ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ধা রা বা হি ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ২৪ মার্চ ২০১৭

ধা  রা  বা  হি  ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

(পূর্ব প্রকাশের পর) মাখফি সুলতান আদিল শাহকে বিজাপুরবাসী মনে রাখবেন মুঘলদের সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে চুক্তি করে স্বাধীন সত্তা অর্জন করার জন্য। বিজাপুরের প্রাসাদ দেয়ালে বাইজেন্টাইন রীতির অর্ধনগ্নিকা মূর্তি কিংবা তুর্কী অটোমান সুলতানদের আদলে হাম্মামখানায় অভিজাত নাগরিকদের স্নানবিলাস সারা হিন্দুস্তানে মশহুর ছিল। আদিল শাহের মৃত্যুর পর দিল্লির বাদশাহ শাহজাহান বিজাপুরের সাজানো প্রাসাদ তছনছ করে দিতে চাইলেন। তিনশো ছিয়াশি কিলোমিটার দূরের আওরঙ্গাবাদ হতে তাঁর আদেশে ছুটে এলেন শাহজাদা আওরঙ্গজেব। বিজাপুর পৌঁছানোর পথে ধ্বংস করলেন বিদার, কল্যাণী’র মতো বড় দুর্গ শহরগুলো। গোলকোন্দা হতে আওরঙ্গজেবের মুঘল বহরে যোগ দিয়েছিলেন পারস্য হতে আসা আরেক ধূর্ত সেনাপতি মীর জুমলা। দাক্ষিণাত্যে বাদাম সুলতানদের অন্তিম সময় তখন। কিন্তু প্রচণ্ড বর্ষায় আওরঙ্গজেবের গতি কমে গেল। মালভূমিতে দুই মাইলব্যাপী লম্বা মুঘল সেনা বহরের পেছন দিকে মাঝে মাঝে অতর্কিতে হামলা করে যুদ্ধ যাত্রায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিলেন মারাঠা রাজা শিবাজী। প্রত্যাঘাতের আগেই আবার পর্বতে লুকিয়ে যাচ্ছিলেন। দাক্ষিণাত্যের প্রতি অধিকার তারও কম নয়। বিজাপুরের দুর্গ দেয়ালে আঘাত করার আগেই খবর এলো বাদশাহ শাহজাহান মৃত্যু শয্যায়। বিজাপুর দখলে না নিয়ে কোটি টাকার করারোপ চুক্তি করেই ফিরে গেলেন আওরঙ্গজেব। বিজাপুরের হাম্মামখানার চেয়ে দিল্লির সিংহাসন অনেক দামী। আওরঙ্গজেব যখন মুঘল সিংহাসনের দখল পেতে দিনরাত অস্থির থাকছেন, তখন তাঁরই প্রাসাদ চত্বরে অলক্ষ্যে ঘটে চলছিল এক বিপরীতমুখী ঘটনা। শুধুমাত্র রাজপুরুষ নয়, আওরঙ্গজেব তাঁর পুত্র-কন্যা প্রত্যেকের পেছনে গুপ্তচর লাগিয়ে রাখতেন। নবীন শাহজাদা-শাহজাদীরা কি করেন, কার সঙ্গে মেলামেশা করেন সবই তাঁর জানা চাই। তাঁর প্রথম কন্যা যিনি তাঁর ফুপিজান জাহান আরার মতোই বিদুষী হয়েছেন। আবার ধ্যানে-জ্ঞানে ভীষণ ভক্ত চাচাজান দারা শিকোর। দারা’কে অন্ধের মতো মান্য করেন। শাহজাহানেরও একান্ত ইচ্ছে ছিল দারা’র পুত্র সুলাইমানের সঙ্গে জেবুন নেসার বিয়ে দেবেন। আওরঙ্গজেব তা চান না। জেবুন নেসার এখন একান্ত ইচ্ছে আর যাই হোক তাঁর লেখা গজল সংকলন ‘দিওয়ান-এ-জেবুন নেসা’ উৎসর্গ করবেন তাঁকে। কিন্তু আওরঙ্গজেব তাঁর গতিবিধি সবসময় অনুসরণ করায় তা সম্ভব হচ্ছিলো না। জেবুন নেসা স্বাধীনচেতা, পরমাসুন্দরী। নিজের গড়া কিতাবখানায় বুঁদ হয়ে থাকেন। তাঁর সংগ্রহে আরো আছে জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র, বিজ্ঞান বিষয়ক বিষয়ের দুর্লভ বইপত্র। বিয়ের বয়স হয়ে গেলেও এই বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করলে রেগে যান। আগ্রহ দেখান না। পছন্দ করেন না তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে আলাপ করতে। একবার তো পারস্যের সুলতান শাহ আব্বাসের