ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কলাপাড়ায় নজরদারি নেই বলে তারা বেছে নিয়েছে প্রত্যন্ত জনপদ

বিভিন্ন নামে জঙ্গীরা সংগঠিত হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ২৫ মার্চ ২০১৭

বিভিন্ন নামে জঙ্গীরা সংগঠিত হচ্ছে

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ২৪ মার্চ ॥ পটুয়াখালীর সাগরপারের জনপদ পর্যটন এলাকা কুয়াকাটা এবং পায়রা বন্দরসহ কলাপাড়ায় জেএমবির আদলে বিভিন্ন সংগঠন গোপনে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজারের মতো এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ তাদের কব্জায় নেয়ার টার্গেট নিয়ে এ গোষ্ঠী এখন মাঠে নেমেছে। গোপনে, কখনও প্রকাশ্যে এরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। রবিবার বহিরাগত চার সন্দেহভাজন জঙ্গী পুলিশের হাতে ধরা পড়ায় বিষয়টি আলোচনা উঠে এসেছে। ২০১৬ সালের ১৪ মে এ চক্রের অন্তত দশ নারী সদস্যসহ ৫০ জনের একটি দল আজিমপুর গ্রামে সাংগঠনিক কর্মতৎপরতাসহ নাশকতার ছক কষতে জামায়াত নেতা নুরুল ইসলাম জেহাদীর বাড়িতে বৈঠক চলাকালে পুলিশ হানা দেয়। তখন দুইজনকে গ্রেফতার করে। এছাড়া সেখান থেকে জামায়াতের কুয়াকাটার সাংগঠনকি কর্মকা-ের পরিকল্পনার খাতা-পত্র, চাঁদা আদায়ের রসিদ, চাঁদাদাতাদের রসিদ বই, নগদ টাকা, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন উপকরণ জব্দ করে। একই তারিখ মহিপুর থানার তৎকালীন এসআই মনিরুজ্জামান ১৪ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। মামলায় আসামিদের মধ্যে জামায়াতের পাঁচ নারী কর্মী হলেন, মেহের আলীর স্ত্রী জয়নব রানী, মাওলানা হাবিবুর রহমানের স্ত্রী নাজমা হাবিব, মাওলানা আব্দুল মান্নানের মেয়ে জোবায়দা, মাওলানা আব্দুল মান্নানের স্ত্রী হালিমা ও অপর একজন তাসলিমা। এখানে স্বামীর নাম গোপন করেছিলেন মোসা জোবায়দা। তিনি মুক্তিযোদ্ধা মেমোরিয়াল কলেজের শিক্ষক। এরা ছাড়াও কয়েকজন মাদ্রাসা, কলেজ ও স্কুল শিক্ষক রয়েছেন যাদের এসব কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। যার মধ্য থেকে দুইজনকে চিহ্নিত করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এ অঞ্চলে জামায়াত তাদের নারী সংগঠনকে চাঙ্গা করতে নতুন কৌশলে এগুচ্ছে বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। পুলিশ চাঁদা আদায়ের রসিদ পর্যালোচনা করে দাতাদের নাম সংগ্রহ করেছেন। যাদের মূলত নিষিদ্ধ সংগঠনের অর্থায়নকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এমনকি পটুয়াখালী জেলার কার্যক্রমও চলত কুয়াকাটায়। উপকূলীয় সাগরপারের এ জনপদে বিশেষ কোন বাহিনীর দৃশ্যমান কঠোর কোন অভিযান না হওয়ার সুযোগে জামায়াত তাদের পুরুষ সংগঠনের পাশাপাশি নারী সংগঠনকে চাঙ্গা করছে। ১৪ মে সভার পরে পুলিশ এদের কর্মকা- সম্পর্কে ব্যাপক অনুসন্ধানে নামে। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা মাঠ পর্যায়ে পুরুষ-নারী যারা এমন কর্মকা-ে জড়িত রয়েছে তাদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর করছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই হাফিজ জানান, মামলাটির তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। শীঘ্রই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে। এজাহারকৃত আসামি ছাড়াও অজ্ঞাত আসামিদের মধ্যে নেছারুদ্দিন সিনিয়র মাদ্রাসার শিক্ষক ঝালকাঠির কাঠালিয়ার বাসিন্দা মাহবুব খান ও কলাপাড়ার রজপাড়া গ্রামের মহিউদ্দিন শিকদারকেও পুলিশ এ মামলায় গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করে। এরা আদালত থেকে জামিন নিয়েছে। কলাপাড়ায় তাদের শক্ত অবস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে এসব জঙ্গী সংগঠন উপকূলীয় সাগর-নদী বেষ্টিত এ জনপদকে টার্গেট করে। গোয়েন্দাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি না থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার