ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এক আত্মঘাতী গ্রেফতার

সিলেটে জঙ্গী আস্তানা থেকে গ্রেনেড হামলা

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৫ মার্চ ২০১৭

সিলেটে জঙ্গী আস্তানা  থেকে গ্রেনেড হামলা

গাফফার খান চৌধুরী/সালাম মাশরুর ॥ সিলেটে জঙ্গী আস্তানা থেকে পুলিশের ওপর গ্রেনেড হামলা হয়েছে। তবে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী সোয়াট দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় এক পুরুষ আত্মঘাতী জঙ্গীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। সিলেটে জঙ্গী আস্তানায় পুলিশ ও র‌্যাবের চালানো অভিযানে সহযোগিতা করতে সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডোদের একটি দল সেখানে অবস্থান করছে। সিলেটে জঙ্গী আস্তানা থেকে হামলার রেশ কাটতে না কাটতেই ঢাকায় পুলিশ চেকপোস্টে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলার চেষ্টা হয়েছে। হামলাকালে গ্রেনেড বিস্ফোরণে ওই জঙ্গীর মৃত্যু হয়েছে। রাত আটটায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিহত আত্মঘাতী জঙ্গীর পরিচয় মেলেনি। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই বাড়িটি ঘিরে রেখেছে পুলিশ। কয়েক দফায় পুলিশের সঙ্গে জঙ্গীদের কথা হয়েছে। জঙ্গীরা পুলিশকে দ্রুত সোয়াট পাঠানোর কথা জানায়। কথাবার্তার এক পর্যায়ে রাত তিনটার দিকে পুলিশ আস্তানার ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় আস্তানা থেকে আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা করে জঙ্গীরা। ভেতরে থাকা জঙ্গীরা আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য বলে পুলিশ অনেকটাই নিশ্চিত। অপারেশনে মারাত্মক ঘটনা এড়াতে ঢাকা থেকে আমেরিকায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী সোয়াট সিলেটে গিয়ে অভিযানে অংশ নিয়েছে। আস্তানা ঘিরে শত শত উৎসুক জনতা ভিড় করেছেন। পুলিশ আস্তানার আশপাশের সব রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। বৃহস্পতিবার সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায় আতিয়া মহল নামের পাঁচতলা ওই বাড়িতে জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। পাঁচতলা ওই ভবনের দুটি ইউনিটে ৩০টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর মধ্যে নিচতলার একটি বাসায় জঙ্গীদের আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। বাড়িতে প্রথমে অভিযান চালাতে গিয়ে ব্যর্থ হয় পুলিশ। এরপর থেকেই আস্তানায় থাকা জঙ্গীদের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিল পুলিশের কর্মকর্তারা। কথাবার্তার একপর্যায়ে বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে পাঁচতলা ওই ভবনে ঢোকার চেষ্টা করে পুলিশ। এ সময় আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে ভেতর থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা করে জঙ্গীরা। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। পুলিশ এ সময় অভিযান সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করে। তবে পুরো এলাকা ঘিরে রাখে। সকালে ওই বাড়ি থেকে থেমে থেমে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। এরপর ওই বাড়িতে যাওয়ার দুটি সড়কে চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। বাড়িটির আশপাশে থাকা সব বাড়িতে অবস্থান নেয় পুলিশ ও র‌্যাব। অনেকেই কৌশলে সরে অন্যত্র চলে যান। বাড়িটির অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা আটকা পড়েছিলেন। তাদের পুলিশের তরফ থেকে হ্যান্ডমাইক দিয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে ভেতরে নিরাপদে থাকতে পরামর্শ দেয়া হয়। পুলিশ বাড়ি থেকে ৭০ জনকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়েছে। তাদের পার্শ্ববর্তী জহির-তাহির মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ে রাখা হয়েছে। বাড়িতে আটকা থাকা অন্যদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। বাড়ির মালিক উস্তার আলী জানান, তিন মাস আগে কাউছার আলী ও মর্জিনা বেগম নামে দুইজন স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে দ্বিতীয় ইউনিটের নিচতলার চার নম্বর বাসাটি ভাড়া নেন। সে সময় কাউছার নিজেকে প্রাণ কোম্পানির অডিট অফিসার হিসেবে পরিচয় দেন। আমদানি-রফতানি ব্যবসায় জড়িত বাড়ির মালিক জানান, সব