ছেলে মীর্জা ফারুক’কে যা তা বলে অপমান করলেন। সেই শাহজাদার দোষ ছিল জেবুন নেসার রূপ দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেন নি। মিষ্টি খেতে চাইবার ওসিলায় তাঁকে চুমু খেতে চেয়েছিলেন। প্রেমিককে প্রত্যাখ্যান করলেও ভেতর ভেতর ভীষণ প্রেমিক তিনি। যাকে ভালো লাগবে তাকে সমর্পণে তাঁর কোন বাধা নেই। এরিমধ্যে লুকিয়ে পড়ে ফেলেছেন ভারতীয় পণ্ডিতদের লেখা কামসূত্রের আদলে ফার্সী ভাষায় ‘লাজাত আল নিসা’ (নারীর উৎফুল্লতা), ‘তাধকিরাত আল শাহাওয়াত’ (কামদ্দীপনের পাঠ) ইত্যাদি। ভালোবাসেন মদ-গোলাপ-ঝর্ণা-প্রিয়তমের মুখ। আবার সাত বছর বয়স হতে কুরান শরীফ অনর্গল মুখস্থ জেবুন নেসা’র। আওরঙ্গজেব কন্যার জ্ঞান চর্চায় বাধা দেন না। পিতৃস্নেহ তাঁর বড়ই প্রবল। আওরঙ্গজেব আরো গোপনে জেনেছেন, জেবুন নেসা ইদানীং ভালোবাসছেন ওই পাহাড়ী উদ্ধত রাজা শিবাজী ছত্রপতি’কে। এটা নিয়ে তিনি অনেক পেরেশান থাকেন। আওরঙ্গজেবের কন্যা হয়ে শত্রুকে কেন ভালোবাসতে হবে - এই সহজ সত্যটি তাঁর মাথায় আসে না। জেবুন নেসা ইতিমধ্যে কবুতর মারফত শিবাজিকে নিজের লেখা বেশ কিছু কবিতা পাঠিয়ে দিয়েছেন। নিজের ছদ্মনাম লিখেছেন, মাখফি। অর্থাৎ : গোপন। এই জাতীয় এক প্রেম পদ্য আওরঙ্গজেবের হস্তগত হয়েছে। “তোমার কোঁকড়া চুল আর হৃদয় কাঁপানো চোখের ভাষায় সেই সঙ্গে জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে আমি তো পুরোই কেঁপে গেলাম।” নাউজুবিল্লাহ! আওরঙ্গজেব নিমিষে বুঝে নিয়েছিলেন এটা ‘শয়তান’ শিবাজীর প্রেমে অন্ধ হয়ে লেখা। ওদিকে বিজাপুর আগ্রাসন শেষে ফেরার পথে ইকবাল ফায়সাল নামের এক গুপ্তচর এক বন্দী মারাঠা যোদ্ধার আস্তিন হতে শিবাজী’র হাতে লেখা চিঠি জব্দ করে। চিঠির প্রাপক আর কেউ নন, স্বয়ং জেবুন নেসা। তাতে লেখা ছিল : “আমার কোমল হৃদয়, রক্ত লাল গোলাপের পাপড়ি ভাঁজে ভাঁজে ঘুমিয়ে আছে আগুনের আভায়, একটি নিঃশ্বাস কিংবা বসন্তের বাতাসে গোলাপের মতো আমার হৃদয়-কলি কি উড়িয়ে নেবে?” বলা বাহুল্য, কবিতাটি মহামতি সম্রাট বাবরের লেখা। এই কঠিন প্রেমের বিষয়ে কি করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না আওরঙ্গজেব। কুয়াশার চাদরে মোড়া আওরঙ্গাবাদের কেল্লায় নির্ঘুম প্রহর কাটে আওরঙ্গজেবের। উত্তর হতে হিমালয়ের ঠাণ্ডা বাতাস সবাইকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আজ ভোরেও ঘুম পাতলা হয়েছে তাঁর। কোন দুঃস্বপ্ন আজ তাকে জাগায় নি। তিনি জেগে জেগে বিজাপুর দুর্গের ভেজা দেয়ালগুলি কল্পনা করছিলেন। নামাজ শেষে জায়নামাজে বসে এই মুহূর্তে আপাতত তিনটি সমস্যা মোকাবেলায় চিন্তিত তিনি। প্রথম সমস্যা, সুজা যেহেতু নিজেকে সম্রাট ঘোষণা দিয়ে তার নামে খুতবা পড়ানো শুরু করেছেন, স্বাভাবিকভাবে দিল্লি হতে মুঘল সেনাবাহিনী দারা’কে পরাস্ত করতে এগিয়ে যাবে বাংলার দিকে। সেখানে কে জিতলে তিনি লাভবান হবেন? দ্বিতীয় সমস্যা, মুরাদ সরাসরি দারা-বিদ্বেষী। এই মাথামোটা মদ্যপটাকে কিভাবে সুজা ও দারা উভয়ের পক্ষে আরো ক্ষেপিয়ে নিজের দলে টানা যায়? তৃতীয় সমস্যা, কখন মোক্ষম সময় দিল্লি দখল করার? চাপা দীর্ঘশ্বাস আর চেপে রাখতে পারলেন না আওরঙ্গজেব। জায়নামাজে বসেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন। হাতে রাখা পাথরের তসবিহতে গাঢ় চুমু খেয়ে উপরে তাকিয়ে মোনাজাতের ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, ‘ইয়া মাবুদ, আমি আর পারছি না সহ্য করতে। ওই নাফরমান, গুনাহগার, কাফির জালিমদের হাত হতে হিন্দুস্তান রক্ষা করে আমার হাতে তুলে দিন।’ এরপর চোয়াল শক্ত করে সকালের প্রতীক্ষা করতে থাকলেন। বিড়বিড় করে বললেন। - নিজেকে শান্ত কর। তুমি রাজা হবার জন্যই জন্মেছো আওরঙ্গজেব! এখন কেবল প্রয়োজন বিরামহীনভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। মাত্র আধ ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিজেকে সতেজ করে নিলেন আওরঙ্গজেব। তাঁর পক্ষেই সম্ভব এতো অল্প ঘুমিয়ে ক্লান্তি দূর করা। সকালের শুরুতেই ডেকে পাঠালেন তাঁর প্রধান পরামর্শক মীর জুমলা’কে। বেশী দেরী করলে দিল্লি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে এই আশংকা তাঁকে পেয়ে বসেছে। - সারাজীবন তো বাদশাহ শাহজাহানের নিমক খেলেন। তো এখন কোন্ পক্ষের খেতে চান মীর জুমলা সাহেব? রসিকতা করে অভ্যর্থনা জানালেন আওরঙ্গজেব। জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে মধুর হাসি দিলেন মীর জুমলা। দুর্মুখরা আড়ালে তাঁকে দাক্ষিণাত্যের শেয়াল বলে ডাকেন। আওরঙ্গজেব নিজেও তা জানেন। কথাটা মিথ্যে নয়। - কি বলছেন হুজুর? আমি তো আমার হৃদয় আপনাকেই দিয়ে রেখেছি। হিন্দুস্তান শাসন করতে আপনার মতো কাবিল-উস্তাদ আর কে আছে বলুন? আমি এটাও জানি কেন আপনি আমাকে এই সকালে এত্তেলা পাঠিয়েছেন। চারপাশের সব খবর আমার কানে এসেছে। আওরঙ্গজেব উৎসুক হলেন। তিনি জেনেছেন মীর জুমলা’র নিজস্ব গুপ্তচর বাহিনী আছে। - আপনার কি মনে হয়, দারা’র সেনাবাহিনী সুজা’কে পরাস্ত করতে পারবে? - অবশ্যই হুজুর। ইতিমধ্যে শাহজাদা দারা তাঁর পুত্র সুলাইমানকে বিহারের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। - আর মুরাদ? - উনি তো নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন। মন্ত্রী আলী নকী’কে হত্যা করে পুরো গুজরাট একা ভোগ করছেন। কিন্তু ..., একটু দম নিলেন মীর জুমলা। আওরঙ্গজেবের কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করে বললেন, ‘ইদানীং সরনকোট হতে আনা মেহজাবীন নামের এক সুন্দরী ছাড়া তিনি নাকি আর কাউকে চেনেন না।’ আলী নকীর বিষয়টা শুনেছেন আওরঙ্গজেব। কিন্তু মুরাদের এই নতুন খেলনাটি সম্পর্কে গুজরাটে তাঁর বিশেষ গুপ্তচর আরশাদ রশীদ কোন খবর দিলো না কেন? অস্বস্তি বোধ করতে থাকলেন ভেতর ভেতর। - কিভাবে মুরাদকে আমার পক্ষে কাজে লাগাবো? সরাসরি জানতে চাইলেন আওরঙ্গজেব। মীর জুমলা একটু নড়েচড়ে বসলেন। ভাই-ভাই লড়াইটা তিনি অনেক উপভোগ করছেন। তিনি বুঝে গেছেন এই ফাটল আর জোড়া লাগবে না। সাম্রাজ্য চার টুকরো করে চার শাহজাদাকে যদি এই মুহূর্তে বাদশাহ শাহজাহান বিলিয়ে দেন তাতেও শান্তি হবে না। গৃহযুদ্ধ অনিবার্য। - একটা উপায় আছে ...। ডান হাতের তালু চোখের সামনে রেখে চার আঙ্গুলে মূল্যবান পাথরের আংটিগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের ভান করে বললেন মীর জুমলা। (চলবে)
×