ওয়ান্টেডরা এ জনপদকে বেছে নেয়। বর্তমানে কলাপাড়ায় চলছে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকা-। গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য সরকারী বেসরকারী স্থাপনাসহ সেতু। চলছে তৃতীয় সমুদ্রবন্দর প্রকল্প পায়রার অবকাঠামোগত উন্নয়ন। রয়েছে অত্যাধুনিক রাডার স্টেশন। শেরেবাংলা নৌঘাটি স্থাপনের প্রাথমিক কাজ চলছে। তাপবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, পাট গবেষণা কেন্দ্র, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ বৌদ্ধমূর্তি রয়েছে মিশ্রিপাড়ায়। কুয়াকাটায় রয়েছে অত্যাধুনিক দৃষ্টিনন্দন রাখাইন সীমা বৌদ্ধ বিহারসহ অর্ধশত বৌদ্ধমন্দির ও বিহার। ভবিষ্যত পরিকল্পনা অনুসারে কলাপাড়া হতে যাচ্ছে দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ উপজেলার পর্যটনকেন্দ্রসহ এখানকার পেশিশক্তির নিয়ন্ত্রণ ওই জঙ্গীগোষ্ঠী কব্জা করতে সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনার ছক করে রেখেছে বলে নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে। জঙ্গী গ্রুপটি বিভিন্ন সময়ে জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, আলহিকমা, হেদায়েতুল ইসলাম, দাওয়াতে ইসলামসহ বিভিন্ন নামে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা গেছে এসব তথ্য। সূত্র মতে, বিভিন্ন নাম থাকলেও মূলত এরা সবাই জামায়াত শিবিরের নিয়ন্ত্রণেই চালাচ্ছে তাদের কর্মকা-। ২০১৪ সালের প্রথমদিকে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামে মোঃ শাকুরের বাড়ি থেকে বহিরাগত ছয়জনকে আটক করে পুলিশে দেয় স্থানীয় লোকজন। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রহমান তালুকদার জানান, আটক করা সকলেই একটি ইসলামী জঙ্গী সংগঠনের। যার বাড়ি থেকে আটক করা হয়েছিল ওই ব্যক্তি বছরের অধিকাংশ সময় ঢাকায় অবস্থান করে। মাঝে-মধ্যে বহিরাগত লোকজন নিয়ে পাঁচ/ছয়দিন অবস্থান করে। ওই এলাকায় কলাপাড়া উপজেলা জামায়াতের এক শীর্ষ নেতার বাড়ি। প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের নেতৃবৃন্দের ছবি বিকৃত করে অপপ্রচারকালে কম্পিউটার সামগ্রীসহ মোহাম্মদপুর গ্রাম থেকে ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ রাতে লিটন গাজী গ্রেফতার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা রয়েছে। কিন্তু অধিকতর তদন্ত করে এর সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা যায়নি। মূলত ২০০৬ সালেই এ এলাকাকে টার্গেট করে জামায়াত-শিবির। ওই বছরের ২২ জুন থেকে পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণের নাম করে সারাদেশের জেলা পর্যায়ের প্রায় পাঁচ শ’ নেতাকর্মীকে জড়ো করে কুয়াকাটায় কর্মশালা করা হয়। পুলিশ বিভিন্ন সময় কলাপাড়া উপজেলা জামায়াত নেতা অধ্যাপক খালেক ফারুকীসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। এর মধ্যে নাসিরউদ্দিন এবং আলতাফ হোসেন জামায়াতের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে পুলিশের কাছে মুচলেকা দিয়েছে। এরা এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে সখ্য রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। তবে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে নতুন করে ফের এসব বিতর্কিত জঙ্গীপনার দায়ে অভিযুক্ত সংগঠনের কার্যক্রম চলে আসছে। সর্বশেষ রবিবার চারজনকে গ্রেফতারের পরে পুলিশ নড়েচড়ে বসেছে। সচেতন মহলের মতে পর্যটন এলাকা কলাপাড়ার শহরসহ পায়রা বন্দর এবং কুয়াকাটা এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তার প্রয়োজন রয়েছে। কলাপাড়া থানার ওসি জিএম শাহনেওয়াজ জানান, বর্তমানে যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের কাছ থেকে এদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাসহ সকলকে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।
×