নিয়ম মেনেই তাদের বাসা ভাড়া দেয়া হয়েছে। দুজনের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপিও রাখা হয়েছে। তারা নিয়মিত ভাড়াও দিয়ে আসছে। সকাল থেকে হ্যান্ডমাইকযোগে জঙ্গীদের সঙ্গে পুলিশের কথাবার্তা চলছিল। দুপুর দেড়টার দিকে পুলিশ জঙ্গীদের উদ্দেশে হ্যান্ডমাইকে বলেন, আপনারা মুসলমান, আমরাও মুসলমান। আপনাদের কোন বক্তব্য থাকলে বাইরে এসে মিডিয়ার সামনে বলেন। এ সময় জঙ্গী আস্তানার জানালা ফাঁক করে এক নারী পুলিশকে বলেন, আপনারা শয়তানের পথে, আমরা আল্লাহর পথে। এর পরপরই আরেক এক পুরুষ জঙ্গী পুলিশের উদ্দেশে বলে, দেরি করছ কেন? আমাদের সময় কম। তাড়াতাড়ি সোয়াট পাঠাও। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে অতিরিক্ত উপকমিশনার আশিকুর রহমানের নেতৃত্বে সোয়াট ও পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এরপর শুরু হয় চূড়ান্ত অভিযান। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার আবদুল মান্নান জানান, সিলেটে জঙ্গী আস্তানা থাকার তথ্য পাওয়ার পর তাদের সদস্যরা সিলেট পুলিশকে নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অনুসন্ধান চালাচ্ছিল। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার রাতে শিববাড়ির ওই ভবনের সন্ধান পান তারা। ওই বাড়িতে প্রবেশ করতে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা হয়। এদিকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে জঙ্গী আস্তানা থেকে হাতকড়া ও হেলমেট পরিহিত অবস্থায় এক যুবককে বের করেছে সোয়াট সদস্যরা। ওই জঙ্গীর বয়স ২৫ বছর। তার পরনে সবুজ রঙের টি শার্ট ও লুঙ্গি রয়েছে। এছাড়া সকাল থেকে ওই ভবনের আশপাশের ভবনগুলোতে অবস্থান নেয় পুলিশ। অভিযানে সহযোগিতা করতে সশস্ত্র বাহিনীর প্যারাকমান্ডোদের একটি দল ঘটনাস্থলে অবস্থান করছে বলে জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেন আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের সহকারী পরিচালক মোঃ রেজাউল করিম। প্রসঙ্গত, পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও তার স্ত্রী-সন্তানকে ২০০৬ সালের ২ মার্চ এই সিলেটেরই পূর্ব শাপলাবাগের সূর্যদীঘল বাড়ি নামের এক ভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। গত বছর জুলাই মাসে গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের মধ্যে বেশ কিছুদিন পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও এ বছর মার্চের শুরু থেকে জঙ্গীরা নতুন করে তৎপরতা শুরুর জানান দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৬ মার্চ হরকত-উল-জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান ও তার সহযোগীদের আদালত থেকে কাশিমপুর কারাগারে ফিরিয়ে নেয়ার পথে টঙ্গীতে প্রিজনভ্যানে বোমা হামলা করে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা হয়। এক জঙ্গী গ্রেফতার হয়। এরপর ৭ মার্চ কুমিল্লায় বাসে তল্লাশির সময় জঙ্গীরা পুলিশের উপর বোমা হামলা চালায়। ধরা পড়ে দুই জঙ্গী। গ্রেফতারকৃতদের একজনকে নিয়ে ওই রাতে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মেলে। আস্তানা থেকে উদ্ধার হয় অস্ত্র ও বোমা। গত ১৫ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকু-ের আমিরাবাদের এক বাড়ি থেকে বিস্ফোরকসহ এক জঙ্গী দম্পতিকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক সীতাকু-ের প্রেমতলায় অভিযান চালিয়ে জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মেলে। ১৬ মার্চ দীর্ঘ ১৯ ঘণ্টা ঘেরাও রাখার পর প্রেমতলার ওই আস্তানায় অভিযানকালে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে ও গুলিতে এক নারীসহ চার জঙ্গী নিহত হয়। আস্তানায় বোমায় ক্ষতবিক্ষত এক শিশুর লাশ পাওয়া যায়। গত ১৭ মার্চ শুক্রবার দুপুরে পবিত্র জুমার নামাজের সময় আশকোনায় র‌্যাবের নির্মাণাধীন সদর দফতরে ঢুকে আত্মঘাতী হামলার সময় এক জঙ্গী নিহত হয়। তার দেহে বেঁধে রাখা বোমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যার তার শরীর। ১৮ মার্চ ভোর সাড়ে চারটার দিকে মোটরসাইকেল নিয়ে এক জঙ্গী খিলগাঁওয়ের শেখের জায়গায় র‌্যাবের চেকপোস্টে হামলার সময় র‌্যাবের গুলিতে নিহত হয়। হামলাকারী জঙ্গীর দেহে বিস্ফোরক ছিল। পুলিশ জানায়, সম্প্রতি গ্রেফতারকৃতদের প্রায় সবাই ও নিহত জঙ্গীরা নব্য জেএমবির আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য।
×