ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কোরান শরীফ হাতে নিয়ে বলেছিল, ‘আজ থেকে তুই আমার বউ’

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৫ মার্চ ২০১৭

কোরান শরীফ হাতে নিয়ে বলেছিল, ‘আজ থেকে তুই আমার বউ’

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ছয় বোনের মধ্যে তৃতীয় মাফিয়া আক্তারের বয়স পনেরো বছর। দারিদ্র্যের কশাঘাতে স্কুলে যেতে পারেনি এই কিশোরী। তার বাবা আবু সাঈদ একজন রিক্সা চালক। পরিবারের নয় সদস্যের ভরণপোষণ চালানোর মতো ক্ষমতা নেই তার বাবার। বাধ্য হয়ে মাফিয়া ও অন্যান্য বোনেরা কেউ গৃহকর্মী ও গার্মেন্টসে চাকরি করে জীবনযাপন করছে। মাফিয়া ছোট বেলা থেকেই গৃহকর্মী হিসেবে মানুষের বাসায় কাজ করে দিন পার করে দিচ্ছে। ছয় বোন, ছোট এক ভাই, মা-বাবাকে নিয়ে মাফিয়া কদমতলীর সাদ্দাম মার্কেট এলাকার জিরোপয়েন্টে বসবাস করে। ২০১৫ সাল থেকে মাফিয়া ফতুল্লার কালাম নামের এক মালিকের বাসায় মাসিক আড়াই হাজার টাকার বিনিময়ে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করে। ২০১৬ সালের মাঝামাঝিতে কিছু দিনের জন্য গৃহকর্মীর কাজ ছেড়ে মাফিয়া বড় বোনের সঙ্গে গার্মেন্টসে কাজ করার জন্য যোগ দেন। কিন্তু ওই বাড়ির মালিক মাফিয়ার পরিবারকে রাজি করিয়ে আবার তাদের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে নিয়ে যান। তখনও মাফিয়া আঁচ করতে পারেনি কি হতে চলেছে তার সঙ্গে। বুধবার ঢামেক হাসপাতালের ওসিসিতে মেডিক্যাল করতে এসেছিলেন মাফিয়া। কিন্তু কেন? কি ঘটেছে তার সঙ্গে? হাসপাতালে অবস্থানের সময় জনকণ্ঠকে তার জীবনে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক লোমহর্ষক কাহিনী শোনান ১৫ বছর বয়সী এই কিশোরী। ২০১৬ সালের নবেম্বরে পুনরায় ফতুল্লার ওই বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করে। ঠিক এ মাসেই দীর্ঘ দুই বছর পর কাতার থেকে দেশে ফেরে মালিকের ছেলে গোলাম মওলা বাবু (৩৫)। এর কিছুদিন পরই মালিকের ছেলে গোলাম মওলা বাবুর কুনজর পড়ে মাফিয়ার উপর। চার বছরের এক সন্তানের জনক বাবু গৃহকর্মী মাফিয়াকে একদিন ফাঁকা ঘরে পেয়ে ধর্ষণ করেন। মাফিয়া যেন ঘটনাটি কাউকে না বলে এজন্য তাকে হুমকিও দেয়া হয়। এ ঘটনা প্রসঙ্গে মাফিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সেদিন ওই বাসায় কেউ ছিল না। সবাই আত্মীয়ের বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়েছিল। তিনি ইচ্ছে করেই কাজ করানোর বাহানায় আমাকে বাড়িতে থাকতে বললেন। তারপর তিনি আমার সঙ্গে খারাপ কাজ করেন। এক পর্যায়ে তিনি কোরান শরীফে হাত রেখে বলেন, ‘আজকে থেকে তুই আমার বউ। এই কথা কাউকে বলবি না। বললে খবর খারাপ আছে। আমি কথা দিচ্ছি তোকে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করব।’ এরপর আমি ভয় পেয়ে কাউকে বিষয়টি বলিনি। ওইদিনের পর থেকে বিভিন্ন সময় নিজের বাড়িতে ও বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তিনি আমাকে ধর্ষণ করেছেন। আমি ভেবেছি সত্যিই তিনি আমাকে বিয়ে করবেন। অনেকবার আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছি, কেন আপিনি আমাকে বিয়ে করবেন? আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ, আপনার বউ বাচ্চা আছে। প্রতিবারই তিনি বলেছেন, তিনি আমাকে ভালবাসেন, তাই বিয়ে করবেন। কিন্তু গত পাঁচ মাস ধরে তিনি আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করেছেন। অনেকবার বিয়ের কথা বলে বন্ধুর বাসায় নিয়ে গেলেও বিয়ে করেননি।’ কথাগুলো বলতে বলতে মাফিয়ার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে এলো। বলল, আমার সঙ্গে প্রতারণা করার শাস্তি পেতেই হবে তাকে।’ গত ১৪ মার্চ মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে মাফিয়ার বাড়ির পাশে অপেক্ষা করছিল বাবু। মাফিয়া হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে তাকে দেখে। পরক্ষণে মাফিয়াকে বিয়ে করার নাম করে বন্ধুর বাসায় ফুঁসলিয়ে নিয়ে যায় সে। কিন্তু দুপুর পার হয়ে রাত ১০টা বাজলেও সে মাফিয়াকে বিয়ে করে না। এদিকে, মাফিয়া বাসায় না জানিয়ে হঠাৎ এমন নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় পরিবারের সবাই খোঁজাখুঁজির পর বাবা আবু সাঈদ রাতে গিয়ে কদমতলী থানায় জিডি করেন। মাফিয়া বলেন, ‘আমার আব্বা যে পুলিশে জিডি করছে এই বিষয়টি বাবু তার পরিবারের কাছ থেকে জানতে পারে। এরপর সে আমাকে রাত ১২টার দিকে বাসায় ফিরে যেতে বলে এবং জিডি উঠিয়ে নিতে বলে। আমি বাসায় ফেরার পর সবাইকে এই ঘটনার কথা বলে দেই। এরপর আব্বা ১৫ তারিখ আমাকে নিয়ে থানায় যায়। এবং বাবুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা দেয়া হয়। মামলা করার পর থেকে বাবু বিভিন্ন সময় আব্বাকে ফোন করে হুমকি দিয়েছে এবং কেস উঠিয়ে নিতে বলেছে।’ এদিকে, এ ঘটনায় কদমতলী থানায় অভিযুক্ত গোলাম মওলা বাবুর বিরুদ্ধে মাফিয়াকে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা দেয়া হলেও পুলিশের তদন্ত কার্যক্রমে কোন অগ্রগতি নেই বলে জনকণ্ঠকে অভিযোগ করেন মাফিয়ার বাবা আবু সাঈদ। তিনি বলেন, ‘মামলা করার পর এক সপ্তাহ কেটে গেলেও পুলিশ এখনও অপরাধীকে খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ অপরাধী প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোন করে হুমকি দিচ্ছে। পুলিশ যদি বাবুর পরিবারকে জোর দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালায় তাহলেই অপরাধীর খোঁজ পাওয়া সম্ভব। কয়েকদিন আগে বাবু ফোন করে আমাকে বলেছে, পুলিশ আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। পুলিশকে আমি কিনতে পারি।’ তাহলে কি আমার মেয়ের সঙ্গে ঘটা এ অপরাধের কোন শাস্তি পাবে না অপরাধী? কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন হতদরিদ্র রিক্সাচালক আবু সাঈদ। অন্যদিকে, এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কদমতলী থানার (আইও) রাইসুল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ঠিকমতোই তদন্ত কাজ চালাচ্ছি। ইতোমধ্যে অভিযুক্ত বাবুর পরিবারের সদস্যদেরও প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। কিন্তু এখনও অপরাধীর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমরা অপেক্ষা করছি মাফিয়ার মেডিক্যাল রিপোর্টের জন্য। এরপরই আমরা তদন্তে অন্য মোড় নেব। আশা করছি খুব শীঘ্রই অপরাধীকে খুঁজে পাব।’ এখনও গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হয়নি। গৃহকর্মী মাফিয়া আক্তারের সঙ্গে যে ঘটনাটি ঘটেছে তা থেকে এটা স্পষ্ট, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে অপরাধীরা এসব ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। গৃহকর্মীদের সুরক্ষার জন্য হাইকোর্ট নির্দেশ দেন আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। গত বছর সরকার প্রণয়ন করে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা। তারও কোন বাস্তবায়ন বর্তমানে চোখে পড়ছে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিপে জানা গেছে, গৃহকর্মী বিশেষ করে শিশুর ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে চলেছে। অথচ নির্যাতনের ঘটনাগুলোর কমপক্ষে ৫০ শতাংশই থেকে যাচ্ছে সকলের অগোচরে। কারণ এগুলোর ব্যাপারে কোন মামলা- মোকদ্দমা হয় না। আবার অনেকগুলোর মামলা হলেও আদালতের বাইরে আপোস নিষ্পত্তি হয়ে যাচ্ছে। ফলে নির্যাতনকারীরা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছে। প্রধানত দারিদ্র্যের কারণেই শিশুরা গৃহকর্মে নিয়োজিত হচ্ছে। মাফিয়ার পরিবারের মতো অনেক দরিদ্র পরিবার খাওয়াতে পরাতে না পারার কারণে শিশু সন্তানদের অন্যের ঘরে কাজে নিয়োজিত করছে। মানসিক নির্যাতনসহ অনেক গৃহকর্মী মাফিয়ার মতো ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০ সালের শিশুশ্রম জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গৃহকর্মে নিয়োজিত আছে এক লাখ ২০ হাজারের বেশি শিশু। তবে বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি বলে বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা অভিমত দিয়েছে। এই শিশুদের বেশিরভাগই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নানাভাবে। পৈশাচিক নির্যাতনে শিশুদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে প্রায় সময়ই। গত বছর কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু হয়েছে ৩০ জন গৃহকর্মীর। এদের মধ্যে ১৭ জনেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। এছাড়া, ২০১৫ সালে মারা যাওয়া ৩২ জন গৃহকর্মীর ২৩ জনই ছিল শিশু। ২০১৪ সালে ৫৫টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, মৃত্যু হয় ২৭ জন গৃহকর্মীর। সব মিলিয়ে গত পাঁচ বছরে সারাদেশে এক শ’ ৮২ জন গৃহকর্মীর মৃত্যু ঘটেছে। গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা অনুযায়ী, কোন গৃহকর্মী নিয়োগকারী, তার পরিবারের সদস্য বা অতিথিদের দ্বারা শারীরিক, মানসিক বা যৌন হয়বানির শিকার হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। গৃহকর্মী নির্যাতন বা হয়রানির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানা যেন দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে সেজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দাফতরিক নির্দেশনা জারি করতে হবে। কোন গৃহকর্মী যৌন হয়রানি, যৌন নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করলে সরকারী খরচে সেই মামলা পরিচালিত হবে। সেইসঙ্গে, এই নীতিমালা বাস্তবায়নে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি তদারকি সেল থাকবে। এছাড়া সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আঞ্চলিক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা-উপজেলায় যথাক্রমে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে মনিটরিং সেল গঠন করা হবে বলেও নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে।
×