছুক্ষণের বিরতি দিয়ে ৫০ বছর পূর্তির বিশেষ আয়োজনের অংশ হিসেবে পরিবেশিত হবে বাংলার আবহমান লোক সংস্কৃতির পালাগান ‘দিওয়ানা মদিনা’। প্রায় মাসব্যাপী এবারের আয়োজনে অংশ নিচ্ছে প্রায় চার শ’ শিল্পী। বটমূলে প্রভাতি বর্ষরণের এবারের আয়োজনে শব্দ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করবে ব্লুজ কমিউনিকেশন। বরাবরের মতো এবারও অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার। এছাড়া বর্ষবরণের অনুষ্ঠানটি সরাসরি দেখা যাবে ছায়ানটের ওয়েবসাইটে। ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানমালার দ্বিতীয় আয়োজনটি অনুষ্ঠিত হবে ছায়ানট ভবনে ৩১ মার্চ সন্ধ্যা ছয়টায়। ভবনটি সাজানো হবে নববর্ষ উদ্্যাপন অভিযাত্রার স্মারণিক প্রদর্শনী দিয়ে। একই সঙ্গে মিলনায়তনে শুরু হবে নৃত্য, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, পাঠাবৃত্তি ও গানে সজ্জিত অনুষ্ঠান। ৭ এপ্রিল বিকেল ৫টায় শুরু হবে তৃতীয় আয়োজনটি। ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্মরণিকা ও ১৪২৪ বঙ্গাব্দের বিশেষ বর্ষপঞ্জি প্রকাশ করার পাশাপাশি এদিন অনুষ্ঠিত হবে সেমিনার ও সঙ্গীতানুষ্ঠান। ‘সংস্কৃতি সঙ্কট ও সম্ভাবনা’ বিশেষ বক্তব্য উপস্থাপন করবেন মফিদুল হক। আলোচনায় অংশ নেবেন আতিউর রহমান ও মাহফুজ আনাম। সভাপতিত্ব করবেন সন্্জীদা খাতুন। চতুর্থ অনুষ্ঠানটি হবে চৈত্র সংক্রান্তির দিন ১৩ এপ্রিল। সন্ধ্যা ৬টায় সূচনা হওয়া এ অনুষ্ঠানে ২০০১ সালের বটমূলে নববর্ষ অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় নিহত নিরীহ দর্শক-শ্রোতাদের স্মরণ করা হবে কথা, গান ও প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে। সংবাদ সম্মেলনের আগে ছায়ানটের শিক্ষার্থীরা সম্মেলক কণ্ঠে গেয়ে শোনায় ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও’ ও ‘মানুষ হ, মানুষ হ’ শিরোনামের দুটির গান। সভাপতির বক্তব্যে সন্্জীদা খাতুন বলেন, এই দুটি গান আমাদের ইতিহাসের অঙ্গ। ১৯৬৭ সালে বর্ষবরণের প্রথম আয়োজনটিতেও আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায়’ গানটি গেয়েছিলাম। সে দিন গানের মাধ্যমে আমরা মনের মধ্যে জমে থাকা ময়লা ও আবর্জনার দূর করার কথা বলেছিলাম। অবিকশিত হওয়া বোধটাকে বিকশিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম। সেই সময় পাকিস্তান সরকার আমাদের বাঙালীত্বের পরিচয় প্রকাশের যে কোন আয়োজনেরই বিরোধিতা করেছে। সে দিন আমরা সুরের আশ্রয়ে নীরব দ্রোহ করেছি। বাঙালী সংস্কৃতির স্বাধিকারকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছি। সেই স্বাধিকার বোধের চেতনার কারণেই একসময় স্বাধীনতা এসেছে। সরাসরি মুখে স্বাধীনতার কথা না বললেও সবাই ঠিকই বুঝেছে, আমরা কি বলতে চেয়েছি। সেই সময়কার অনুষ্ঠানে সবাই যে খুব মনোযোগ দিয়ে গান শুনতেন, তেমন নয়। তবে বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে পরস্পরকে অভিনন্দন জানানোর ক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছিল। সে সময় পরস্পরস্পরকে ‘শুভ নববর্ষ’ বলার মধ্যেই একটা বিশেষ তাৎপর্য নিহিত ছিল। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও জাতি গঠনে সংস্কৃতি গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। সেই সূত্রে আমাদের আলাদাভাবে স্বল্প পরিসরে ছায়ানটকে সীমাবদ্ধ না রেখে এটিকে সরকারীভাবে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে আমরা স্বাধীন থেকে নিজেদের বক্তব্যকে প্রচার করে গেছি নিরন্তর। যদিও জানি শুধু মঞ্চে গান করে মানুষকে জাগানো সম্ভব হবে না। এমনটা হলে রমনা বটমূলের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হতো না। তাই মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদকে রুখতে হলে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। ছায়ানটের একার পক্ষে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব নয়। আমাদের কাযক্রম হচ্ছে নগরকেন্দ্রিক। সবাই মিলে যেতে হবে গ্রামের মানুষের কাছে। আপন সংস্কৃতির আলোয় লড়াই করতে হবে সেই সব ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে, যারা কি না বাঙালীত্বের চেয়ে মুসলমানিত্বকে বড় করে দেখে। তাই সবার মধ্যে সম্প্রীতির চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে না পারলে আমরা কখনই সফল হব না। সারওয়ার আলী বলেন, আজ থেকে ৫০ বছর আগে ১৯৬৭ সালে যখন আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসে তখন কিছু সাহসী মানুষ রমনা বটমূলে নববর্ষ উদ্্যাপন করেছিল। এখন ছায়ানটের বাইরে সারা দেশব্যাপী উদ্্যাপিত হয় বাংলা নববর্ষ। অন্তত এক দিনের জন্য হলেও বাঙালী খুঁজে পায় আপন জাতিসত্তাকে। আর এটাই হচ্ছে ছায়ানটের অর্জন। লাইসা আহমদ লিসা বলেন, ‘কায়মনে বাঙালী’ হওয়ার শপথে পাঁচ দশক আগে ছায়ানট বাংলা নববর্ষ ছায়ানট উদ্্যাপনের প্রয়াস নিয়েছিল। রমনা বটমূলের এই প্রভাতি সঙ্গীতায়োজনটি আপামর বাঙালীকে প্রাণিত করেছে। বটমূল ছাড়িয়ে দেশের গ-ি পেরিয়ে বাংলা নববর্ষ আজ বিশ্বময় বাঙালীর সবচেয়ে বড় মিলনমেলা ও জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। সংবাদ সম্মেলন শেষে পুনরায় শুরু হয় সঙ্গীতানুষ্ঠান। সত্যম কুমার দেবনাথ গেয়ে শোনান ‘বাসন্তী হে ভুবন মোহিনী’ ও ‘হেরি তব বিমল মুখভাতি’। ছায়ানট শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে গীত হয় ‘আপন কাজে অচল হলে’। সেঁজুতি বড়ুয়া গেয়ে শোনান ‘কত অজানারে জানাইলে তুমি’। নাঈমা ইসলাম নাজের কণ্ঠে গীত হয় ‘আমি শুধু রইনু বাঁকি ও ‘দাঁড়ায়ে আছ তুমি আমার’। এছাড়াও একক কণ্ঠে গান শোনান মোহিত খান ও আবুল কালাম আজাদ। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে শেষ হয় অনুষ্ঠান।
×